দায়মুক্তির অধ্যাদেশ: বিচার ঠেকাতে কালো আইন

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ইতিহাসের এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড চালানো হয় রাতের অন্ধকারে। গুলি করে খুন করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু পরিবারের ১৭ জনকে। যা বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায়। সেই হত্যাকারীদের রেহাই দিতে জারি করা হয়েছিল দায়মুক্তি অধ্যাদেশ। এ দায়মুক্তি অধ্যাদেশটি জারি করেন তখনকার অবৈধ সরকারপ্রধান খন্দকার মোশতাক আহমেদ, ১৯৭৫ সালের ২৬ আগস্ট। বঙ্গবন্ধু হত্যার মাত্র ১ মাস ১০ দিন পর।

এরপর ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই অধ্যাদেশটিকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে অপরাধীদের দায়মুক্তি পাকাপোক্ত করেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। এরমধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনকে কলুষিত করেন তিনি। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ ডুবে যায় বিভীষিকার অন্ধকারে।

আইনটির মাধ্যমে দীর্ঘ ২১ বছর বঙ্গবন্ধু এবং জেলহত্যার তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়া আটকে রাখা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান ছাড়াও এই দুই যুগেরও বেশি সময়ে যেসব সরকার ক্ষমতায় ছিল, তারা বিভিন্নভাবে হত্যাকারীদের সহায়তা ও আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার আইনটি বাতিল করলে খুনিদের বিচারের পথ খুলে যায়।

যা আছে এই কুখ্যাত অধ্যাদেশে

এতে দুটি অংশ রয়েছে। একটিতে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থি যা-ই কিছু ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।

দ্বিতীয় অংশ বলছে, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেয়া হলো। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।

মোশতাকের পর অধ্যাদেশে সই করেন তখনকার আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এইচ রহমান।

যেভাবে কালো অধ্যায়ের শুরু

রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন স্বাধীন বাংলাদেশকে মৌলিক আদর্শ থেকে ভিন্নপথে নিয়ে যেতেই ১৫ আগস্টের নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছিল। সেদিন সামরিক বাহিনীর ট্যাংক, বন্দুক, গোলাবারুদ ব্যবহার করেছিল ঘাতকেরা। হত্যাকারীরা ছিল সামরিক বাহিনীর জুনিয়র কর্মকর্তা ও অধস্তন সেনাসদস্য। তাদের একটি অংশকে স্বাধীনতাপরবর্তী শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। অন্য অংশও একই বাহিনীতে কর্মরত ছিল।

ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধু, শেখ মণি ও আব্দুর রব সেরনিয়াবাত পরিবারের সদস্যদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। বাড়িতে থাকা সবাইকে তারা ভয়াবহ জিঘাংসা নিয়ে গুলি করে। সরাসরি হত্যাকাণ্ডে জড়িত না-থেকেও বাইরে থেকে সহায়তা করেছিল অনেকে। তাদের হাতেই নিহত হন বঙ্গবন্ধুর সাহায্যে এগিয়ে আসা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল উদ্দিন আহমেদ। তিনি ছিলেন জাতির পিতার সামরিক সচিব। সবার কাছে তিনি কর্নেল জামিল নামে পরিচিত।

এছাড়া সাভারে নিরাপত্তা বাহিনীর ১১ সদস্যকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। ১৫ আগস্ট থেকেই বেতার ভবন দখল ও গণভবন থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে হত্যাকারীরা। আইনের প্রতি ন্যূনতম সম্মান দেখানো তো দূরের থাক, সামরিক-বেসামরিক কোনো সৌজন্যতাবোধও ছিল না তাদের আচরণ কিংবা কাজে। রাষ্ট্রের কোথায় কাকে বসাবে, কাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হবে—খন্দকার মোশতাকের মাধ্যমে তারা তা বাস্তবায়ন করে যেতে থাকে।

অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতি পদে বসানো হয়েছিল মোশতাককে। সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের হাতে চলে যাওয়ার কথা। কোনো আইন কিংবা অজুহাতে রাষ্ট্রপতি হওয়ার অধিকার ছিল না মোশতাকের। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী। কাজেই তার রাষ্ট্রপতি হওয়া সংবিধান সমর্থিত না। এ কথা পরিষ্কার যে ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার যোগসাজশ ছিল। এই ক্ষমতালোভী ও ষড়যন্ত্রকারী কখনোই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ধারক ছিলেন না।

মোশতাকের বিশ্বাসঘাতকতা ১৫ আগস্টের পর তার ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ ছাড়াও তিনি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও ছিলেন না। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তার রাষ্ট্রপতি হওয়ার সুযোগ ছিল না। তারপরও তাকে কেন রাষ্ট্রপতির পদে বসানো হলো? কারণ সংবিধান অনুসারে জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব পালনের সুযোগ বন্ধ করে দিয়ে নিজেদের ইচ্ছায় তারা দেশ শাসন করতে চেয়েছিলেন। যে কারণে বঙ্গবন্ধুর পর রাজনীতিতে তার শূন্যতা পূরণ করতে পারেন, এমন কাউকেই জীবিত রাখা হয়নি।

ঘাতকেরা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামারুজ্জামানসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গৃহবন্দি করে। এরপর বিনাবিচারে আটকে রাখে জেলখানায়। তোফায়েল আহমেদসহ কয়েকজনের ওপর শারীরিক নির্যাতনও চালানো হয়।

খন্দকার মোশতাককে সরকারপ্রধান ঘোষণার পর জ্যেষ্ঠ নেতাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে চাপ দেয়া হয়। যারা রাজি হননি, তাদের পাঠানো হয় কারাগারে। ১৫ আগস্টের ঘাতকেরা ছিল বিকারগ্রস্ত ক্ষমতালোভী ও প্রতিক্রিয়াশীল। উন্নয়ন ও অগ্রগতি থেকে তারা রাষ্ট্রকে পিছিয়ে দিতে চেয়েছিল।

এই হত্যাকাণ্ডে যারা অংশ নিয়েছিল—প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে—তারা রাষ্ট্র ও মানবতাবিরোধী। তারা দেশকে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল। যে কারণে ইতিহাসের পাতায় তাদের নাম ঘৃণাভরে লেখা রয়েছে।

১৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে সরে যায়। মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে সুবিধাবাদী, ধর্মান্ধ, প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানি ভাবধারার রাজনীতি। দেশের সব প্রতিষ্ঠানসহ সামাজিকভাবেও তার প্রভাব পড়ে। এতকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের দায়মুক্তি দিতে অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন মোশতাক।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর প্রথম প্রহরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয় চার নেতাকে। বিশ্লেষক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদের মতে, ক্ষমতাসীন মোশতাক বা তার সমর্থকরা চাননি যে তাদের বিরোধী আরেকটি শক্তি শাসন ক্ষমতায় পুনর্বহাল হোক। ওই ধরনের একটা সরকার যদি হতো তাহলে জেলে থাকা চারজনই ছিলেন সম্ভাব্য নেতা।

সেই শঙ্কা থেকেই তাদের হত্যা করা হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। ১৫ আগস্ট থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত সব হত্যাকাণ্ড, অবৈধ ক্ষমতা দখল, সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ধ্বংসসহ অনেক নজিরবিহীন অপরাধ করলেও তাদের বিনাবিচারে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়। সপরিবারে বিমানে ব্যাংককে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। আর সবকিছু করা হয়েছিল রাষ্ট্রীয় মদদেই।

খুনিদের আশ্রয় দিল যারা

কেবল খন্দকার মোশতাকই না, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, আবদুস সাত্তার, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ও খালেদা জিয়াও তাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন। দূতাবাসে চাকরি দেয়াসহ অপরাধীদের অবাধে চলাচলের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি এসব সরকার। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হয়ে সংবিধান সংশোধন করে দায়মুক্তি অধ্যাদেশ সংবিধানে সংযুক্ত করেন। অর্থাৎ অধ্যাদেশটিকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে চিরতরে বিচার বন্ধ করতে চেয়েছিলেন তিনি।

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মোশতাককে সরিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রণকারী হন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। তখন বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম ছিলেন রাষ্ট্রপতি। ১৯৭৬ সালের ২৯ এপ্রিল জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব হস্তান্তর করেন সায়েম। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। এরপর তার স্থলাভিষিক্ত হন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সামরিক আইনের অধীনে দেশে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচনে একতরফাভাবে ক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান। এরপর সংসদের মাধ্যমে পঞ্চম সংশোধনী আনেন।

এতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক সরকারের যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেয়া হয়। সংসদ নেতা শাহ আজিজুর রহমানের তোলা বিলটি ২৪১-০ ভোটে পাস হয়। কোনো হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধ করে সংবিধান সংশোধনের ইতিহাস পৃথিবীতে নেই।

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, সংবিধান সংশোধন করে দায়মুক্তি অধ্যাদেশের বৈধতা না দিলে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার খুনিদের বিচার করা যেত। কিন্তু সেই পথ রুদ্ধ করে দেন জিয়াউর রহমান। তখন একটি অপপ্রচার ছিল—যেহেতু এটি সংবিধানের অংশ, সেহেতু এটির পরিবর্তন অসম্ভব। যে কারণে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার, প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ও প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াও আইনটি বাতিল করেননি। বরং খুনিদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করা হয়।

২০২১ সালের ১ সেপ্টেম্বর সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন জিয়াউর রহমান, আর তার স্ত্রী খালেদা জিয়া একধাপ এগিয়ে খুনি রশিদকে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা বানিয়েছিলেন।

তিনি আরও বলেন, অধ্যাপক আলী আশরাফ যে এলাকা থেকে নির্বাচন করতেন, সেখানে বঙ্গবন্ধুর খুনি কর্নেল রশিদের বাড়ি ছিল। তার পাশেই খুনি মোশতাকের বাড়ি। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া ভোটারবিহীন নির্বাচন করেছিলেন। ওই নির্বাচন সব রাজনৈতিক দল ও দেশের মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছিল। সেই নির্বাচনে খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধুর খুনি কর্নেল রশিদকে এমপি করে এনে এই জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা বানিয়েছিলেন।

পরে অবশ্য পঞ্চম সংশোধনীটি উচ্চ আদালতের রায়ে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। তবে জেলহত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হলেও আসামিদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। এমনকি বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যার আড়ালের ক্রীড়নকদের শনাক্ত করার জন্য কমিশন গঠন করার কথা থাকলেও তা হয়নি। যে কারণে সেই ষড়যন্ত্রের আড়ালের কুশিলবদের যেমন চিহ্নিত করা যায়নি, তেমনই সেই ষড়যন্ত্রও জানতে পারেনি জাতি।

যেভাবে বাতিল হয় দায়মুক্তি অধ্যাদেশ

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে একই বছরের ১২ নভেম্বর ‘দি ইনডেমনিটি রিপিল অ্যাক্ট-১৯৯৬’ বিলের মাধ্যমে দায়মুক্তির অধ্যাদেশটি বাতিল করা হয়। এতে বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার হত্যাকাণ্ডের বিচারের বাধা দূর হয়।

আইনবিদদের মতে, খুনিদের রক্ষায় যারা অধ্যাদেশ জারি করেছিল, ২১ বছর ধরে যেসব সরকার ক্ষমতায় ছিল, তারা তাদেরই সমর্থক। এ কারণেই ১৫ আগস্ট থেকে শুরু করে চার নেতার হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্ভব হয়নি।

১৯৯৬ সালে দায়মুক্তি অধ্যাদেশটি বাতিলের আইনগত দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের তখনকার সচিব আমিন উল্লাহর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি সিদ্ধান্ত দেয়, এটি বাতিলের জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন নেই। দায়মুক্তি অধ্যাদেশের মতোই প্রায় ১৬টি আইন পঞ্চম সংশোধনীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। যা পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েই সংসদে বাতিল করা হয়। কাজেই এটিও একই রকমভাবে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে সংসদে বাতিল করা সম্ভব।

কমিটির এই প্রতিবেদন আইন কমিশনের মতামতের জন্য পাঠানো হয়। সাবেক প্রধান বিচারপতি এফ কে এম মুনীমের নেতৃত্বাধীন আইন কমিশনও তা সমর্থন করে। এরপর তখনকার আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু দায়মুক্তি অধ্যাদেশ বিল বাতিলের জন্য ‘দি ইনডেমনিটি রিপিল অ্যাক্ট-১৯৯৬’ বিলটি সংসদে তোলেন। পরে ওই বছরের ১২ নভেম্বর বাংলাদেশ সংসদে আইনটি পাস হয়। এভাবেই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ খুলে যায়।

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম তদন্ত

বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যা মামলার প্রথম অনুসন্ধান কমিটি হয় ১৯৮০ সালে যুক্তরাজ্যে। তখন বাংলাদেশে আইন করে বিচারের পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু আয়ারল্যান্ডের সাবেক মন্ত্রী ও শান্তিতে নোবেলজয়ী শন ম্যাকব্রাইডসহ চার ব্রিটিশ আইনবিশেষজ্ঞ এ কমিটি গঠন করেন। তবে বাংলাদেশে ঢুকতে তাদের অনুমতি দেয়া হয়নি। যে কারণে এই তদন্ত কমিটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে।

এ কমিশনকে বাংলাদেশে ঢুকতে না দেয়ার মধ্য দিয়ে এটিই স্পষ্ট হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িতদের প্রতি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সরাসরি সমর্থন ছিল। এ অনুসন্ধান কমিশনের প্রতিবেদনটি ‘শেখ মুজিব মার্ডার ইনকোয়ারি: প্রিলিমিনারি রিপোর্ট অব দ্য কমিশন অব ইনকোয়ারি’ শিরোনামে লন্ডনের র‌্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশনস থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালের নভেম্বরে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর মুখবন্ধ লেখেন।

সেদিন তিনি লিখেছিলেন, বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও একজন হত্যাকারীকেও বিচারের মুখোমুখি করেনি বাংলাদশ সরকার। বস্তুত এসব হত্যাকারী এবং তাদের সহযোগী ষড়যন্ত্রকারীরা সরকারের কাছ থেকে সুরক্ষা এবং সহযোগিতা পেয়ে এসেছে। এদের কাউকে কাউকে বিদেশে কূটনৈতিক মিশনে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অন্যরা দেশেই নানা সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। এভাবে অপরাধীকে পুরস্কৃত করা হয়েছে।

১৯৮০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর কমিটি গঠন হয়। হাউস অব কমন্সের একটি কমিটির কক্ষে তাদের প্রথম বৈঠক হয়। কমিটির নেতৃত্ব দেন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য ও আইনবিদ টমাস উইলিয়ামস। শন ম্যাকব্রাইড ছাড়াও এতে আরও ছিলেন ব্রিটিশ এমপি জেফরি টমাস, মানবাধিকারকর্মী অবরি রোজ।

বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে একই বছরের ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার তিন প্রধান আসামি লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়া রশিদ খার ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে গ্রেফতার করা হয়। ওই বছরই ১৫ আগস্টের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় থানায় এফআইআর করেন বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহকারী (পিএ) এ এফ এম মোহিতুল ইসলাম।

পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি এই মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। একই বছরের ১২ মার্চ ছয় আসামির উপস্থিতিতে আদালতে বিচার শুরু হয়।

১৯৯৭ সালের ১৯ জুন পর্যন্ত বিচারক বিব্রত হওয়াসহ নানা কারণে আটবার বিচার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। এভাবে দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর মামলার রায়ে বিচারক কাজী গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। অন্যদিকে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বেঞ্চ ২৪ দিনের শুনানি শেষে বিভক্ত রায় দেন। বিচারক এম রুহুল আমিন অভিযুক্ত ১৫ আসামির মধ্যে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বজায় রাখেন। কিন্তু অপর বিচারক এ বি এম খায়রুল হক অভিযুক্ত ১৫ জনকেই সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেন। পরে হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চে ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে।

২০০১ সালের অক্টোবরে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসে। এতে দীর্ঘ ছয় বছর বিচার কাজ বন্ধ থাকে। এরপর ২০০৭ সালের ২৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের মুখ্য আইনজীবী ও বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সুপ্রিম কোর্টে সংক্ষিপ্ত বিবৃতি দেন। ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ ২৭ দিনের শুনানি শেষে ৫ আসামিকে নিয়মিত আপিল করার অনুমতি দিতে লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন।

২৯ দিনের শুনানির পর চূড়ান্ত আপিল শুনানি শেষ হয় ২০০৯ সালের ১২ নভেম্বর। আদালত ১৯ নভেম্বর রায়ের তারিখ নির্ধারণ করেন। ওইদিন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রেখে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামির দায়ের করা আপিল আবেদন খারিজ করেন। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের রিভিউ খারিজ হয়ে যায়। ২৮ জানুয়ারি ৫ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। এর মধ্যদিয়ে দায়মুক্ত করা হয় জাতিকে।

এসএইচ-০৩/১২/২২ (অনলাইন ডেস্ক, সূত্র : সময়)