ইসলামপন্থী দলগুলোর আসল উদ্দেশ্য কি?

দেশের রাজনীতিতে পীর বা সুফি নেতাদের নেতৃত্বাধীন দলগুলো দশকের পর দশক ধরে কাজ করলেও বিকল্প এবং স্বতন্ত্র শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকে ঘিরে দুই জোটের রাজনীতিতেই ঘুরপাক খাচ্ছে এসব দলের রাজনীতি।

পীর বা সুফি নেতাদের নেতৃত্বাধীন ইসলামপন্থী দলগুলোর উদ্দেশ্য আসলে কি? বাংলাদেশে এই দলগুলোর ভবিষ্যত কতটা আছে—এসব প্রশ্ন এখন অনেকে তুলছেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে সংবিধান সংশোধন করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার সুযোগ দেয়া হয়েছিল ১৯৭৮সালে। সেই সুযোগ নিয়ে তখন নিষিদ্ধ ইসলামপন্থী কয়েকটি দল আবার রাজনীতি শুরু করেছিল।

আশির দশকের শেষদিকে তাতে যুক্ত হয়েছিল পীরদের রাজনীতি।

কয়েকজন পীর বা সুফি নেতা ইসলামপন্থী দল গঠন করে রাজনীতির মাঠে নেমেছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরিন বলছিলেন, জেনারেল এরশাদ তার ক্ষমতার স্বার্থে ধর্মকে ব্যপকভাবে ব্যবহার করেছিলেন এবং তার পৃষ্ঠপোষকতাতেই তখন দল গঠন করে পীরদের রাজনীতিতে নামতে দেখা গেছে।

“বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ব পীরবাদী সংস্কৃতি যদি আমরা দেখি, সেখানে একটি আউলিয়াভিত্তিক সংস্কৃতি ছিল। যেখানে গানবাজনা, উৎসব, মেলা এবং একটা লোকাচার ছিল। আমাদের এখানে সুফিবাদের চর্চা দীর্ঘদিনের।”

“কিন্তু ৮০ সালের পর থেকে বিশেষ করে সামরিক শাসক এরশাদের সময় ১৯৮৭ সালে প্রথম তার পৃষ্ঠপোষকতায় চরমোনাই পীরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন। এরপর আমরা দেখেছি ১৯৮৮ সালে ইসলাম রাষ্ট্র ধর্মের স্বীকৃতি পায়।”

জোবাইদা নাসরিন আরও বলেছেন, “শর্ষিনার পীর, ৭১ সালে যিনি পাকিস্তানের সামরিক শাসককে সহযোগিতা করেছিলেন, তাকেও জেনারেল এরশাদ স্বাধীনতা পদক দিয়েছিলেন। সেই আমল থেকেই পীর এবং ইসলামকে আমাদের দেশের রাজনীতি ব্যবহার করার ব্যাপারটি ভিন্নমাত্রা পায়।”

দেশে ইসলামপন্থী দলের সঠিক সংখ্যা বলা মুশকিল। পীর বা তাদের বংশধরদের নেতৃত্বে দলের সংখ্যাও কম নয়।

তবে পীরদের দলগুলোর মধ্যে মাত্র চারটি দল নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন পেয়ে কাজ করছে।

এই দলগুলো ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠাকেই মুল লক্ষ্য হিসেবে তুলে ধরে।

কিন্তু সেই লক্ষ্যের ক্ষেত্রেও মতবাদ এবং চলার পথ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য বেশ প্রকট। এমন প্রেক্ষপটে তারা আসলে কি করতে চায়-এই প্রশ্ন তোলেন বিশ্লেষকরা।

বরিশালের চরমোনাইর পীর হিসেবে পরিচিত সৈয়দ ফজলুল করিম ইসলামী আন্দোলন নামে দল গঠন করে রাজনীতিতে নেমেছিলেন জেনারেল এরশাদের আমলে ১৯৮৭ সালে।

নিবন্ধিত এই দলের প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যুর পর তার ছেলে সৈয়দ রেজাউল করিম এখন পীর এবং দলের নেতা হিসেবে কাজ করছেন।

প্রতিষ্ঠা থেকেই তিন দশকেরও বেশি সময়ে দলটিকে ক্ষমতাসীন বা বড় কোনো দলের সাথেই থাকতে দেখা গেছে।

তবে এই দলের মহাসচিব ইউনুস আহমদ বলেছেন, তারা নির্বাচনের মাধ্যমে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চান। সেজন্য দেশে সব পর্যায়ের নির্বাচনে পাখা প্রতীক নিয়ে তারা অংশগ্রহণ করেন।

“আমরা ইসলামের আদর্শে ইসলামের আলোকে প্রত্যেকটা সেক্টরকে সাজাতে চাই। আমরা বিশ্বাস করি, আত্মশুদ্ধি যতক্ষণ না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত দুর্নীতি অপরাধ, অন্যায় দূর হবে না।”

আরেকটি ইসলামপন্থী দল জাকের পার্টিও প্রতিষ্ঠার ৩০ বছর পার করেছে।

জেনারেল এরশাদের শাসনের সময়ই ১৯৮৯ সালে দলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ফরিদপুরের আটরশির পীর হিসেবে পরিচিত শাহ সুফি মো: হাসমতউল্লাহ।

তখনই তিনি তার ছেলে মোস্তফা আমীর ফয়সালকে চেয়ারম্যান করেছিলেন।

জেনারেল এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে জাকের পার্টি গোলাপ ফুল প্রতীক নিয়ে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৯টিতে প্রার্থী দিয়েছিল।

জাকের পার্টি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে রয়েছে।

দলটিতে এখন তৃতীয় প্রজন্মকে নেতৃত্বে আনা হচ্ছে। এর প্রতিষ্ঠাতার নাতি ড: সায়েম আমীর ফয়সালকে জাকের পার্টির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়েছে।

এই দলটির এখনকার নেতৃত্ব স্বাধীনতা বিরোধী এবং কট্টরপন্থী ইসলামী দলগুলোর বিরুদ্ধে একটা অবস্থান তৈরির চেষ্টার কথা বলছে।

ড: সায়েম আমীর ফয়সাল দাবি করেছেন, তাদের দল ইসলামপন্থী হলেও উদার এবং প্রগতিশীল চরিত্র নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভূমিকা রাখছে।

“জাকের পার্টি একমাত্র ইসলামী রাজনৈতিক দল একটা প্রগতিশীল দল। এটা আমি গর্বের সাথে বলতে পারি। আমি বিশ্বাস করি ইসলাম পরিপূর্ণভাবে সেকুলার। সবচেয়ে বড় উদাহরণ মদিনা চুক্তি। নবী করিম (সা:) যে মদিনা চুক্তি আমাদের দিয়ে গেছেন, এর চেয়ে বড় উদাহরণতো আর কোথাও নাই।”

“অবশ্যই ইসলাম প্রগতিশীল এবং অবশ্যই ইসলাম ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে। তো আমরা চাই, সাম্য কায়েম হবে। আমরা চাই, বিকৃত ইসলাম নয়, সত্য ইসলাম বাংলার জমিনে কায়েম হোক।”

পীরদের দলগুলোর মধ্যে শুধু তরিকত ফেডারেশন নামের একটি দলের নেতা সৈয়দ নজিবুল বাশার মাইজভান্ডারী বর্তমান সংসদে সদস্য হিসেবে যেতে পেরেছেন।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক হিসেবে তিনি নৌকা প্রতীকে চট্টগ্রামের একটি আসন প্রার্থী হয়েছিলেন।

এই তরিকত ফেডারেশনের নেতৃত্বও তাদের দলকে স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি হিসেবে তুলে ধরেন।

সৈয়দ নজিবুল বাশার মাইজভান্ডারী বলছিলেন, “আমরা আসলে সুফি মতবাদে বিশ্বাস করি। ইসলামের মুল থিমটাই হচ্ছে, মানবতার দর্শ, শান্তির ধর্ম।জঙ্গীবাদ এবং ইসলাম বা যে কোন ধর্মের নামে উগ্রতাকে আমরা না বলি। আমরা কেস করেছিলাম, জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের জন্য এবং আমরা জিতেছি। স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান পরিস্কার।”

তরিকত ফেডারেশন এবং জাকের পার্টি ইসলামপন্থী দল হলেও তারা ধর্মনিরপেক্ষ এবং উদারনীতির ভিন্ন রাজনীতির কথা বলছে।

আর চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন প্রচলিত ব্যবস্থা পাল্টিয়ে ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের অবস্থানকেই তুলে ধরছে।

তবে এই দলগুলোকে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির ওপর ভর করেই এখন রাজনীতির মাঠে থাকতে দেখা যায়।

জোবাইদা নাসরিন বলছিলেন, বাংলাদেশের মানুষ রাজনীতিতে এবং দেশ শাসনের ব্যাপারে ধর্মভিত্তিক দলকে সমর্থন করেনা। সেকারণে এসব দল বিকল্প শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে পারছে না বলে তিনি মনে করেন।

“পীরবাদী দলগুলোর এককভাবে রাজনৈতিক সমর্থন আছে, এটা আমি মনে করি না। আসলে বাংলাদেশে মিশ্র সংস্কৃতির ইতিহাস। বাংলাদেশের মানুষ মানবিক দিক থেকে অনেক বেশি সেকুলার। এখানে বহুত্ববাদের সংস্কৃতি আছে। ফলে মানুষ তাদের গ্রহণ করবে না বলে আমার মনে হয়।”

এই দলগুলোর নেতাদেরও অনেকে তাদের বিকল্প বা স্বতন্ত্র অবস্থান নিয়ে দাঁড়াতে না পারার বিষয়টি স্বীকার করেন।

কিন্তু একইসাথে তাদের বক্তব্য হচ্ছে, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রতি মানুষের সমর্থন বাড়ছে। এই পরিস্থিতি তাদেরকে নতুন করে ভাববার সুযোগ করে দিয়েছে বলে তারা মনে করেন।

ইসলামী আন্দোলনের নেতা ইউনুস আহমদ বলেছেন, এখনকার আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট কাজে লাগিয়ে তারা বড় দলগুলোর বাইরে বিকল্প শক্তি হিসেবে দাড়ানোর চেষ্টা করছেন।

তবে ইসলামী আন্দোলনসহ এমন অন্য দলগুলো তাদের অর্থনৈতিক চিন্তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন কর্মসূচি তুলে ধরে না।

এর পেছনে বিশ্লেষকরা অনেক কারণ দেখছেন। তারা বলছেন, রাজনীতিতে কোনভাবে একটা অবস্থান নিয়ে বড় দলগুলোর নজরে থাকা-এমন চিন্তার মাঝেই এই দলগুলো এখনও সীমাবদ্ধ রয়েছে।

এছাড়া পীর হিসেবে পাওয়া মানুষের সমর্থন রাজনীতিতে কাজে লাগানোর চিন্তা থেকে এই দলগুলো গঠন করেছিলেন এর নেতারা। কিন্তু রাজনীতিতে তা কাজ করেনি।

তরিকত ফেডারেশনের নেতা সৈয়দ নজিবুল বাশার মাইজভান্ডারী বলছিলেন, তারা এখনও সমমনাদের সাথে থেকে ঐক্যের ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।

বাংলাদেশে বড় দলগুলোও একক নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করে।

কিন্তু পীরদের দলগুলো আরও বেশি এক ব্যক্তি কেন্দ্রিক। সেজন্য এসব দল সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না বলে রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা মনে করেন।

জাকের পার্টির নেতা ড: সায়েম আমীর ফয়সাল অবশ্য অর্থনৈতিক কর্মসূচিসহ তাদের দলের কর্মকান্ডের ক্ষেত্রে কিছুটা প্রাতিষ্ঠানিক বা সাংগঠনিক ভিত্তি দেয়ার দাবি করছেন।

যদিও ইসলামপন্থী এই দলগুলো মনে করছে, ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতির প্রতি মানুষ এখন ঝুঁকছে এবং তারা ভোটের বা ক্ষমতার রাজনীতিতেও তারা একটা প্রভাব রাখতে পারছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, জামায়াতে ইসলামী ছাড়া ইসলামপন্থী অন্য দলগুলোর ভোটের হিসাব এখনও নগণ্য পর্যায়ে রয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলছিলেন, ধর্মের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। কিন্তু ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে মানুষ এখনও সেভাবে সমর্থন করছে না বলে তিনি মনে করেন।

“দেশে যখন কোনো পলিটিক্স না থাকে, যখন শূণ্যতা দেখা দেয়, মসজিদকে ঘিরে রাজনীতি করে, পীরদের ঘিরে পলিটিক্স করে। কিন্তু এদের কোনো ভবিষ্যত রাজনীতিতে আছে বলে আমি মনে করি না। যে রাজনীতি জনকল্যাণের রাজনীতি, তাতে তাদের ভবিষ্যত নাই।”

পীর বা তাদের বংশধরদের রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশে কাছাকাছি সময়ের মধ্যে একটা শক্তি হিসেবে দাঁড়াবে-এমন বিশ্বাস এখনও দলগুলোর নেতৃত্বের মাঝেও তৈরি হয়নি বলে মনে হয়েছে।

তবে দলগুলোর নেতারা মনে করছেন, বড় দলগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টিকারী একটা শক্তি হিসেবে একটা অবস্থান তারা করতে পেরেছেন।

এসএইচ-০৫/০৭/১৯ (কাদির কল্লোল, বিবিসি)