ভিক্ষা করছে ১৮ শতাংশ পথশিশু

পরিবারে দারিদ্র্য ও প্রতিকূল সমাজ ব্যবস্থার কারণে খাবার বা কাজের সন্ধানে নগরে এসে ছিন্নমূল হয়ে পড়ছে শিশুরা। যেসব শিশুর বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার করার কথা, নগরে এসে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। সম্ভাবনাময় এসব শিশু ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েছে। কাজ না পেয়ে অনেক মেয়ে পথশিশু যৌনকর্মীর পেশাও বেছে নিয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, প্রতি ১০ জন পথশিশুর মধ্যে ৯ জন বিভিন্ন কাজে যুক্ত। এরমধ্যে ভিক্ষুক ও ভিক্ষুকের সহায়তাকারী হিসেবে নগরে জীবনযাপন করছে ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ। ময়লা কুড়িয়ে (টোকাই) জীবনযাপন করছে ২০ দশমিক ৯ শতাংশ। পথশিশুদের একটি অংশ অপরাধে যুক্ত। তাছাড়া যৌনকর্মী হিসেবে যুক্ত হচ্ছে মেয়ে পথশিশুরা। বিবিএস’র তথ্যে বলা হয়, অপরাধ ও যৌনকর্মী হিসেবে যুক্ত রয়েছে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ শিশু। এছাড়া ঝাড়ু দেওয়া ও পরিচ্ছন্নতা কাজে যুক্ত শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ পথশিশু। আর ঝুঁকিপূর্ণ পরিবহন সেক্টর ও নির্মাণকাজে যুক্ত ১৬ শতাংশ পথশিশু।

কর্মভিত্তিক পথশিশু জরিপ ফলাফলে দেখা গেছে, মেয়ে পথশিশুদের মধ্যে ৮৪ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ছেলে পথশিশুদের মধ্যে ৯২ দশমিক ১ শতাংশ দেশের নগরজীবনের সঙ্গে যুক্ত। অর্থাৎ, প্রতি ১০ জন পথশিশুর মধ্যে ৯ জন বিভিন্ন কাজে যুক্ত। দোকান, রেস্টুরেন্ট, চা বিক্রির সঙ্গে যুক্ত ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। রাস্তায় ফুল ও অন্যান্য পণ্য বিক্রির সঙ্গে যুক্ত ১৩ শতাংশ। ছোট পেশায় যুক্ত ৯ দশমিক ৯ শতাংশ।

বিবিএস’র তথ্যমতে, মেয়েদের গড় বয়স সাড়ে ১০ বছর এবং ছেলে পথশিশুদের গড় বয়স ১২ বছর ৭ মাস। আর ৫ থেকে ৯ বছর বয়সী ছেলেমেয়ে পথশিশু ১৯ দশমিক ২ শতাংশ। ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী ছেলে ও মেয়ে পথশিশু ৫৪ শতাংশ। ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী ছেলে ও মেয়ে পথশিশু ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ।

১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী মেয়ে পথশিশুর মধ্যে ৬৭ শতাংশ ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য বা ঋতুস্রাব বিষয়ে সচেতন। স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে বেড়ে উঠছে মেয়ে পথশিশুরা। একবারের জন্য স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করে মাত্র ২৮ শতাংশ, পুরনো কাপড় ব্যবহার করে ৬৪ শতাংশ। ব্যবহার করা পুরনো কাপড় ব্যবহার করে ৭৩ শতাংশ। এর সঙ্গে পানি ও সাবান ব্যবহার করে ৭০ শতাংশ। শুধু পানি ব্যবহার করে ২০ শতাংশ।

শিশু অধিকার নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা বলছেন, পথশিশুর মোট সংখ্যা কত তার জরিপ নেই। সে কারণে পথশিশুদের অধিকার নিশ্চিত করা কঠিন। পথশিশু বাড়ার কারণগুলো চিহ্নিত করে তা বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, পারিবারে দারিদ্র্য ও প্রতিকূল সমাজ ব্যবস্থার কারণে খাবার বা কাজের সন্ধানে এসে ছিন্নমূল হয়ে পড়েছে এসব শিশু।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে এসব শিশুকে সমাজের মূল স্রোতে ফেরানো জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না হলে এসব শিশুর বেশিরভাগ অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়বে। যুক্ত হবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে।

শিশু সুরক্ষা ও শিশু অধিকার বিষয়ক সুশাসন কার্যক্রম সেভ দ্য চিলড্রেনের পরিচালক আবদুল্লা আল মামুন বলেন, ‘সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ পথশিশুদের সংখ্যা নিরূপণ করা। এবারও বিবিএস বলেছে, পথশিশুর সংখ্যা নিরূপণ করা যায়নি। পথশিশুর সঠিক সংখ্যা না জানার কারণ হিসেবে তারা বলছে, পথশিশুরা এক জায়গায় থাকে না। তাদের সমস্যা সমাধান করতে হলে সংখ্যা জানতে হবে। পথশিশুদের নিয়ে কাজ করার সরকারি বেসরকারি নানান উদ্যোগ রয়েছে। পুনর্বাসনের চেষ্টা করা হচ্ছে কিন্তু বাস্তবে এটা দুরূহ। পথশিশুদের জীবনের গল্প একেকজনের একেক রকম। তাই তাদের সমস্যার সমাধানও আলাদা হবে। এসব শিশুকে পরিবারে বা সেফ হোমে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার উপায়ও আলাদা।

পথশিশু সমস্যার সমাধানের সুপারিশ তুলে ধরে আবদুল্লা আল মামুন বলেন, শিশুরা যেন পথে না আসে সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। কোথা থেকে শিশুরা কী কী কারণে নগরে আসছে সেটা নানান গবেষণা থেকে আমারা জানছি। সেক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারের ১১৫টি সোশ্যাল সেফটিনেট প্রোগ্রাম রয়েছে। নতুন করে প্রোগ্রামগুলোর আওতায় বা নতুন কর্মসূচি নিয়ে প্রথমে সব শিশুর জন্মনিবন্ধন করতে হবে। কোনও শিশু যখন প্রথম গ্রাম থেকে মাইগ্রেট হচ্ছে তখনই তা নিশ্চিত করতে হবে।

দ্বিতীয় হচ্ছে—বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় শতভাগ শিশুকে আনতে পারলে পথশিশু সমস্যা প্রতিরোধ করা হবে। যারা এখন শহরে পথশিশু রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে প্রথমে ওয়ার্ডভিত্তিক দায়িত্ব ভাগ করতে হবে। ওয়ার্ডভিত্তিক পরিকল্পনা করে বয়স উপযোগী সমাধান করতে হবে। ১০ বছরের নিচের পথশিশুদের বিদ্যালয়ে ফেরাতে হবে। দশ বছরের বেশি হলে নন-ফরমাল এডুকেশন, প্রাথমিক শিক্ষা এবং কারিগরি শিক্ষা দিতে হবে। তাদের বয়স অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ কাজ না দিয়ে সমস্যার সমাধান করতে হবে। ভিক্ষাবৃত্তি ও মাদকাসক্ত শিশুদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে হবে দ্রুত। বর্তমানে যে পথশিশু এখন রয়েছে তারা পথশিশু থাকবে না। আর ভবিষ্যতের জন্য পরিবার বা সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে যাতে পথশিশু না হতে না হয় সেই পদক্ষেপ নিতে হবে।

বিবিএস’র তথ্য বলছে, মোট পথশিশু কত সে বিষয়ে হালনাগাদ সরকারি পরিসংখ্যান নেই।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম. এ. মান্নান বলেছেন, হালনাগাদ তথ্য আগে ছিল না। দারিদ্র্য ও খাবারের অভাবের কারণে তারা পথশিশু হিসেবে নগরে আসছে। সব শিশুর সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেড়ে ওঠা এবং নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আমরা পথশিশুদের খাবার দিয়েছি, দোলনা দিয়েছি। কিন্তু তারা থাকতে চায় না। সরকার পথশিশুদের পুনর্বাসনে কাজ করছে। বেসরকারি সংস্থাগুলোও তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে পারে।

এসএইচ-০৩/০২/২৩ (অনলাইন ডেস্ক)