শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হত্যাকাণ্ডের বেশিরভাগেরই বিচার হয়নি!

দেশে গত এক যুগে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৩৯টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে৷ এর বেশিরভাগেরই এখনো বিচার হয়নি৷

গত সপ্তাহে বুয়েটের ছাত্র আবরার হত্যা মামলার রায়ে বুয়েটের ২০ ছাত্রের ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়৷ আবরার হত্যা মামলার বিচার দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে হওয়ায় মামালার রায় দ্রুত এসেছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের৷ কিন্তু বাকি হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার প্রক্রিয়া কেন দীর্ঘ হচ্ছে?

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শুধু ১২ বছর নয়, ২০ বছর আগের হত্যাকাণ্ডের বিচারও এখনো ঝুলছে৷ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র সংগঠনগুলোর দ্বন্দ্বের কারণে যেমন হয়েছে তেমনি অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণেও হয়েছে৷ আসামিও হয়েছেন ছাত্ররা৷ ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এইসব মামলার সাক্ষী ছাত্র, শিক্ষক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা৷ যে কারণে মামলার সাক্ষী পাওয়া যায় না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা৷

তাছাড়া সাক্ষী পাওয়া গেলেও তাদের আদালতে হাজির করা কঠিন৷ আর আসামি ও ভিকটিম একই ছাত্র সংগঠনের হলে শেষ পর্যন্ত তা সমঝোতার পথে চলে যায়৷

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, গত ১২ বছরের দেশের ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়, তিনটি কলেজ ও একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে মোট ৩৯জন নিহত হয়েছেন৷ নিহতদের মধ্যে ৩৭জন ছাত্র৷ এইসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন মামলার সব আসামিই খালাস পেয়েছেন৷ আবরার হত্যাসহ চারটি মামলায় আদালতের রায়ে অভিযুক্তদের শাস্তি হয়েছে৷ তবে কোনো মামলায়ই সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায় পাওয়া যায়নি৷

ফলে কোনো দণ্ডই এখনো কার্যকর হয়নি৷

এই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বেশ কিছু হত্যাকাণ্ডের জন্য আলোচিত৷ আর ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধেই অভিযোগ বেশি৷ অভ্যন্তরীণ কোন্দলেও এই ছাত্র সংগঠনটির বেশি নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন৷ আছে ছাত্রদল ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের নামও৷

আবরার হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবু আব্দুল্লাহ বলেন, ‘‘বুয়েটের আবরার ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন ছাত্র হত্যার মামলা পরিচলনা করতে গিয়ে আমার নানা অভিজ্ঞতা হয়েছে৷ আবরার হত্যা মামলাটি ব্যতিক্রম৷ এটা নিয়ে দেশজুড়ে মানুষ কথা বলেছেন৷ ফলে সাক্ষী পেতে সমস্যা হয়নি৷ আর দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে মামলা হওয়ায় রায়ও দ্রত হয়েছে৷ এটা অন্য মামলার ক্ষেত্রে ঘটে না৷’’

তিনি বলেন, ‘‘প্রথমত, সাক্ষী পাওয়া যায় না৷ কারণ এই ধরনের মামলার সাক্ষী হলেন ছাত্র, শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয় এবং হলের কর্মচারী৷ তারা আসলে সাক্ষী দিতে চান না৷ বন্ধুর বিরুদ্ধে বন্ধু বা ছাত্রের বিরুদ্ধে ছাত্র সাক্ষী দেয় না৷ শিক্ষক, কর্মচারীরা সাক্ষী দেয়াকে ঝামেলা মনে করেন৷ তাই তারা সাক্ষী দেন না৷ একারণে বিচার তো দূরের কথা পুলিশ মামলার তদন্তই অনেক সময় শেষ করতে পারে না৷ আর যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের হাতে অন্য সংগঠনের নেতা-কর্মী খুন হলেও ভয়ে কেউ সাক্ষী দেয় না৷ একই সংগঠনের ভিতরে হলে শেষ পর্যন্ত সমঝোতার পথে যায়৷’’

তিনি জানান, ১৯৯২ এবং ২০০৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুইটি হত্যা মামলার এখনো বিচার হয়নি৷ একটি মামলায় সাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে না৷ আরেকটি মামলায় সাক্ষীরা আদালতে আসলেও উল্টো সাক্ষী দেয়৷ ফলে উচ্চ আদালত বিচার কাজ স্থগিত করে দিয়েছে৷

সাবেক বিচারক এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু বলেন, ‘‘রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মামলা এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা তদন্তকারী ও বিচারক সবার মধ্যেই আছে৷ তারা ঝামেলায় যেতে চান না৷ আর এর সঙ্গে আছে রাজনৈতিক প্রভাব৷ দীর্ঘ সময় বিরতি দিয়ে মামলার তারিখ ফেলে বছরের পর বছর সময়ক্ষেপণ করা হয়৷ এরমধ্যে সাক্ষীরা এবং বাদিরাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন৷ প্রসিকিউশনেরও অদক্ষতা আছে৷ সব মামলা তো আর দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে যায় না৷’’

আর আবু আব্দুল্লাহ বলেন, ‘‘মামলা দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর এখতিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের৷ আদালতের নয়৷ এর জন্য আবেদন করতে হয়৷ ট্রাইব্যুনালে তিন সপ্তাহের মধ্যে মামলার তারিখ ফেলার বিধান আছে৷ অন্য আদলতের তো সেই বাধ্যবাধকতা নেই৷’’

এসএইচ-০২/১৩/২১ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)