আজও অবহেলিত প্রবীণদের অধিকারের বিষয়টি

মানুষের গড় আয়ুর সঙ্গে সঙ্গে বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকের সংখ্যা বাড়লেও দিনে দিনে তলানিতে ঠেকছে প্রবীণের অধিকারের বিষয়টি। বর্তমানে দেশের অনেক প্রবীণ পুষ্টিহীনতার ঝুঁকিতে থাকলেও সেই অর্থে মাথাব্যথা নেই রাষ্ট্র কিংবা পরিবারের। এমন অবস্থা উদ্বেগজনক উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রবীণ অধিকার নিশ্চিতে সচেতনতার পাশাপাশি সময় এসেছে পারিবারিক ব্যবস্থা পুনর্বিন্যাসের।

রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা আরিফুর রহমানে দিনের শুরুটা হয় পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে। দেশ ও বিশ্বের নানা প্রান্তের খবরেও একটা সময় ভর করে ক্লান্তি। তখন একমাত্র ভরসা জানালা। সেখানে হয়তো মেলে কিছুটা প্রাণের স্পন্দন। কিন্তু খুব কাছে থেকেও দূরত্ব যেন যোজন-যোজন।

তিন রুমের ফ্লাট বাসায় সন্তান, নাতি, নাতনিসহ বসবাস ছয় সদস্যের। অথচ দিনের বড় একটি অংশই চার দেওয়ালে বন্দিজীবন ৮০ বছরের বৃদ্ধ আরিফুর রহমান ও ৬৫ বছরের স্ত্রী হাসিনা আরিফের। জীবনের পড়ন্ত বেলায় যেন রাজ্যের নিঃসঙ্গতা।

আরিফুর রহমান বলেন, খবরের কাগজ এবং বই- এই দুটিই এখন আমার সঙ্গী। মাঝে মাঝে মন চায়, আগের মতো যদি একা একা বের হয়ে বাইরে থেকে ঘুরে আসতে পারতাম!

স্ত্রী হাসিনা আরিফ বলেন, ছেলে সকালে চলে যায়, রাত ৮টার পর বাসায় ফেরে। খাবারের সময়টা তাদের সঙ্গে মেলানো যায় না। বাচ্চাদের খাওয়ার সময়টা হয় এক সময়ে আর আমাদেরটা হয় আরেক সময়।

বয়স্ক বাবা-মায়ের নিঃসঙ্গতা তো দূরের কথা, খাওয়া-দাওয়া নিয়েও খুব একটা ভাবনার সময় নেই সন্তানদের।

এই দম্পতির ছেলে বলেন, কোনো না কোনো কারণে আমাকে অনেক রাত করে বাড়িতে ফিরতে হয়। বাবা ততক্ষণে হয়তো জেগে থাকেন না। সকালে যখন অফিসে যাই, তখনো হয়তো বাবা-মা ঘুমিয়ে থাকেন। এ জন্য আমি হয়তো তাদের খোঁজ নিয়ে যেতে পারি না। তো আসলে হয়ে উঠে না। এটাই বাস্তবতা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, দেশের এক চতুর্থাংশ প্রবীণ ভুগছেন অপুষ্টিতে। এই অপুষ্টির হার তুলনামূলকভাবে পুরুষের চাইতে নারীদের মাঝে বেশি। এর কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়েছে, বিষন্নতা, মানসিক অসুস্থতা, অক্ষমতা, মুখগহ্বর ও দাঁতের সমস্যাসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়াকে।

বিএসএমএমইউর পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সায়েন্টিফিক কো-অর্ডিনেটর ডা. কে এম তৌহিদুর রহমান বলেন, এমনও হয়ে থাকে যে কোনো কোনো কারণে বয়স্কদের কিছু খাবার গ্রহণে নিরুৎসাহিত করা হয়ে থাকে যেন অন্যান্য অসংক্রামক রোগ তাদের না হয়। কিন্তু এই খাদ্যক্রম গ্রহণ কিন্তু তাদের আবার অপুষ্টির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাদের দাঁত নড়বড়ে কিনা অথবা তাদের মুখে কোনো ঘা আছে কিনা- এই বিষয়গুলোতে হয়তো খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অপুষ্টিতে ভোগার কারণে তাদের রোগ কিন্তু দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এটির প্রভাব কিন্তু শুধু ওই মানুষটির ওপরই না, বরং তার পরিবার এবং সমাজের ওপর পড়ছে।

দেশে বর্তমানে ষাটোর্ধ্ব প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি, পারিবারিক ব্যস্ততা, অসচেতনতাসহ নানা কারণে দিনে দিনে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছেন প্রবীণরা। নিসঙ্গতা, পুষ্টিহীনতা দূর করাসহ সুস্বাস্থ্যের জন্য সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

রিসোর্স ইন্টিগ্রেশন সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক আবুল হাসিব খান বলেন, অধিংকাংশ প্রবীণ বিষণ্ণতায় ভোগে। সেখান থেকে ডিমেনশিয়া- অ্যালজেইমার হয়। এতে শেষ বয়সে তাদের খুবই কষ্ট করতে হয়। এখানে একটা একাকিত্বের ফাঁদ তৈরি হচ্ছে। এটা ক্রমাগত হচ্ছে। একজন ব্যক্তি যে সারা জীবন এত কিছু করলেন, তিনি একটা সময় একা হয়ে যান। তার ছেলেমেয়েও একটা সময় একই ফাঁদে পড়বে।

প্রবীণ মানেই বোঝা নয়, অক্ষমতা নয়। বরং নিজের দীর্ঘদিনের জ্ঞান, প্রজ্ঞা আর অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন তারা। রাজধানীর মিরপুরের কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তি যেন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

তারা বলেন, হাতে গোনা ২-৪ জন বাদে সবাই আমরা সামাজিকভাবে কোনো না কোনো কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছি। এর ফলে আমাদের মাজে একাকিত্ববোধটা আসে না। যারা সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকেন, তাদের কখনো নিঃস্ব মনে হয় না। আমরা কখনোই একাকিত্ব অনুভব করি না।

বয়োজ্যেষ্ঠদের অধিকার নিশ্চিত করা মানে নিজের নিশ্চিত ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা। একাকিত্ব বা নিঃসঙ্গতা নতুন এক সামাজিক মহামারি। যার প্রভাবে প্রবীণদের মানসিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি দেখা দিতে পারে নানা শারীরিক বিপর্যয়। অথচ, পরিবারের বাকি সদস্যদের সামান্য একটু মনোযোগ, একটু সচেতনতা বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষকে মুক্তি দিতে পারে একাকিত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি।

এসএইচ-০৩/২৯/২২ (অনলাইন ডেস্ক, সূত্র : সময়)