জেলহত্যান্ড পরবিবারের সদস্যরা যেভাবে জেনেছিলেন

আওয়ামী লীগের চারজন সিনিয়র রাজনীতিককে হত্যার পর ৪৭ বছর পেরিয়ে গেছে । ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল ঢাকার কারাগারে।

তৎকালীন আওয়ামী লীগের চারজন সিনিয়র নেতা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে হত্যা করা হয়েছিল ।

দিনটি এখন জেল হত্যা দিবস হিসাবে পালিত হয়।

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব যখন অনেকটা দিশেহারা, সে সময় দলের গুরুত্বপূর্ণ এই চার নেতাসহ অনেককে বন্দি করা হয়েছিল।

ঢাকার কারাগারে ঐ চার রাজনৈতিক নেতার হত্যাকাণ্ড নিয়ে সেদিন নানা গুজব ছড়িয়েছে দিনভর। তাদের পরিবারের সদস্যদের দিনটি কেটেছে শঙ্কা আর উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে।

কারাগারে পাগলাঘণ্টা বেজেছিল ভোরে এবং কিছু একটা ঘটেছে সেখানে- এ ধরনের নানা খবর আসছিল পরিবারগুলোর কাছে।

পরিবারগুলোর সদস্যদের অনেকে ছুটে গেছেন কারাগারের সামনে, কিন্তু সেই ৩রা নভেম্বর হত্যাকাণ্ডের নিশ্চিত কোন খবর তারা জানতে পারেননি।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী মুজিবনগর সরকারে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ।

জেলাখানায় যে চারজনকে হত্যা করা হয়, তাদের একজন মি: আহমদ।

তিনি ঢাকার ধানমন্ডিতে সাত মসজিদ রোডের বাড়িতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বসবাস করতেন। সেই বাড়ি থেকেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর ২২শে অগাষ্ট।

তাজউদ্দীন আহমদকে হত্যার ঘটনার পরদিন ৪ঠা নভেম্বর সেই খবর জানতে পেরেছিল তাঁর পরিবার ।

আহমদের বড় মেয়ে সিমিন হোসেন রিমি তখন নবম শ্রেণিতে পড়তেন। তিনি এখন আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় সংসদের একজন সদস্য।

৭৫ এর ৩রা নভেম্বর সারাদিনের উৎকণ্ঠা এবং পরদিন হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া, সবকিছুই সিমিন হোসেন রিমির স্মৃতিতে রয়েছে।

তিনি জানিয়েছেন, জেলে হত্যার ঘটনার আগের রাতে সাত মসজিদ রোডের বাড়িতে এক বিছানায় ঘুমিয়েছিলেন তিনি এবং তাঁর মা আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন। তাঁর বাকি দুই বোন ও এক ভাই ছিলেন অন্য ঘরে।

হত্যাকাণ্ডের দিনে ৩রা নভেম্বর ভোরে যুদ্ধ বিমানের শব্দে তাঁদের ঘুম ভেঙে যায়। তখন তাঁর মা বিচলিত হয়ে বার বার বলছিলেন, জেলখানায় কিছু ঘটলো কীনা? কারণ তাজউদ্দীন আহমদ গ্রেফতার হওয়ার পর জোহরা তাজউদ্দীন দেখা করতে গেলে মি: আহমদ তাঁকে হত্যা করা হতে পারে-এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।

কিন্তু তারা বাইরে কোনো খোঁজ খবর নিতে পারছিলেন না। কারণ তাদের বাসার টেলিফোন লাইন কেটে দেয়া হয়েছিল ৭৫ এর ১৫ই অগাষ্ট শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর। এছাড়া তাদের ওপর নজরদারী ছিল।

সিমিন হোসেন রিমি বলেছেন, ৩রা নভেম্বর সারাদিন তাদের কেটে যায় নানা গুজবে । কিন্তু কিছুই জানতে পারেননি।

পরদিন ৪ঠা নভেম্বর সকাল ১১টার দিকে তারা জানতে পারেন যে, ৩রা নভেম্বর ভোরে ফজরের নামাজের আজানের সময় কারাগারে অনেক গোলাগুলি হয়েছে।

তাদের বাসায় এসে এই খবর জানিয়েছিলেন পুরোনো ঢাকায় তৎকালীন কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশের টিপু সুলতান রোডের একজন বাসিন্দা।

কারাগারে গোলাগুলির খবর জানার পর সিমিন হোসেন রিমি, তাঁর ভাই বোনেরা এবং তাঁদের মা আশে পাশের বিভিন্ন বাসায় গিয়ে সেই বাসার টেলিফোন ব্যবহার করে পরিস্থিতি জানার জন্য বিভিন্ন জায়গায় কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন।

কিন্তু তারা কোনো খবর জানতে পারছিলেন না। এভাবেই দিন গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়।

সিমিন হোসেন রিমি বিকেলে দেখেন সাত মসজিদ রোডে তাদের বাসার সামনে হাজার হাজার মানুষ। তাদের কথা থেকে তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন যে, তাজউদ্দীন আহমদ সহ অনেককে হত্যা করা হয়েছে।

শেষপর্যন্ত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তারা নিশ্চিত হন ৪ঠা নভেম্বর সন্ধ্যার আগে । তখন তাজউদ্দীন আহমদের ছোটবেলার দু’জন বন্ধু তাদের বাসায় আসেন।

এই দু’জনের একজন ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম এটর্নী জেনারেল ফকির সাহাবুদ্দিন। তারাই পরিবারের সদস্যদের কাছে তাজউদ্দীন আহমদসহ চারজন রাজনীতিকের হত্যাকাণ্ডের খবর জানান।

সিমিন হোসেন রিমি জানান, ৪ঠা নভেম্বর রাতে কারা কর্তৃপক্ষ থেকে মৃতদেহ হস্তান্তরের জন্য তাদের সাথে যোগাযোগ করা হয়।

রাত সাড়ে বারটার দিকে পুলিশী পাহারায় মরদেহ তাদের বাসার কাছে আনা হয়। কিন্তু সাত মসজিদ রোডে অনেক মানুষ জড়ো হওয়ায় মৃতদেহ প্রথমে বাসায় নেয়ার ব্যাপারে পুলিশ রাজি হচ্ছিল না। পরে জড়ো হওয়া মানুষদের সরিয়ে দিয়ে তারা মৃতদেহ বাসায় নিয়ে আসে।

সিমিন হোসেন রিমি বলেন, মৃতদেহ বাসায় আনার পর থেকেই দ্রুত দাফনের জন্য তৎপর ছিল পুলিশের লোকজন।

শেষপর্যন্ত ৫ই নভেম্বর ভোর সাড়ে ছয়টার দিকে তাজউদ্দিন আহমদের মৃতদেহ দাফনের জন্য নেয়া হবে জানতে পেরে সাতমসজিদ রোডে কয়েক হাজার মানুষ নিজেরা মৃতদেহ দাফন করার দাবি তোলে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যেখানে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ তিন জন নেতার কবর রয়েছে, সেখানে জেলখানায় নিহত চারজন নেতার জন্য ছাত্রলীগের একদল কর্মী কবর খুঁড়েছিল। সেখানে কবর দেয়ার দাবি করা হচ্ছিল।

কিন্তু পুলিশ সাত মসজিদ রোডে জড়ো হওয়া মানুষকে লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছিল।

পরে ৫ই নভেম্বর বেলা বারটার দিকে পুলিশ মৃতদেহ তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখে সেখানে জানাজা করানোর পর বনানী কবরস্থানে নিয়ে যায়।

মুজিবনগর সরকারে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তাঁকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল শেখ মুজিবকে হত্যার পর ২২শে অগাষ্ট।

তাঁর মেয়ে সৈয়দা জাকিয়া নূর ১৯৭৫ সালে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। এখন তিনি কিশোরগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদসদস্য।

সৈয়দ নজরুল ইসলামের বড় ছেলে আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মৃত্যুর পর ঐ আসনে সংসদ সদস্য হয়েছেন সৈয়দা জাকিয়া নূর।

সৈয়দা জাকিয়া নূর শিশু বয়সে তাঁর বাবার হত্যাকাণ্ডের দিনের ঘটনাপ্রবাহ ততটা না বুঝতে পারলেও পরে অনুভব করেছেন যে, সেই দিনটি ছিল তাদের পরিবারের জন্য বিভীষিকাময়।

৭৫ এর অগাষ্টে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গ্রেফতারের পর তাঁর পরিবারের সদস্যরা পুরোনো ঢাকায় কারাগারের কাছে টিপু সুলতান রোডের বাসায় ছিলেন।

সৈয়দা জাকিয়া নূর জানান, ৩রা নভেম্বর ভোরে তারা কারাগার থেকে পাগলাঘণ্টার শব্দ শুনেছিলেন। সেই শব্দ তাদের আতঙ্কিত করেছিল।

বেলা বাড়ার পর তারা কারাগারের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন পরিস্থিতি জানার জন্য। কিন্তু সেখানে তারা কিছুই জানতে পারেননি।

কারাগারে বন্দি হওয়ার পর থেকে সৈয়দ নজরুল ইসলামের জন্য প্রতিদিন তাঁর বাসা থেকে খাবার পাঠানো হতো। ৩রা নভেম্বরও তারা খাবার পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু দুপুরে খাবার ভর্তি টিফিন ক্যারিয়ার ফেরত আসে।

তখন পরিবারের সদস্যদের উদ্বেগ বেড়ে যায়। পরদিন বিকেল পর্যন্ত তারা নিশ্চিত কোনো খবর পাচ্ছিলেন না।

সৈয়দা জাকিয়া নূর বলেছেন, পরদিন ৪ঠা নভেম্বর বিকেল পাঁচটার দিকে কারগার থেকে দু’জন লোক এসে তাদের জানায় যে, মৃতদেহ শনাক্ত করার জন্য পরিবারের একজন সদস্যকে যেতে হবে। তখন তারা হত্যার বিষয়ে নিশ্চিত হন।

সৈয়দ নজরুল ইসলামের মৃতদেহ পরিবারের সদস্যদের দেখাতে পুরোনো ঢাকার বাড়িতে নেয়া হয়েছিল ৫ই নভেম্বর সকালে।

চারজন রাজনীতিকেরই মৃতদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দাফনের দাবি উঠেছিল।

ফলে পুরোনো ঢাকার আর্মানিটোলা মাঠে জানাজার পর দুপুরে পুলিশী পাহারায় সৈয়দ নজরুল ইসলামের মৃতদেহ নেয়া হয়েছিল বনানী কবরস্থানে।

১৯৭৫ সারের ১৫ই অগাষ্ট শীর্ষ পর্যায়ের যে চারজন রাজনীতিককে গ্রেফতার করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম এম মনসুর আলী মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রীসভার সদস্য ছিলেন।

তাঁর ছেলে মোহাম্মদ নাসিম শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুর পর ছেলে তানভির শাকিল জয় আওয়ামী লীগ থেকে সিরাজগঞ্জের একটি আসনে সংসদ সদস্য হন।।

দাদী এবং বাবা-চাচার কাছে ৩রা নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে যা জেনেছেন তানভির শাকিল জয়, তাতে তার মনে হয়েছে, হত্যার খবর জানতেই তাদের পরিবারের সে সময় দু’দিন লেগেছিল।

তিনি বলেন, ৭৫ এর ১৫ ই অগাষ্টের হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের ওপর নির্যাতন নেমে এসেছিল। তখন শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের পরিবারের সদস্যদেরও অনেকে আত্নগোপনে থেকেছেন। ফলে ৩রা নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডের খবর জানতেই তাদের অনেক বেগ পেতে হয়েছে।

মনসুর আলীর পরিবারের সদস্যরা ৩রা নভেম্বর সারাদিন হত্যাকাণ্ডের খবর জানতে আত্নীয়স্বজনের মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগের চেষ্টা করেও কিছু জানতে পারছিলেন না।

তারা পরদিন নিশ্চিত খবর জানতে পারেন।

তানভির শাকিল জয় জানিয়েছেন, তাদের একজন আত্নীয় সরকারি চাকরি করতেন। জেলখানা থেকে তাদের সেই আত্নীয়কে মৃতদেহ শনাক্ত করার ব্যাপারে মনসুর আলীর পরিবারকে জানাতে বলা হয়েছিল ৪ঠা নভেম্বর বিকেলে।

সেই আত্নীয়ের মাধ্যমেই তারা হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছিলেন।

এরপর গভীর রাতে মনসুর আলীর মৃতদেহ ধানমন্ডির সোবহানবাগ এলাকায় তাদের বাড়িতে নিয়ে জানাজা করা হয়েছিল।

এ এইচ এম কামারুজ্জামানও মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রীসভার সদস্য ছিলেন।

তাঁর ছেলে এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন রাজশাহী সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে মেয়র হয়েছেন।

১৯৭৫ সালে ৩রা নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডের সময় এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন এবং তাঁর ছোট ভাই ভারতের কোলকাতায় একটি মিশনারী স্কুলে পড়তেন।

তিনি জানিয়েছেন, তিনি তাঁর মায়ের কাছে শুনেছেন যে, হত্যাকাণ্ডের দিনটিতে তাঁর মা নানা গুজব শুনলেও তা বিশ্বাস করেননি।

পরদিন ৪ঠা নভেম্বর বিকেলে তাজউদ্দীন আহমদের স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীন টেলিফোন করে খায়রুজ্জামান লিটনের মায়ের সাথে কথা বলেছিলেন, জেলখানায় কিছু একটা হয়েছে।

তখন তাঁর মা আরও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এরপর ৪ঠা নভেম্বরেও বাসা থেকে মনসুর আলীর জন্য পাঠানো খাবার ফেরত আসে। তখন মি: কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্যদের সন্দেহ আরও বেড়ে যায়।

শেখ মুজিবকে হত্যার ঘটনার পর মি: কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্যরা মন্ত্রীর বাড়ি ছেড়ে ঢাকার হাতিরপুল এলাকায় ভাড়া বাসায় উঠেছিলেন।

সেই বাসাতেই পরিবারের সদস্যদের মৃতদেহ শনাক্ত করার জন্য খবর দেয়া হয়েছিল ৪ঠা নভেম্বর বিকেলে।

খায়রুজ্জামান জানিয়েছেন, তাঁর বাবার মৃতদেহ রাজশাহীতে দাফন করার ব্যাপারে প্রথমে অনুমতি দেয়া হচ্ছিল না। তবে পরে তাঁর মায়ের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রাজশাহীতে হেলিকপ্টারে করে এ এইচ এম কামারুজ্জামানের মৃতদেহ পাঠানো হয় ৫ই নভেস্বর।

সেদিন রাজশাহীতে তাঁকে দাফন করা হয়।

এসএইচ-০৬/০৩/২২ (কাদির কল্লোল, বিবিসি)