নির্বাচনকে সামনে রেখে জনতুষ্টির বাজেট করা কঠিন!

করোনায় সারা বিশ্বই ছিল বিপর্যস্ত৷ তা সামলানোর আগেই অর্থনীতিতে নেমে আসে ইউক্রেন যুদ্ধের থাবা৷ এবার আরেক চ্যালেঞ্জের সামনে বাংলাদেশ সরকার৷ আসছে জাতীয় নির্বাচন৷ নির্বাচনকে সামনে রেখে গণমুখী বাজেট ঘোষণা কি সম্ভব?

সাধারণ মানুষের ওপর রেকর্ড মূল্যস্ফীতির চাপ আর রাজস্ব আদায়ে অদক্ষতা – এই দুই বাস্তবতা বাজেটের অর্থ সংস্থানকে কঠিন করে তুলেছে৷ পাশাপাশি আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়ন, রিজার্ভ আর ডলার সংকটের মতো বিষয়গুলোও মনে রাখতে হচ্ছে সরকারকে৷ তাই অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মনে করছেন, নির্বাচনকে মাথায় রেখে জনতুষ্টির বাজেট করা এবার খুব কঠিন৷

তবে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, ‘‘আমরা জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি অব্যাহত রাখবো৷ কিন্তু রাজস্ব আয় বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই৷’’

তারপরও এবারের (২০২৩-২৪) বাজেট হবে সবচেয়ে বড়- সাত লাখ ৬১ হাজার ৯৯১ কোটি টাকার৷ মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পাঁচ লাখ কোটি টাকা এবং ঘাটতি দুই লাখ ৬১ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা৷ এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিবি) হবে দুই লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা৷ চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছরের মূল বাজেট ছয় লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার, যা পরে সংশোধন করে কিছুটা কমানো হয়৷

ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ ও ডলার সংকট, আইএমএফের শর্ত – এইসব বিবেচনায় রেখে জাতীয় নির্বাচনের আগে এই বাজেট পেশ করা হচ্ছে৷ ফলে সরকারকে জনতুষ্টির বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে৷ তবে পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‘নির্বাচন সামনে থাকলেও বাজেটে জনতুষ্টির তেমন সুযোগ নেই৷ আর এত বড় বাজেটের অর্থ কোথা থেকে আসবে সেটাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ৷ এবার বাজেটের আকার হবে ২৫ বিলিয়ন ডলার৷ এর মধ্যে ১২ বিলিয়ন বাইরে থেকে এলে এর রি-পেমেন্ট হবে দুই বিলিয়ন৷ থাকছে ১০ বিলিয়ন ডলার৷ ডমেস্টিক অর্থনীতি থেকে আরো ১৫ বিলিয়ন ডলার জোগাড় করতে হবে৷ মানে এক লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা৷ আমাদের রাজস্ব-ঘাটতি আছে৷ এখানে তো অনেক চ্যালেঞ্জ৷ এত টাকা তো দিতে পারবে না৷ তাহলে কী হবে? আমাদের টাকা ছেপে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে৷ তাতে অর্থনীতি দুর্বল হবে, মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে, বাজারে চাপ সৃষ্টি হবে৷’’

সিপিডির ডিস্টিংগুইশড ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘‘ঘাটতি বাজেটের অর্থায়ন কীভাবে হবে এটা অবশ্যই একটা বড় চ্যালেঞ্জ৷ এই অর্থ কোথা থেকে সরকার জোগাড় করবে, এটা কি ব্যাংকিং সেক্টর থেকে ঋণ নেবে, না কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেবে, না বৈদেশিক ঋণ নেবে সেটা সরকারকে নির্ধারণ করতে হবে৷’’

চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছরের প্রথম ৯ মাস, অর্থাৎ জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা৷ আর ১২ মাসে এই ঘাটতি হতে পারে ৪০ হাজার কোটি টাকা৷

এর বাইরে আরো যে বড় চ্যালেঞ্জ আছে তা হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি৷ এখন মূল্যস্ফীতির সাধারণ হার ৯.৩৩৷ খাদ্যপণ্যে এটা আরো বেশি৷ এই মূল্যস্ফীতির কারণে অনেকের আয় কমেছে, ক্রয়ক্ষমতা কমেছে৷ আর সেজন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বিস্তৃতি ঘটাতে হবে৷ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সক্ষমতা যদি না বাড়ানো যায়, তাহলে রাজস্ব আদায়ের টার্গেট পূরণ হবে না৷ উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন এই অর্থ বছরের প্রথম ১০ মাসে মাত্র ৫০ ভাগ হয়েছে৷ বিদেশি ঋণের যেসব প্রকল্প পাইপ লাইনে আছে সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা হলে তার একটা প্রভাব রিজার্ভে পড়বে৷

অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, ‘‘নির্বাচনের আগে বাজেট হলেও তথাকথিত জনতুষ্টির বাজেট করার সুযোগ নাই৷তবে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনি বাড়াতে হবে৷ সাধারণ মানুষের ওপর প্রভাব পড়ে এমন পণ্যে হয়তো নতুন কর আরোপ করা হবে না৷ তবে বিলাস পণ্যে কর বাড়বে৷ করমুক্ত আয়সীমা বাড়তে পারে৷’’

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান মনে করেন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলেও এটা নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষেপ পর্যাপ্ত নয়৷ প্রকৃত অর্থে কোনো জরিপও করা হয়নি যে কী পরিমাণ মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপে আছে৷ এখন বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের দাম কমে এলেও এখানে কমছে না৷ এই প্রেক্ষাপটে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বিস্তৃত করতে হবে৷

তার কথা, ‘‘গত দুই-তিন বছর ধরে দেখা যাচ্ছে রাজস্ব আদায় পিছন দিকে হাঁটছে৷ আর নানা ধরনের অর্থনেতিক অব্যবস্থাপনাও দেখা গেছে৷ বিশেষ করে বিানিময় হার, সুদেরহ হার- এইসব বিষয়ে যথা সময়ে যথা সিদ্ধান্ত না নিতে পারার কারণে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতি বড় ধরনের চাপের মুখে আছে৷ ব্যাংক ও আর্থিক খাতে যে সংস্কারগুলো প্রয়োজন, সেগুলো করা হয়নি৷’’

আগের নির্বাচনগুলোর সময় অর্থনীতি এত বহুমুখী চাপের মুখে ছিল না৷ এবার আইএমএফের শর্তগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে জনতুষ্টির ভাবনা দূরে রাখতে হবে৷ ভর্তুকি নিয়ে সরকার উভয়সংকটে আছে৷ রপ্তানি আর রেমিট্যান্সও খুব যে ভালো অবস্থায় আছে তা মনে করেন না অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান৷তিনি মনে করেন,জাতীয় প্রবৃদ্ধিও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম হবে৷

এসব অনেকটা মেনে নিয়েই পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, ‘‘আমাদের রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে৷ এর কোনো বিকল্প নেই৷ আমাদের বড় বড় বেশ কিছু প্রকল্প শেষের দিকে আছে, সেখানে বেশ টাকা দিতে হচ্ছে৷ সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি নিয়ে মানুষের আশা আরো বাড়ছে৷ আর মূল্যস্ফীতি, ডলারের দাম বেড়ে গেছে৷ বাইরে থেকে অনেক কিছু আনতে হয়৷ এগুলো আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ৷’’

তিনি বলেন, ‘‘আন্তর্জাতিক বাজারে যেমন নিত্য পণ্যের দাম বেড়েছে তেমনি দেশের ভেতরে সাপ্লাইচেইন বাধাগ্রস্ত করেও সংকট বাড়ানো হয়েছে৷’’

তার কথা, ‘‘আমরা চলমান জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলো অব্যাহত রাখবো৷ আর আশা করি বাজেটর অর্থ সংস্থান নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না৷’’

এসএইচ-০২/২৭/২৩ (হারুন উর রশীদ স্বপন. ডয়চে ভেলে)