ছেলের মৃত্যুশোক ভুলতে যিনি বেওয়ারিশ লাশের সৎকার করেন

“একদিন এক পুলিশ অফিসারকে নদীতে একটি লাশ ছুঁড়ে ফেলতে দেখলাম। আমি দেখে সাংঘাতিক বিচলিত হয়ে পড়লাম”, বলছিলেন মোহাম্মদ শরিফ।

“সেদিন আমি নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করলাম, আজ থেকে আমিই হবো বেওয়ারিশ লাশের অভিভাবক। আমি বেওয়ারিশ লাশের সৎকার করবো।”

গত ২৮ বছর ধরে মোহাম্মদ শরিফ সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে চলেছেন। তার নিজের ছেলে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় নিহত হয়েছিলেন অযোধ্যায়। ছেলের লাশ কোনদিন তিনি খুঁজে পাননি।

উত্তর ভারতের অযোধ্যা শহরে অশীতিপর মোহাম্মদ শরিফকে সবাই ডাকেন ‘শরিফ চাচা’ বলে। তিনি জানিয়েছেন তার জীবনের ব্রত সম্পর্কে:

এই জীবনে ঠিক কত বেওয়ারিশ লাশ তিনি দাফন করেছেন, কত শবদেহ চিতায় পুড়িয়েছেন, তার হিসেব নিজের কাছেই নেই। অযোধ্যা ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের প্রধান অনুজ কুমার ঝা বিবিসিকে জানিয়েছেন, তারা কত বেওয়ারিশ লাশ মোহাম্মদ শরিফের হাতে তুলে দেন, সেই তথ্য তাদের কাছেও নেই।

“আমাদের অনুমান হচ্ছে প্রায় আড়াই হাজার লাশ হয়তো আমরা তার হাতে তুলে দিয়েছি”, বলছেন তিনি।

মোহাম্মদ শরিফের পরিবারের ধারণা তিনি হয়তো প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বেওয়ারিশ লাশের সৎকার করেছেন। কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যমে এই সংখ্যা ২৫ হাজার পর্যন্ত হতে পারে বলে বলা হচ্ছে।

নানা কারণে বেওয়ারিশ লাশের স্তুপ জমে ওঠে। কেউ হয়তো সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। কেউ রেল দুর্ঘটনায়। কেউ নিজের বাড়ি থেকে বহুদূরের কোন জায়গায় মারা গেছেন। তীর্থযাত্রী, অভিবাসী, সন্তান পরিত্যক্ত বৃদ্ধ- এরকম নানা মানুষের লাশ। হাসপাতালে মারা যাওয়া দরিদ্র মানুষ, যাদের লাশ সৎকার করার করার কেউ নেই।

এরকম লাশের সৎকার করা হয় বেসরকারি সংস্থা বা মোহাম্মদ শরিফের মতো স্বেচ্ছাসেবকের মাধ্যমে। কিন্তু এই কাজের জন্য ধন্যবাদ মেলে খুব কমই।

মোহাম্মদ শরিফের এই অসাধারণ কাজের কথা প্রথম জানা যায় ভারতে তাকে একটি মর্যাদপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সন্মাননা ‘পদ্মশ্রী’ দেয়ার পর।

‘শরিফ চাচা’র জন্য এই সন্মাননা এলো এক দীর্ঘ কষ্টসাধ্য জীবনের শেষপ্রান্তে।

মোহাম্মদ শরিফ জন্মের পরই তার মাকে হারিয়েছিলেন। বড় হয়েছেন দাদা-দাদীর কাছে। তাকে স্কুলে পাঠানোর সাধ্য তাদের ছিল না।

খুব অল্প বয়সে তাকে কাজে নেমে পড়তে হয়। কিভাবে বাইসাইকেল সারাই করতে হয়, সেই কাজ শিখেছিলেন। কিন্তু নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া এক বিয়োগান্তক ঘটনার পর পঞ্চাশোর্ধ জীবনে এসে সমাজসেবকের কাজে জড়িয়ে যান।

“আমার ছেলে যখন নিখোঁজ হয়ে গেল, তখন আমি তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম চারিদিকে। একমাস ধরে খুঁজেছি পাগলের মতো।”

১৯৯২ সালে ভারতে যে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়েছিল, তার বিরাট ধাক্কা লেগেছিল অযোধ্যায়। সেই দাঙ্গায় নিহত হন তার ছেলে মোহাম্মদ রইস।

“পুলিশ আমাকে বলেছিল, তার লাশ পচে গিয়েছিল। আমরা ওর লাশ দেখিনি। আমরা শুধু তার কাপড়-চোপড় পেয়েছিলাম।”

ভারতে এখন যে দলটি ক্ষমতায়, সেই ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বে হিন্দু মৌলবাদীরা ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে অযোধ্যায় ষোড়শ শতকে নির্মিত বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে ফেলে।

এই ঘটনার পর ‌ উত্তর ভারত জুড়ে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়। শত শত নিরীহ মানুষ সেই দাঙ্গায় মারা যান।

মোহাম্মদ শরিফ আজও জানেন না, তার ছেলেকে কে কোথায় কীভাবে হত্যা করেছে।

“আমার মনে হয়, অন্যদের লাশ যেভাবে নদীতে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে, আমার ছেলের লাশও হয়তো সেভাবে নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছিল।”

সেই সময় ভারতের অনেক জেলাতেই কোন মর্গ ছিল না। কাজেই বেওয়ারিশ লাশ এভাবে ফেলে দেয়াটাই ছিল নিয়ম। এরকম লাশ এমনিতে মাটি চাপা দেয়ার কথা। কিন্তু সময় এবং খরচ বাঁচাতে উত্তর ভারতে নদীতে লাশ ফেলে দেয়ার প্রচলনই বেশি ছিল।

“আমি প্রায় একমাস ধরে আমার ছেলের লাশ খুঁজে বেড়াই। কোথাও খুঁজে পেলাম না। এমনকী আমি পাশের শহর সুলতানপুরেও গিয়েছিলাম।”

শেষে তারা ধারণা করলেন, হয়তো মোহাম্মদ রইসের মরদেহ ৫০ কিলোমিটার দূরের গোমতি নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছে।

মোহাম্মদ রইসের অকাল মৃত্যু তার বাবা-মাকে সাংঘাতিক বিপর্যস্ত করে দিল। তার মা তীব্র বিষণ্নতায় আক্রান্ত হলেন। এ থেকে তিনি এখনো সেরে উঠতে পারেননি। ছেলের লাশকে যে ঠিকমত দাফন পর্যন্ত করতে পারেননি, এটি তাদের জন্য আরও বেশি মনোবেদনার কারণ হয়ে দাঁড়ালো।

কিন্তু এই মানসিক আঘাত মোহাম্মদ শরিফের জীবনে এক বড় বাঁক বদল ঘটিয়ে দিল। তিনি বেওয়ারিশ লাশ সন্মানজনকভাবে সৎকারের ব্যবস্থা করার অঙ্গীকার করলেন এবং সেই কাজে নেমে পড়লেন।

“আমি ঠিক করেছিলাম নিজের জেলায় কোন বেওয়ারিশ লাশ আমি নদীতে ছুঁড়ে ফেলতে দেব না”, বলছেন তিনি।

যে কাজ কেউ করতে রাজি নয়, তিনি সেই কাজটি করতে চান বলে জানালেন পুলিশকে।

“প্রথম যেদিন আমাকে এই কাজে ডাকা হলো, আমার বুক ধুক-পুক করছিল। পোস্টমর্টেমের পর পুলিশ আমাকে লাশ নিয়ে যেতে বললো। আমার পরিষ্কার মনে আছে ঐ লোকটির ঘাড় কাটা ছিল।”

লাশ সৎকারের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন মোহাম্মদ শরিফ। তার কাজের চাপ বেড়ে গেল। লাশ বহনের জন্য তখন তিনি চার চাকার একটি ঠেলাগাড়ি কিনলেন।

বেওয়ারিশ লাশ সৎকার নিয়ে তার এই ঘোর পছন্দ করছিল না পরিবার, বন্ধু-বান্ধব বা প্রতিবেশিরা।

“এটা নিয়ে কেউ খুশি ছিল না। সবাই বলতো, আমি পাগল হয়ে গেছি।”

ভারতের হিন্দুদের মধ্যে সবচেয়ে নিচু জাত বলে যাদের ভাবা হয়, তাদেরকেই কেবল এধরণের কাজ করতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু একজন মুসলিম হয়ে মোহাম্মদ শরিফ এরকম একটা কাজ বেছে নিয়েছেন, সেটা কেউ মানতে পারছিল না। তিনি রীতিমত একঘরে হয়ে পড়ার উপক্রম হলেন।

কিন্তু মোহাম্মদ শরিফ তার কাজ চালিয়ে গেলেন। তিনি কোন বিয়ে-শাদীর অনুষ্ঠানে যেতেন না, কোন উৎসব-পার্বনে যেতেন না। এমনকি নামাজ পড়তেও যেতেন না। এই যে তিনি সবকিছু তিনি ত্যাগ করেছিলেন শুধুমাত্র বেওয়ারিশ লাশের একটা সন্মানজনক সৎকারের জন্য। এটা তাকে মানসিক শান্তি দিত।

“নিজের ছেলের মৃত্যুর বেদনা ভুলতে এটি আমাকে সাহায্য করেছিল।”

“আমি আমার ছেলের কথা ভাবি সবসময়। তার কথা মনে পড়ে খুব।”

মোহাম্মদ শরিফ সাধারণত লাশ দাফন বা পোড়ানোর আগে সেটিকে গোসল করান। যদি তিনি বুঝতে পারেন যে মৃত ব্যক্তি মুসলিম, তখন তিনি লাশটি একটি কাপড় দিয়ে জড়িয়ে দেন। এরপর তিনি মৃতের জন্য দোয়া পড়েন।

যদি মৃত ব্যক্তি হিন্দু হন, তিনি মৃতদেহটি তার বাড়ি থেকে চার কিলোমিটার দূরে একটি জায়গায় নিয়ে গিয়ে দাহ করেন।

“যখনই পুলিশ আমাকে বেওয়ারিশ লাশ নেয়ার জন্য খবর দেয়, আমি সব কাজ ফেলে ছুটে যাই।”

সাধারণত কারও মৃত্যুর কয়েকদিন এমনকী কয়েকসপ্তাহ পর তিনি লাশটি পান।

পুলিশ লাশটির পরিচয় জানার চেষ্টা করে। কিন্তু কেউ যদি সেটি নিতে না আসে, তখন সেটি আর না রাখার সিদ্ধান্ত হয়। ততদিনে লাশে পচন ধরে যায়।

”অনেক সময় পুলিশ আমার সঙ্গে গোরস্থান পর্যন্ত আসে, তবে তারাও অনেক দূরে দাঁড়িয়ে থাকে।”

শরিফ বলেন, কখনো লাশ দেখে তার ঘেন্না হয় না। কিন্তু আর যে কোন মানুষের মতই গলিত মৃতদেহ দেখে তার মনে আঘাত লাগে। লাশ পচা গন্ধ তার ওপরও প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।

“কোন বিকৃত বা গলিত মৃতদেহ দেখার পর আমার ঘুমাতে কষ্ট হয়। আমি দুঃস্বপ্ন দেখি। তখন আমাকে ঘুমের বড়ি খেতে হয়।”

মোহাম্মদ শরিফ একা একাই এই কাজ করে গেছেন দশ বছর ধরে। সরকার বা কোন বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে কোন সাহায্য তিনি পাননি।

তবে এখন স্থানীয় দোকানদাররা তাকে কিছু অর্থ দেন লাশের সৎকারের খরচ হিসেবে। তার দুজন সহকারীও আছেন, তাদের বেতন দেয়া হয়।

“হিন্দু এবং মুসলিম, সবাই আমাকে সাহায্য করে। মানুষ আমাকে খাবার দেয়, কম্বল দেয়। সম্প্রতি আমার চোখের অপারেশন হয়েছিল। এক অপরিচিত মানুষ এসে আমাকে বিশ হাজার রুপি দিয়ে গেছে।”

মোহাম্মদ শরিফের বয়স হয়েছে, কিন্তু এই কাজের ভার যে আর কারও কাছে ছেড়ে দেবেন, সেরকম কেউ নেই। তার সন্তান বা তাদের ছেলেরাও এই কাজ করতে নারাজ।

তবে একই সঙ্গে তার সাইকেল সারাই এর দোকানটিও তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন। সেখান থেকে প্রতিদিন তার কিছু আয় আসে। সরকার তাকে যে সন্মাননা দিয়েছে, সেটি থেকে তার কোন আর্থিক লাভ হবে না, কিন্তু তার কাজের যে স্বীকৃতি মিলেছে, তাতেই তিনি খুশি।

কিন্তু এই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির পরও মোহাম্মদ শরিফ থামতে চান না। কারণ, তিনি জানেন, যদি তিনি এই কাজ বন্ধ করে দেন, তাহলে কী ঘটবে।

“যদি আমি না থাকি, পুলিশ আবার বেওয়ারিশ লাশ নদীতে ফেলে দেবে।” এটি তিনি মেনে নিতে পারেন না।

“আমি আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এই কাজ করে যেতে চাই।”

এসএইচ-০৪/১৬/২০ (স্বোয়ামিনাথন নটরাজন এবং খাদিজা আরিফ, বিবিসি)