দেশের গ্যাসের মজুদ শেষ হয়ে যাবে ৯ বছরের মধ্যে!

সে প্রায় আড়াই দশক আগের কথা, যখন বলা হয়েছিল ‘বাংলাদেশ প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর ভাসছে’। অর্থাৎ সোজা বাংলায় দেশের খনিগুলোতে মজুদ থাকা গ্যাসের পরিমাণ এত বিপুল যে তার ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশ নিজে চুলায় দেয়া কিংবা গাড়ি চালানো কিংবা শিল্প-কারখানায় গ্যাস দিয়ে রপ্তানিও করতে পারে।

তার দেড় দশকের মধ্যেই বাংলাদেশকে গ্যাস আমদানি শুরু করতে হয়েছে।

কিন্তু বাংলাদেশে গ্যাসের মজুদ আসলে কত আছে? আর সে গ্যাস দিয়ে কতদিন চলা সম্ভব হবে?

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান হাইড্রোকার্বন ইউনিটের মহাপরিচালক আবুল খায়ের মোহাম্মদ আমিনুর রহমান বিবিসিকে বলেছেন, এই মুহূর্তে দেশে আবিষ্কৃত গ্যাসের পরিমাণ মোট ২৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট বা টিসিএফের চাইতে কিছু বেশি।

তিনি বলেন, “আবিষ্কৃত ২৮ টিসিএফের মধ্যে ১৯৬৫ সালে আবিষ্কার হওয়া গ্যাসও আছে। কিন্তু যেহেতু প্রতিদিনই আমরা গ্যাস খরচ করছি, সে কারণে খরচ হওয়া অংশ বাদ দিয়ে আমাদের মজুদের পরিমাণ নয় দশমিক শূন্য ছয় টিসিএফ।”

আবিষ্কৃত গ্যাসের পরিমাণ নির্ধারণের বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মি. রহমান বলেছেন, কূপ খনন করার পর সিসমিক জরিপের ফল এবং সেখানকার গ্যাসের চাপের ওপর নির্ভর করে ওই কূপে গ্যাসের মোট পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়।

আবিষ্কৃত গ্যাসের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে মূলত তিন ধরণের মজুদ হিসাব হয়–প্রমাণিত মজুদ, উত্তোলনযোগ্য মজুদ এবং সম্ভাব্য মজুদ।

সরকারি যে প্রতিষ্ঠানটি খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধান, উত্তোলন, পরিশোধন এবং বাজারজাত করার কাজ করে সেই পেট্রোবাংলার ওয়েবসাইটে দেয়া ২০২২ সালের জুলাই মাসের তথ্য বলছে, দেশে প্রমাণিত, উত্তোলনযোগ্য আর সম্ভাব্য মিলে মোট মজুদের পরিমাণ ৩০ দশমিক ১৩ টিসিএফ।

এর মধ্যে আবিষ্কৃত ২৮ টিসিএফ গ্যাসের মধ্যে এ পর্যন্ত ব্যবহার করা প্রাকৃতিক গ্যাসের পরিমাণ সাড়ে ১৯ টিসিএফের বেশি।

পেট্রোবাংলার ৩০শে অক্টোবরের দৈনিক গ্যাস উৎপাদন রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ২৮টি গ্যাসক্ষেত্রে মোট ৭০টি কূপ রয়েছে, এর মধ্যে ৬৯টি কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে।

এর মধ্যে দেশি প্রতিষ্ঠান বাপেক্স, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড বিজিএফসিএল এবং সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড এসজিএফএল গ্যাস উত্তোলন করছে।

এর বাইরে দুইটি বহুজাতিক তেল কোম্পানি বা আইওসি শেভরন ও তাল্লো চারটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উৎপাদন করছে।

তবে এ বছরই বঙ্গোপসাগরের মহীসোপান এলাকায় বিপুল গ্যাসের মজুদের যে সম্ভাবনার তথ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিয়েছে, তা এখন পর্যন্ত মজুদের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

এদিকে, গ্যাস কূপগুলো থেকে প্রতিবছরই উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের পরিমাণ কমছে।

হাইড্রোকার্বন ইউনিটের তথ্য থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালে দেশে প্রতিদিন ২৬৬৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হতো, যা ২০২১ সালে এসে ২৩৫২ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে যায়।

হাইড্রোকার্বন ইউনিটের মহাপরিচালক মি. রহমান বলেছেন, বর্তমানে যে মজুদ আছে তা দিয়ে আগামী নয় বছর চলা যাবে।

“মানে যদি নতুন কোন গ্যাসক্ষেত্র থেকে আর গ্যাস না পাওয়া যায়, তাহলে এই মজুদ দিয়ে আরো নয় বছর চলা যাবে। কিন্তু আগামী নয় বছরের মধ্যে নতুন গ্যাস উত্তোলন হবে না বা নতুন মজুদ বাড়বে না, অতটা নৈরাশ্যবাদী আমরা নই, আর সে আশংকাও নাই।”

রহমান বলেছেন, প্রতিবছরই নতুন কূপ যুক্ত হচ্ছে।

এই মুহূর্তে বাপেক্সের মাধ্যমে নতুন গ্যাসক্ষেত্রের অনুসন্ধান চলছে। এবং এখন বাপেক্স ভোলা এবং সিলেট অঞ্চলে মোট ছয়টি নতুন কূপ খননের কাজ করছে বলে তিনি জানিয়েছেন।

কিন্তু বাংলাদেশে বছরে এক ট্রিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস ব্যবহার হয়।

বাংলাদেশে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ৩৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট, কিন্তু উৎপাদন হয় ২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট।

গ্যাসের মোট উৎপাদনের ৪০ শতাংশ যায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের পেছনে।

বিশেষজ্ঞ এবং সরকারি কর্মকর্তা সকলেই বলছেন, গ্যাসের এত বিপুল মজুদ বাংলাদেশে কখনোই আবিষ্কৃত বা প্রমাণিত হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক বদরুল ইমাম জানিয়েছেন, মূলত কথাটি এসেছিল ১৯৯৭ সালে ইউনিকল নামে একটি কোম্পানি যারা বিবিয়ানায় একটি বড় গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে সেসময়।

তখন বাংলাদেশে গ্যাসের তেমন চাহিদা ছিল না, ফলে ওই প্রতিষ্ঠানটি চেয়েছিল বাংলাদেশ সরকার যাতে সেখান থেকে পাওয়া গ্যাস রপ্তানি করে।

অধ্যাপক ইমাম জানিয়েছেন, সেসময় ওই কোম্পানি সরকারকে ‘কনভিন্স’ করার জন্য এই প্রচারণা চালায় যে দেশে এত গ্যাস আছে যে ‘বাংলাদেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে’।

কিন্তু সেসময় গ্যাস রপ্তানির বিরুদ্ধে দেশে প্রতিবাদের মুখে সরকার সে সিদ্ধান্ত নেয়নি।

অধ্যাপক ইমাম বলছেন, “যদিও বাংলাদেশ একটি বদ্বীপ এবং বদ্বীপ এলাকা সাধারণত গ্যাসসমৃদ্ধ হয়ে থাকে। কিন্তু গ্যাসের ওপর ভাসার মত মজুদ বাংলাদেশে কখনো প্রমাণিত হয়নি বা আবিষ্কৃত হয়নি।”

বাংলাদেশে গ্যাসের মজুদ যে নিম্নগামী সে সম্পর্কে কয়েক বছর আগে থেকে পেট্রোবাংলা তাদের পূর্বাভাসে দেখিয়ে আসছে।

কিন্তু তা সত্ত্বেও নতুন গ্যাস অনুসন্ধানের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।

তবে পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি বছরে নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে আগামী চার বছরে ৪৬টি কূপ খনন করে গ্যাস অনুসন্ধান চালানো হবে।

এই ৪৬টি কূপের মধ্যে অনুসন্ধান কূপ, উন্নয়ন কূপ এবং ওয়ার্কওভার অর্থাৎ আগে খনন করা কূপে নতুন অনুসন্ধান চালানোর কথা রয়েছে।

এ প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন করে দিনে ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস উৎপাদন না বাড়ানোর ফলে এই খাত আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে, আর সে কারণেই এখন বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় তৈরি হয়েছে তীব্র সংকট ।

এদিকে, এ বছরের জানুয়ারিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায় যে, নতুন গবেষণায় তারা বঙ্গোপসাগরে ১৭ থেকে ১০৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস হাইড্রেটের সন্ধান পেয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলছেন, ২০১২ সালে মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ার পর দেশটি সাগরে তাদের অংশে গ্যাসের অনুসন্ধান এবং উত্তোলনে ব্যাপক বিনিয়োগ করে।

ফল হিসেবে তারা এখন সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ গ্যাস উত্তোলন করে নিজেরা ব্যবহারের পর চীনে রপ্তানিও করছে।

কিন্তু বাংলাদেশে সে কাজটি গত ১০ বছরেও হয়নি বলে বলছিলেন অধ্যাপক ইমাম।

তিনি বলেছেন, বর্তমানে বিশ্ববাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং সংকটের মুখে অনাবিষ্কৃত এ ক্ষেত্রটিতে দ্রুত অনুসন্ধান শুরু করা প্রয়োজন, একমাত্র তাহলেই জ্বালানি খাতে স্বস্তি পাওয়া সম্ভব।

এসএইচ-০৬/০১/২২ (সাইয়েদা আক্তার, বিবিসি)