রাজপথেই সমাধান নাকি আলোচনার সুযোগ আছে

নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিরোধীদল বিএনপি এখন কর্মসূচি অব্যাহত রেখে রাজপথেই সমাধানের কথা বলছে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও তাদের সরকারের অধীনে নির্বাচন করার অবস্থানে অটল থেকে রাজপথে পাল্টা কর্মসূচি নিচ্ছে।

দুই দলের রাজপথে শক্তি প্রদর্শনের মহড়ার শেষ কোথায় এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিরোধীদলের মূল দাবিতে সমঝোতা বা সমাধানের ব্যাপারে আলোচনার কোনো সম্ভাবনা আছে কীনা-এসব প্রশ্নে নানা আলোচনা এখন চলছে।

বিএনপির এখন মূল দাবি হচ্ছে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করা।

সেজন্য দলটি বিভাগীয় শহরগুলোতে সমাবেশ করে শোডাউন বা শক্তি প্রদর্শন করছে।

রাজপথে কর্মসূচির মাধ্যমে বিএনপি তাদের দাবি আদায়ে সরকারকে বাধ্য করতে চাইছে। বিএনপি নেতৃত্ব এখন রাজপথেই ফয়সালার কথা বলছেন।

সরকার বলছে, বর্তমান সংবিধানে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের কোন বিধান নেই। সংবিধানের বাইরে সরকার কোনভাবেই যাবে না।

কিন্তু বিএনপি কী সরকারের সাথে আলোচনার কোনো সম্ভবনা দেখে-এই প্রশ্নে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে কোনো আলোচনায় তারা রাজি নন।

আলমগীরের বক্তব্য হচ্ছে, একমাত্র সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনের ঘোষণা দেয়া হলে তারপর আলোচনার প্রশ্ন আসতে পারে।

“সরকার যখন মেনে নেবেন যে নির্দলীয় সরকারের অধীনে আমরা নির্বাচনে যাব, তখন সেই ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। সেই ফয়সালাটা সম্পূর্ণভাবে রাজপথেই হতে হবে”, বলেন বিএনপি নেতা আলমগীর।

বিএনপি এখন মনে করছে, গত দু’টি নির্বাচনে বিপর্যস্ত পরিস্থিতি কাটিয়ে এবার তাদের দলের নেতাকর্মীরা রাজপথে টিকে থাকার একটা অবস্থায় এসেছে।

সেকারণে দলটির নেতৃত্ব এমুহূর্তে সরকারের সাথে আলোচনার বিষয়ে কোনো কথা বলতেই রাজি নয় বলে মনে হয়েছে।

অন্যদিকে, বিগত ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছিল ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামের জোট গঠন করে।

সেই ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে দলটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে সংলাপেও অংশ নিয়েছিল।

কিন্তু সেই সংলাপে নানা প্রতিশ্রুতির পরও অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না বলে দলটির নেতারা বলছেন।

এখন আবার আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে সংলাপে আগ্রহী না হওয়ার ব্যাপারে বিএনপি তাদের আগের অভিজ্ঞতাকেও অন্যতম একটি কারণ হিসাবে দেখাচ্ছে।

সরকার এখনও নির্দলীয় সরকারের দাবি মানতে রাজি নয়।

আওয়ামী লীগ রাজপথেও তাদের অবস্থানের পক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে তাদের প্রতি জনসমর্থন বা তাদের শক্তি দেখাতে চাইছে।

তবে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সিনিয়র মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, বিএনপি শেষপর্যন্ত আলোচনায় আসবে বলে তারা বিশ্বাস করেন।

এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “তারা (বিএনপি) যেভাবে চাচ্ছে যে, আন্দোলন করে শক্তি প্রদর্শন করে সরকারের পতন ঘটাবে, সেটা সফল হবে না।

“যখন তারা (বিএনপি) সফল হবে না এবং সেটা উপলব্ধি করবে, তখন হয়তো আলোচনায় আসবে এবং আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হবে” বলেন ড. রাজ্জাক।

তিনি উল্লেখ করেন, তারা সেই অপেক্ষায় আছেন।

কিন্তু আলোচনার ব্যাপারে সরকার কোনো উদ্যোগ নেবে কীনা – এই প্রশ্নে আওয়ামী লীগ নেতা ড. রাজ্জাক বলেন, “একটা পর্যায়ে উদ্যোগ নিতে হবে এবং অবশ্যই নেবো”।

তিনি মন্তব্য করেন, “অনেকে সময় অনেক কিছু পর্দার অন্তরালেও হয়।”

একইসাথে তিনি উল্লেখ করেন, এ মুহূর্তে পর্দার অন্তরালে কোনো ঘটনা নেই।

তবে বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীরা বিভিন্ন দলের সাথে কথাবার্তা বলছে, সেই উদাহরণ টেনে ড. রাজ্জাক বলেন, একটা পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান হবে।

বিদেশি কূটনীতিকরা দু’পক্ষকে সংলাপে উৎসাহিত করতে চাইছেন।

যদিও ড. রাজ্জাকের কথায় মনে হচ্ছে, তারা আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধানের সম্ভাবনা দেখেন।

কিন্তু তারা বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী তাদের সরকারের অধীনেই নির্বাচনের অবস্থানে কোন ছাড় দিতে রাজি নন।

প্রধান দুই দলেরই একাধিক নেতা অবশ্য বলেছেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি যাতে সংঘাতের দিকে না যায়, সেজন্য পর্দার আড়ালে বিদেশি কূটনীতিকদের কিছু তৎপরতা রয়েছে।

কয়েকদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের একজন উপ-সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা সফর করেছেন। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে এবং দুই দলের কিছু নেতার সঙ্গে কথা বলেছেন।

আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরোধের জায়গাটা কোথায়, সেটা মার্কিন কর্মকর্তা বোঝার চেষ্টা করেছেন বলে তারা ধারণা করেন।

তবে দু’পক্ষই যখন যার যার অবস্থানে অটল থেকে রাজপথ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে, তখন রাজনীতি সংঘাতের দিকে যেতে পারে বলে বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন।

সে ধরনের পরিস্থিতি যাতে না হয়, সেজন্য দুই দলই আবার একে অপরের ওপর দায়িত্ব চাপাচ্ছেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাসিম আকতার হোসাইন বলেছেন, রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা তৈরি হলেও নির্বাচনের আগে শেষ পর্যন্ত আলোচনার সম্ভবনা রয়েছে।

“দুই দল যদি রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে খেলা ভাবেন, এই খেলাটা কিন্তু জনগণ দেখছে। কারণ জনগণ সংঘাত পছন্দ করে না” বলেন অধ্যাপক নাসিম আকতার হোসাইন।

তিনি মনে করেন, যেহেতু দু’টি দলকেই ভোটারদের কাছে যেতে হবে, সেজন্য পরিস্থিতিকে খেলা হিসাবে নিয়ে জনগণকে উপেক্ষা করা ঠিক হবে না।

“আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে রাস্তার আন্দোলন এবং দাবির ব্যাপারে আওয়াজ তোলার বিষয়টিও একটা ফ্যাক্টর। কিন্তু শেষ বিচারে এটা ফ্যাক্টর নয়।”

ফলে শেষ পর্যন্ত আলোচনার মাধ্যমেই দু’পক্ষকে সমাধান করতে হবে বলে মনে করেন অধ্যাপক নাসিম আকতার হোসাইন।

এদিকে, স্ব স্ব অবস্থানে অটল থাকলেও আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুই দলের নেতাদের অনেকে মনে করেন, রাজনীতি সংঘাতের দিকে এগুলে সেটা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যই নেতিবাচক হতে পারে।

সেজন্য একটা সমঝোতা হওয়া প্রয়োজন বলে বিশ্লেষকরা বলছেন।

এসএইচ-০৪/০৯/২২ (কাদির কল্লোল, বিবিসি)