দেশের অভ্যন্তরীণ গ্যাস অনুসন্ধানে কার্যকর উদ্যোগ নেই?

দেশে অব্যাহত জ্বালানি সংকটের মাঝে অভ্যন্তরীণ গ্যাস অনুসন্ধান বা উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কী করা হচ্ছে – সেদিকে নুতন করে সবার নজর পড়ছে।

জানা গেছে, ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে গ্যাস অনুসন্ধানে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেই।

বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলেছেন, গ্যাস উৎপাদন না বাড়ানোর ফলে এই খাত আমদানি-নির্ভর হয়ে পড়েছে, আর এখন বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় তৈরি হয়েছে তীব্র সংকট ।

ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে বিশ্ববাজারে চড়া দামের কারণে বাংলাদেশ সরকার এখন খোলাবাজার থেকে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি আমদানি বন্ধ রেখে গ্যাস রেশনিং এবং বিদ্যুতের লোডশেডিং করাসহ ব্যয় সাশ্রয়ের বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে।

দেশের উত্তর-পূর্বে হবিগঞ্জে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র উৎপাদনে আসে ১৯৯৮ সালে। এর পর দেশে আর বড় কোন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়নি।

বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে গ্যাস অনুসন্ধানও কার্যত বন্ধ রয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাপেক্স-এর মাধ্যমেও গ্যাস অনুসন্ধানে কার্যকর কোন পদক্ষেপ ছিল না।

এনার্জি অ্যাণ্ড পাওয়ার নামের জ্বালানি বিষয়ক একটি সাময়িকীর সম্পাদক মোল্লাহ আমজাদ হোসেন বলছেন, এখন উৎপাদনে থাকা গ্যাসক্ষেত্রগুলোর মজুদ বছর সাতেকের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।

তা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ গ্যাস অনুসন্ধান প্রায় বন্ধ রেখে এলএনজি আমদানির দিকেই বেশি ঝুঁকেছিল। সেকারণে আমদানি-নির্ভর এই জ্বালানি খাত এখন চরম সংকটে পড়েছে বলে মি: হোসেন মনে করেন।

“এলএনজি আমদানির জন্য কর্তৃপক্ষ যত দ্রুত এগিয়েছে, গ্যাস অনুসন্ধান বা উৎপাদন বাড়ানোর ব্যাপারে সেভাবে এগোয়নি। অনুসন্ধান কাজে বা উৎপাদন বাড়াতে বাপেক্স না পারলে বিদেশি কোম্পানি আনা, সেটাও করা হয়নি”- বলেন মোল্লাহ আমজাদ হোসেন।

হোসেন মনে করেন, বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান বা উৎপাদন বাড়ানো বন্ধ রাখার ক্ষেত্রে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অবহেলা ছিল এবং এক পর্যায়ে রাশিয়ার কোম্পানি গ্যাজপ্রম ছাড়া শেভরনের মত অন্য বিদেশি কোম্পানিগুলোও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল।

সরকারি প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে দিয়ে গ্যাস অনুসন্ধান এবং উৎপাদন বাড়ানোর কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু বাপেক্স দূ’টি কূপ খনন করে গ্যাস পায়নি এবং বিষয়টিকে কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময় উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরে থাকে।

কর্মকর্তাদের মতে, কর্তৃপক্ষের মধ্যে তখন এমন একটা মনোভাব ছিল যে “কূপ খনন করে যখন গ্যাস পাওয়া যায়না, তখন বড় অংকের অর্থ ব্যয় করে ঝুঁকি নেয়াটা সঠিক হবে না ।”

জ্বালানি খাত বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের অধ্যাপক এজাজ হোসেন বলেন, গ্যাস অনুসন্ধান কেন দুই যুগ ধরে বন্ধ রাখা হয়েছে এই প্রশ্নের কোন জবাব তিনি কখনো পাননি।

“গ্যাস অনুসন্ধান বন্ধ করে দেয়াটা আমাদের কাছে পরিস্কার নয়।”

কর্তৃপক্ষের হিসাবে দেখা যাচ্ছে, দেশে গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে দৈনিক উৎপাদন কমে ২৩০০ ঘনফুটে এসে ঠেকেছে।

এরসাথে দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির আওতায় কাতার এবং ওমান থেকে ৫০০ ঘনফুট গ্যাস পাওয়ার পরও চাহিদার বিপরীতে ৭০০ ঘনফুট ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।

বিশ্ববাজারে চড়া দামের কারণে খোলাবাজার বা স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ রাখায় এখন সংকট বেড়ে গেছে।

এই সংকটের মুখে কর্তৃপক্ষ বাপেক্সকে দিয়ে চার বছরে ৪৬টি গ্যাসকূপ খননের পরিকল্পনা নেয়ার কথা বলছে।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বলেছেন, গ্যাস অনুসন্ধানের উদ্যোগ তাদের আগেও ছিল এবং এখন তা তারা জোরদার করছেন।

“একটি পরিকল্পনা আমরা দাঁড় করিয়েছি। আমাদের যে কূপগুলো অল্প সময়ের মধ্যে খননযোগ্য, এমন ৪৬টা কূপ আমরা চার বছরের মধ্যে খনন করবো।”

আহসান উল্লেখ করেন, এই কূপগুলো খনন করা সম্ভব হলে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস পাওয়া যাবে বলে তারা বলে আশা করছেন।

মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে যে বিরোধ ছিল তা মিটে যায় ২০১২ সালে। কিন্তু তার পর এত বছরেও বঙ্গোপসাগরে গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করা হয়নি।

সমুদ্রে মাত্র একটি ব্লকে ভারতীয় একটি কোম্পানি জরিপ এবং অনুসন্ধানের কাজ করছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উৎপাদন অংশীদারিত্বের চুক্তির ক্ষেত্রে গ্যাসের মূল্য যথাযথ প্রস্তাব করা হয়নি এবং সেকারণে বিদেশি কোন কোম্পানি এগিয়ে আসছে না।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মি: আহসান বলেছেন, বিদেশি কোম্পানিকে আকৃষ্ট করার জন্য এখন অংশীদারিত্বের চুক্তির প্রস্তাবও সংশোধন করা হচ্ছে।

“সাগরে গ্যাস উত্তোলনের ব্যাপারে উৎপাদন অংশীদারিত্বের যে চুক্তি আছে, সেটি রিভিউ করা হচ্ছে বিদেশি তেল কোম্পানিকে আকৃষ্ট করার জন্য” – বলেন তিনি।

আহসান বলেছেন, এই রিভিউ দ্রুত শেষ করে এ বছরের মধ্যে বিডিংয়ের প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে বলে তারা মনে করছেন।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান দাবি করছেন, এ বছরের মধ্যেই গ্যাস অনুসন্ধান এবং উৎপাদন বাড়ানোর কাজ জোরশোরে তারা এগিয়ে নিতে পারবেন।

তবে বাস্তবতা হচ্ছে এই যে প্রায় দুই যুগেও বিদেশি কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশে আকৃষ্ট করা যায়নি – বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

এসএইচ-০১/২৬/২২ (কাদির কল্লোল, বিবিসি)