রোগীদের গোপনীয়তা থাকছে না!

পেটের সমস্যা নিয়ে ধানমণ্ডির একটি হাসপাতালে চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলেন শাহানা পারভিন। চেম্বার থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে কয়েকজন মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ তাকে ঘিরে ধরে প্রেসক্রিপশন দেখতে চান। তাদের কয়েকজন ছবিও তুলে নেন।

‘’কিছু বলার আগেই তারা আমাকে ঘিরে ধরে প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলে নিলো। সেখানে আমার সব সমস্যার বিবরণ, টেস্ট, ওষুধ লেখা আছে। আমার ব্যক্তিগত সমস্যার বিবরণ কয়েকজন অচেনা ব্যক্তির মোবাইলে চলে গেল,’’ তিনি বলেন।

প্রতিদিন তার মতো এরকম অভিজ্ঞতার শিকার হচ্ছে বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ। শারীরিক অসুস্থতা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা চিকিৎসকের পরামর্শ- কোনটির কোনরকম গোপনীয়তা রক্ষা করা হয় না।

ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা মিরাজ চৌধুরীর অভিজ্ঞতা আরও তিক্ত। তিনি শারীরিক একটি সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের চেম্বারে ঢুকে দেখেন, তার আগেই আরও দুজনকে সেখানে বসিয়ে রাখা হয়েছে। চিকিৎসকের সঙ্গে তাদের আলাপ, শারীরিক পরীক্ষা সবকিছুই তার চোখের সামনে ঘটে।

এরপর তার পালা যখন আসে, ততক্ষণে সেই চেম্বারের ভেতর আরও দুজন রোগীকে নিয়ে আসা হয়েছে।

মিরাজ চৌধুরী বলছিলেন, ‘’ডাক্তারকে আমার সমস্যার কথা ঠিকমতো বলতে পারিনি। আমার খুবই অস্বস্তি লাগছিল। এই চিকিৎসকের চেম্বারে এটাই নাকি নিয়ম।‘’

ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভুল তথ্য দিয়ে রোগী ভর্তি করার পর সদ্যোজাত শিশু এবং মায়ের মৃত্যুর পর এসব বিষয় আবার আলোচনায় উঠে এসেছে।

গত সপ্তাহে ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভুল তথ্য দিয়ে একজন প্রসূতি রোগীকে ভর্তি করা হয়। পরবর্তীতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সন্তান এবং মা- দুজনেরই মৃত্যু হয়।

নিহত মাহবুবা রহমানের স্বামী এই ঘটনায় যে মামলা দায়ের করেছেন, সেখানে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ‘গাফিলতি’র কারণে তার সন্তানের মৃত্যুর অভিযোগ আনা হয়েছে।

যে চিকিৎসকের অধীনে তাকে ভর্তি করা হয়েছিল, অভিযোগ রয়েছে যে, রোগীদের গোপনীয়তার বিষয়ে গুরুত্ব না নিয়েই তিনি সামাজিক মাধ্যমে তাদের চিকিৎসার নানা তথ্য তুলে ধরতেন। এরকম বেশ কিছু লাইভ ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।

গত সাতই জুন আপলোড করা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি কয়েকজন নারীকে দেখিয়ে বলছেন, তাদের অস্ত্রোপচার ছাড়াই সন্তান হয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, কোন রোগীর কি ধরনের চিকিৎসা করে তিনি সফল হয়েছে, সেসব ভিডিওতে তুলে ধরা হচ্ছে।

বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরেই সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে চিকিৎসকদের এ ধরনের প্রচার-প্রচারণার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সেখানে রোগীদের রোগের বর্ণনা, চিকিৎসার সফলতার নানা তথ্য তুলে ধরা হয়।

কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, সেসব ভিডিওতে রোগীদের গোপনীয়তার বিষয়টি একেবারেই গুরুত্ব দেয়া হয় না। চিকিৎসকের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে রোগীরাও এ নিয়ে আপত্তি করেন না।

বিশ্বের অনেক দেশে থাকলেও রোগীদের গোপনীয়তা সুরক্ষায় বাংলাদেশে নির্দিষ্ট কোন আইন নেই। কোন চিকিৎসক বা ব্যক্তি যদি কোন রোগীর গোপনীয়তা ভঙ্গ করে, তাহলে তার দণ্ড বা সাজার কোন সুযোগ নেই।

তবে ‘এথিকস’ লঙ্ঘন বিবেচনায় চিকিৎসকের বিরুদ্ধে লাইসেন্স বাতিলের মতো ব্যবস্থা নিতে পারে বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) – যারা বাংলাদেশের চিকিৎসকদের লাইসেন্স দিয়ে থাকে। কোন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে এই প্রতিষ্ঠানটি ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।

এখানকার ডিসিপ্লিনারি কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এহতেশামুল হক চৌধুরী বলছেন, ‘এথিকস’ অনুযায়ী রোগীর গোপনীয়তা সুরক্ষার দায়িত্ব চিকিৎসকের, তিনি সেই শপথ নিয়ে থাকেন। সেটার লঙ্ঘন হলে রোগী অভিযোগ করতে পারেন। কিন্তু এ ধরনের অভিযোগ কখনো তারা পাননি।

‘’এটা অবশ্যই বেআইনি কাজ, এটা আনএথিক্যাল। অনলাইন মিডিয়ায় আপনার প্রচারের উদ্দেশ্যে যে বিষয়গুলো ইদানীং তুলে ধরা হয় বলে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এটা অবশ্যই আনএথিক্যাল। রোগীদের গোপনীয়তা রক্ষা করা এথিকসের মধ্যেই পড়ে, কোনভাবেই এটার ব্যত্যয় হওয়ার সুযোগ নেই। এথিকসের বাইরে কেউ কাজ করে থাকলে সেটা তো শাস্তিযোগ্য অপরাধ,’’ তিনি বলেন।

বিএমডিসির কোড অব মেডিকেল এথিকসে লেখা রয়েছে, ‘’আমি রোগীদের স্বাতন্ত্র্য এবং মর্যাদাকে সম্মান রক্ষা করবো’’ এবং ‘’রোগীর মৃত্যু হলেও তার গোপন তথ্য কোনরকম প্রকাশ করবো না।’’

কিন্তু বাংলাদেশে রোগীর জীবিত থাকা অবস্থাতেই সমস্যা নিয়ে এমনকি লাইভ ভিডিও বা ফেসবুক স্ট্যাটাস দিতে দেখা যায় চিকিৎসকদের।

এ ধরনের অভিযোগে কখনো কোন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, এমনটা শোনা যায়নি বলে তাকে জানানো হলে তিনি বলেন, ‘’প্রথম কথা হল, কোন রোগী যদি সংক্ষুব্ধ হন যে, আমার অনুমতি ছাড়া প্রাইভেসি লঙ্ঘন হয়েছে, তিনি অভিযোগ করবেন। কিন্তু অভিযোগ ছাড়া তো আমরা কিছু করতে পারি না। এ ধরনের অভিযোগ আমরা কখনো পাইনি।

তিনি জানান, এরকম অভিযোগ এলে বিএমডিসির আইন অনুযায়ী ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে। তার রেজিস্ট্রেশন সনদ সাময়িক বা স্থায়ীভাবে বাতিল হতে পারে, তাকে সতর্ক করে দেয়া হতে পারে। অভিযোগের গুরুত্বেরও ওপর নির্ভর করে শাস্তি নির্ভর করবে।

কিন্তু যেভাবে গণহারে সামাজিক মাধ্যমে এরকম প্রচারণা চলছে, হাসপাতালে গেলেই রোগীদের নথিপত্র প্রকাশ্যে পাওয়া যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে বিএমডিসি নিজে থেকেই কেন সেগুলো বন্ধ করতে ব্যবস্থা নেয় না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘’রোগী যদি ক্লেইম না করে, আপনি যদি অভিযোগ না করেন যে, আপনারা প্রাইভেসি লঙ্ঘন হয়েছে, তাহলে আমরা কীভাবে কী করবো। কাউকে অভিযোগ করতে হবে।‘’

রোগীদের গোপনীয়তা শুধুমাত্র চিকিৎসকদের দ্বারাই নয়, হাসপাতালের কর্মী, ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই লঙ্ঘিত হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডা. আহমেদুল কবির বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘’প্রাইভেসির বিষয়গুলো অবশ্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ, চিকিৎসককে সেটা রক্ষা করতে হবে। এটা তার মেডিকেল এথিকস এবং শপথের মধ্যেই পড়ে। নতুন করে এটা আইনের কিছু নেই, তাকেই এটা রক্ষা করতে হবে।‘’

নিজেদের চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়ে রোগী এবং তাদের স্বজনদের সচেতন হওয়ার জন্য তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন।

‘’সমস্যা হল, অনেক রেগুলেশন আছে, কিন্তু সব তো মানা হচ্ছে না। সুশাসনের অভাব ডাক্তারদের মধ্যেও আছে। আসলে আইন করে বা পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে সব কিছু হবে না। এখানে সচেতনতাবোধ লাগবে।”

“এর পেছনে আসলে অনেকগুলো সমস্যা আছে। গোড়ার সমস্যাগুলোকে আসলে শনাক্ত করতে হবে। পুরো বিষয়গুলো নিয়ে একটা রিফর্মের বিষয়ে আমরা চিন্তা করছি যে, কীভাবে এসব সমস্যাকে অ্যাড্রেস করা যায়,’’ তিনি বলছেন।

ইউরোপে সব নাগরিকদের গোপনীয়তা রক্ষায় জেনারেল ডাটা প্রোটেকশন রেগুলেশন বা জিডিপিআর আইন রয়েছে।

২০১৮ সাল থেকে কার্যকর ওই আইনে মানুষের গোপনীয়তা রক্ষাকে একটি মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। আইনি প্রয়োজন ছাড়া কারও ব্যক্তিগত কোন তথ্য সংগ্রহ বা সংরক্ষণ করা যাবে না। এমনটি স্বাস্থ্য সেবা দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকেই এই নিয়ম মেনে চলতে হবে।

জার্মানিতে রয়েছে পেশেন্ট ডাটা প্রোটেকশন অ্যাক্ট বা পিডিপিএ। কয়েক বছর ধরে পরীক্ষামূলক থাকার পর ২০২০ সালে এই আইনটি গ্রহণ করেছে জার্মানি।

সেখানে বলা হয়েছে, নিজেদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সকল তথ্য ওই রোগীর তত্ত্বাবধানে থাকবে। চিকিৎসকরা যে ব্যবস্থাপত্র দেবেন, সেগুলো কাগজের পরিবর্তে অ্যাপের মাধ্যমে রোগী ডাউনলোড করে পছন্দের ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে পারবেন। রোগীরা চাইলে এনক্রিপটেড বা সাংকেতিক ভাষায় তাদের চিকিৎসা তথ্য গবেষণা কাজে ব্যবহারের জন্য অনুমতি দিতে পারবেন।

রোগীদের সুরক্ষায় সবচেয়ে পুরনো আইন যুক্তরাষ্ট্রের হেলথ কেয়ার ইনস্যুরেন্স পোর্টাবিলিটি অ্যান্ড একাউন্টিবিলিটি অ্যাক্ট বা হিপা। প্রায় বিশ বছর আগে চালু করা ওই আইনে ২০১৩ সালে এবং ২০২০ সালে কিছু পরিবর্তন আনা হয়। এই আইনে রোগীদের যাবতীয় তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার দেয়া হয়েছে। ইনস্যুরেন্স বা হাসপাতাল এসব তথ্যের প্রবেশাধিকার চাইলে রোগীদের অনুমতি নিতে হবে।

ইউরোপের জিডিপিআর আইনের অনুকরণে লেই জেরাল ডে প্রোটেকাও ডে ডাদোস বা এলজিপিডি নামের একটি আইন তিন বছর আগে থেকে কার্যকর করেছে ব্রাজিল। কোন ব্যক্তির স্বাস্থ্য, যৌনতা, আঙ্গুলের ছাপ বা জেনেটিক তথ্যের সুরক্ষা দেয়া হয়েছে ওই আইনে।

থাইল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষায় যে আইন হয়েছে, সেখানে চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার কথাও বলা হয়েছে।

জরিপ, গবেষণা বা বিভিন্ন ধরনের সেবা দেয়ার সময় মানুষের যেসব ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করা হয়ে থাকে, সেসব তথ্য বা উপাত্তের সুরক্ষা দিতে উপাত্ত সুরক্ষা আইন নামে নতুন একটি আইন করার প্রস্তাব করা হলেও সেখানে স্বাস্থ্য বা চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্যের গোপনীয়তা সুরক্ষার বিষয়ে আলাদাভাবে কিছু বলা হয়নি।

এসএইচ-০২/২০/২৩ (সায়েদুল ইসলাম,বিবিসি}