করোনায় দ্বিতীয় ঢেউয়ে ওষুধের তীব্র সংকট

সম্প্রতি একটি পাবলিক ফেসবুক গ্রুপে সাজ্জাদ হোসেন মিনতি করে বলেন, ‘দয়া করে আমার কোভিড আক্রান্ত মায়ের জন্য অ্যাকটেমরা ৪০০ মিলিগ্রাম (টোসিলিজুমাব) ইনজেকশন খুঁজে পেতে সাহায্য করুন। তিনি বর্তমানে আইসিইউতে আছেন। দয়া করে সাহায্য করুন।’

গুরুতর অসুস্থ মায়ের জন্য তিনি এই ওষুধটি খুঁজছিলেন। এটি ‘অ্যাকটেমরা’ ও ‘রোঅ্যাকটেমরা’ নামে বিক্রি হয়ে থাকে। কিন্তু ঢাকার সব বড় ওষুধের দোকানে খুঁজেও তিনি এটি পাননি।

সাজ্জাদ বলেন, ‘এরপর আমি জানতে পারলাম, এই ওষুধ শুধুমাত্র আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট কিছু বিতরণ কেন্দ্র থেকে কেনা যায়। আমি সেখানেই যাই। কিন্তু যাওয়ার পর জানতে পারি যে তাদের স্টক শেষ হয়ে গেছে।’

সাজ্জাদের মতো আরও অনেকেরই মিনতিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভরে গেছে। কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে সংক্রমণের হার অনেক বেড়ে গেছে। এর সঙ্গে বেড়েছে গুরুতর রোগীর সংখ্যা। সার্বিক পরিস্থিতিতে, এই ইনজেকশনটি দেশের সবচেয়ে বেশি চাহিদাসম্পন্ন একটি ওষুধে পরিণত হয়েছে।

একদিকে রোগীর পরিবারের সদস্যরা মরিয়া হয়ে ওষুধটি খুঁজছেন, অপরদিকে চাহিদার তুলনায় সরবরাহের ঘাটতি থাকায় কিছু মানুষ অতিরিক্ত লাভ করার চেষ্টা করছেন।

৪০০ মিলিগ্রাম, ২০০ মিলিগ্রাম, ১৬২ মিলিগ্রাম ও ৮০ মিলিগ্রাম টোসিলিজুমাবের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য যথাক্রমে ৪৯ হাজার ২৪২ টাকা, ২৪ হাজার ৬২১ টাকা, ১৬ হাজার ৯২৩ টাকা ও নয় হাজার ৮৪৮ টাকা। আমদানিকারকের বিতরণ কেন্দ্রে রোগীরা খুচরা দামের চেয়ে কিছুটা কম দামে এটি সংগ্রহ করতে পারেন।

তবে কিছু অননুমোদিত বিক্রেতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামে এগুলো বিক্রি করছেন।

১২ এপ্রিল ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা অবৈধভাবে আমদানি করা টোসিলিজুমাব বিক্রি করার অপরাধে তিন জনকে গ্রেপ্তার করেন। তারা ইনজেকশটির প্রতিটি ভায়াল এক লাখ ৬০ হাজার টাকা দামে বিক্রি করছিলেন বলে জানিয়েছেন এক কর্মকর্তা।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ডা. মোহাম্মদ আকিব হোসেন সোমবার অভিযানটি পরিচালনা করেন।

তিনি বলেন, ‘ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে আমরা লক্ষ্য রাখছি যাতে বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে এ ওষুধগুলো পাওয়া যায়। আমরা আমাদের এই অভিযান অব্যহত রাখব যাতে ওষুধগুলো সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যেই বিক্রি হয়।’

সাজ্জাদের ভাগ্য ভালো ছিল। তিনি এমন একজনকে খুঁজে পান, যার ভাই করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তার কাছে একটি বাড়তি ইনজেকশন ছিল। সাজ্জাদ তার মায়ের জন্য প্রায় ৪০ হাজার টাকা দাম দিয়ে সেটি কিনে নেন।

গত বছরের ১৯ মার্চ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর প্রকাশিত জাতীয় করোনাভাইরাস নির্দেশিকা অনুযায়ী টোসিলিজুমাবসহ নয়টি ওষুধের সরবরার নিশ্চিত করতে ওষুধ আমদানি ও বিতরণের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়।

যদিও টোসিলিজুমাব কোভিড-১৯ এর চিকিৎসার জন্য তৈরি করা হয়নি এবং করোনাভাইরাস চিকিৎসার ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতার ব্যাপারটিও এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

টোসিলিজুমাবের নির্মাতা রোশ বাংলাদেশ লিমিটেডের মুখপাত্র বলেন, এই ওষুধটি মূলত রিউম্যাটয়েড আর্থারাইটিস (আরএ), সিস্টেমেটিক জুভেনাইল ইডিওপ্যাথিক আর্থ্রাইটিস, পলিআর্টিকুলার জুভেনাইল ইডিওপ্যাথিক আর্থ্রাইটিস ও জায়ান্ট সেল আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসার জন্য তৈরি করা হয়েছিল।

চীনে সর্বপ্রথম এটি কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হয়। গত বছরের ৩ মার্চ এটিকে চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের ইস্যু করা সপ্তম করোনাভাইরাস রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

গত বছর সুইজারল্যান্ডের ফার্মাসিউটিকাল প্রতিষ্ঠান রোশ ঘোষণা দেয়, শুরুতে এর কিছু কার্যকারিতা দেখা গেলেও এই ওষুধটি এককভাবে কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য উপযুক্ত বলে প্রমাণিত নয়। কোভিড-১৯ সংক্রান্ত নিউমোনিয়া রোগের চিকিৎসার জন্য এই ওষুধের ক্লিনিকাল ট্রায়াল চলছে।

সর্বশেষ কোভিড-১৯ চিকিৎসা নীতিমালা অনুযায়ী যেসব কোভিড-১৯ রোগীর ‘কোভিড-১৯ এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ চেস্ট ইমেজিং’, অথবা যাদের ‘শ্বাসযন্ত্রের পরিস্থিতি’ দ্রুত খারাপের দিকে যাচ্ছে (২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে যাদের প্রতি মিনিটে ছয় লিটারের বেশি অক্সিজেন দরকার হচ্ছে), অথবা যারা ভেন্টিলেশনে আছেন, শুধুমাত্র তাদের চিকিৎসার জন্য টোসিলিজুমাব ব্যবহার করা যাবে।

যখন গুরুতর রোগীদের ক্ষেত্রে সন্দেহ করা হয় যে তাদের সাইটোকাইন রিলিজ সিনড্রোম রয়েছে, তখন এই ইনজেকশনটি ব্যবহার করা যাবে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) মেডিসিন ও সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. ফরহাদ উদ্দিন হাসান চৌধুরী বলেন, ‘কিছু গুরুতর কোভিড-১৯ রোগী সংক্রমণের বিরুদ্ধে উচ্চ ইমিউন প্রতিক্রিয়া দেখান। যার কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার (ইমিউন সিস্টেম) নির্দিষ্ট কিছু প্রোটিন খুব বেশি পরিমাণে তৈরি হয়। এই অবস্থাকে সাইটোকাইন স্টর্ম বলা হয়। এটা প্রাণঘাতী হতে পারে।’

‘টোসিলিজুমাব হচ্ছে একটি ইমিউন-প্রশমনকারী ওষুধ। যেসব কোভিড রোগীর ক্ষেত্রে সন্দেহ করা হচ্ছে যে তারা সাইটোকাইন স্টর্মে আক্রান্ত, তাদের জন্য এটি ব্যবহার করা যেতে পারে। রোগীর বয়স ও ওজন অনুসারে ইনজেকশনের ডোজ ঠিক করতে হয়,’ বলেন তিনি।

তবে এই ওষুধটির কিছু গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। যা একজন কোভিড আক্রান্ত রোগীর জন্য খুবই মারাত্মক হতে পারে।

ডা. ফরহাদ বলেন, ‘টোসিলিজুমাব কিডনি ও লিভারকে আক্রান্ত করতে পারে। গুরুতর কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণেও শরীরের এ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এটি শরীরে সুপ্ত অবস্থায় থাকা যক্ষ্মাকে সক্রিয় করে তুলতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এসব কারণে এই ইনজেকশনটি সব গুরুতর রোগীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা উচিৎ না। অনেক গুরুতর কোভিড রোগী এর প্রয়োগ ছাড়াই চিকিৎসা নিয়ে সেরে উঠছেন।’

রোশের মুখপাত্র বলেন, টোসিলিজুমাব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাইটোকাইন রিলিজ সিন্ড্রোমের চিকিৎসার জন্য অনুমোদিত।

তিনি আরও বলেন, ‘এখন গবেষকরা বের করার চেষ্টা করছেন যে ওষুধটি কোভিড-১৯ এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে একই ধরণের ভূমিকা পালন করে কি না এবং সেই পরিস্থিতিতে অ্যাকটেমরা/রোঅ্যাকটেমরা ব্যবহার কতটুকু নিরাপদ ও কার্যকর।’

বাংলাদেশে টোসিলিজুমাবের সরবরাহ নিয়ে রোশের মুখপাত্র বলেন, ‘মহামারির সময় সারাবিশ্বেই অ্যাকটেমরার চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। এর বিভিন্ন অনুমোদিত ব্যবহারের পাশাপাশি অননুমোদিত কোভিড-১৯ এর চিকিৎসার জন্যেও এর চাহিদা বেড়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ ধরণের বায়োটেক পণ্যের উৎপাদন, বিতরণ ও সংরক্ষণ একটি জটিল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ কারণেই বিভিন্ন দেশে সরবরাহ সংকট দেখা দিয়েছে। আমরা জরুরি ভিত্তিতে নিজস্ব উৎপাদন ক্ষমতা ও সরবরাহ বাড়ানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছি। একইসঙ্গে আমরা অ্যাকটেমরা/রোঅ্যাকটেমরার উৎপাদনকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাইরের অংশীদারদের সঙ্গেও কাজ করছি।’

এসএইচ-৩৪/১৮/২১ (অনলাইন ডেস্ক, তথ্যসূত্র : দ্য ডেইলি স্টার)