বিদেশফেরত বাংলাদেশীদেরা নমুনা পরীক্ষার বাইরে থেকে যাচ্ছেন!

করোনাভাইরাস আক্রান্ত দেশগুলো থেকে গত সাতদিনে প্রায় ১ লাখ মানুষ বাংলাদেশে ফিরেছেন, কিন্তু তার মধ্যে কেউ সংক্রমণ নিয়ে দেশে ঢুকছেন কিনা, – তা জানার ব্যবস্থা কতটা সঠিকভাবে কাজ করছে?

সরকারি পরিসংখ্যানই বলছে, যে পরিমাণ বাংলাদেশী বিদেশ থেকে ফিরছেন – তার মধ্যে অতি নগণ্যসংখ্যককে পরীক্ষা করা হচ্ছে।

ফলে অনেকেই পরীক্ষার বাইরে থেকে যাচ্ছে কিনা – বিশেষজ্ঞরা সেই প্রশ্ন তুলছেন।

বাংলাদেশে সোমবার আরও তিন জনের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর জানানো হয়েছে এবং এ নিয়ে এ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আটজনে।

রোগতত্ত্ব, নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট বা আইইডিসিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের প্রতিদিন ১ হাজার জনের নমুনা পরীক্ষা করার সক্ষমতা আছে, কিন্তু বাস্তবে গড়ে প্রতিদিন মাত্র ১৫-২০ জনের পরীক্ষা হচ্ছে।

কর্মকর্তারা বলছেন, সোমবার মোট ২৭ জনের নমুনা পরীক্ষা হয়েছে এবং এ নিয়ে করোনাভাইরাস সংক্রমণ সন্দেহে এপর্যন্ত ২৬৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, করোনাভাইরাস আক্রান্ত দেশগুলো থেকে গত এক সপ্তাহেই প্রায় এক লাখ মানুষ দেশে এসেছেন, এবং এর সাথে তুলনা করলেও স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা নগণ্য।

করোনা আক্রান্ত দেশগুলো থেকে আসা মানুষ এবং তাদের সংস্পর্শে যারা এসেছেন, তাদের মধ্যেই নমুনা পরীক্ষা সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে।

কিন্তু করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া শুরু হয় এ বছর ২১শে জানুয়ারি, এবং তখন থেকে এপর্যন্ত ছয় লাখেরও বেশি লোক বাংলাদেশে এসেছেন। বিদেশ থেকে আসা এই বিশাল সংখ্যক মানুষের মাঝেই মাত্র ২৬৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যুক্তি হচ্ছে, উপসর্গ দেখা দেয়ার পরই পরীক্ষা করা হয় এবং সেজন্য সংখ্যাটা কম দেখা যাচ্ছে।

তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকে এতে একটা ঝুঁকি দেখছেন। তারা মনে করছেন, ১৬ কোটির বেশি মানুষের এই দেশে এখন ভিতরেই সংক্রমণ হচ্ছে কিনা-সেটাও জানা জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু নমুনা পরীক্ষা খুবই কম সংখ্যক বা সীমিত পর্যায়েই রয়ে গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন সীমিত পর্যায় থেকে বেরিয়ে ব্যাপক ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। কারণ, বিদেশ থেকে আসা লোকজনের বাইরে সংক্রমণ হচ্ছে কিনা, সেটা এখনও নিশ্চিত হওয়া না গেলে তা খারাপ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে বলে তারা মনে করেন।

রোগতত্ত্ব, নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান বলছিলেন, “আমরা যে ডেফিনিশনটা ব্যবহার করছি যে শুধু বিদেশ থেকে আসা মানুষের নমুনা পরীক্ষা করা হবে। এটা আমি বলবো খুবই ‘ন্যারো ফোকাসে’ করা হচ্ছে।”

তিনি আরও বলছেন, “আসলে আমাদের দেশের মধ্যে সার্কুলেশন হচ্ছে কিনা, এটাও কিন্তু বোঝার জন্য আরও কিছু পদ্ধতি আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলে থাকে, নিউমোনিয়ারও একটা ধাপ আছে, সেটারও পরীক্ষা করা উচিত ছিল। বলা হয়, সংক্রমণ কখনো থামানো যায় না, কিন্তু বিলম্বিত করা যায়। দেশের ভিতরে সংক্রমণের হারটা বুঝতে পারলে, পরিস্থিতি সামলাতে সুবিধা হতো।”

রোগতত্ত্ব, নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট ১৭টি হটলাইন চালু করেছে। সেখানে টেলিফোন করে কথা বললে অপরপাশ থেকে দু’টি প্রশ্ন করা হয়, সম্প্রতি বিদেশ থেকে এসেছেন কিনা, বা বিদেশ থেকে আসা কারও সংস্পর্শে ছিলেন কিনা?

এই দু’টি ঘটনা না ঘটলে শরীরে জ্বর বা কাশি থাকলেও এখন নমুনা পরীক্ষার প্রয়োজন নেই – হটলাইনে এই পরামর্শই দেয়া হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইরোলজি বিভাগের অধ্যাপক আফজালুন্নেসা বলছিলেন, এখন দেশের ভিতরেই সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, সেই পরিস্থিতিতে এক জায়গায় সীমাবদ্ধ না রেখে বড় বড় হাসপাতালগুলোতেও পরীক্ষা ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।

“এতদিন আমরা যেটা করেছি, বিদেশ থেকে যারা এসেছে, তাদের পরীক্ষা করেছি। এখন দেশের ভেতরেও জ্বর বা সর্দি কাশি হলে হলে পরীক্ষা করা প্রয়োজন।”

কর্মকর্তদের সাথে কথা বলে মনে হয়েছে, নমুনা পরীক্ষার নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ এখনই রোগতত্ত্ব, নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের বাইরে অতিরিক্ত কারও হাতে দিতে চাইছেন না।

কর্তৃপক্ষ দাবি করছেন, এখনও করোনা আক্রান্ত দেশগুলো থেকে আসা লোকজন এবং তাদের সংস্পর্শে থাকা মানুষের বাইরে সংক্রমণ হয়নি। সে কারণে নমুনা পরীক্ষার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে তারা আতংক ছড়াতে চাইছেন না।

পরীক্ষার জন্য গত কয়েকদিনে রোগতত্ত্ব, নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে গিয়েও অনেক মানুষ নমুনা পরীক্ষার করানোর জন্য ভিড় করেছেন। সেখানেই এতদিন রোগীকে গিয়ে নমুনা দিতে হয়েছে।

এই ইনস্টিটিউটের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেছেন, এখন থেকে তাদের ইনস্টিটিউটে গিয়ে নমুনা দেয়া যাবে না। হটলাইনে ফোন করে তথ্য দেয়া হলে তাদের লোকেরাই পরীক্ষার জন্য সন্দেহভাজন রোগীর বাড়িতে গিয়ে নমুনা নেবে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।

“আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, আইইডিসিআর এর আর নমুনা নেয়া হবে না। আপনারা এখানে নমুনা দিতে আসবেন না” – বলেন তিনি।

“আমাদের হটলাইন নাম্বারগুলোতে আপনারা যোগাযোগ করলে আমরা যে তথ্য পাবো – তার ভিত্তিতে আপনাদের বাড়িতে আমাদের টিম পৌঁছে যাবে নমুনা সংগ্রহের জন্য। এভাবেই এখন নমুনা সংগ্রহ করা হবে।”

অন্যদিকে, করোনাভাইরাস আক্রান্ত দেশগুলো থেকে আসা বাংলাদেশীদের কোয়ারেন্টিনে থাকার ‘পরামর্শ’ কতটা কার্যকর হচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠায় এখন বিদেশ থেকে আসা বাংলাদেশীদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন ‘বাধ্যতামূলক’ করা হয়েছে।

সোমবার মন্ত্রীসভার বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

গত দুই মাসে করোনাভাইরাস আক্রান্ত দেশগুলো থেকে ছয় লাখের বেশি প্রবাসী দেশে এসেছেন। সরকারি হিসাবে তাদের মাঝে দেশের ৬৪টি জেলায় ২হাজার ৩১৪ জন বাড়িতে বাড়িতে কোয়রেন্টিনে যান।

কিন্তু সেটা কতটা কার্যকর হচ্ছে – তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সে জন্যই বিদেশ থেকে আসা বাংলাদেশিদের বাড়িতে ১৪দিনে কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

এসএইচ-০৫/১৭/২০ (কাদির কল্লোল, বিবিসি)