বাংলাদেশের রাজনৈতিক মাঠ হলেও খেলোয়াড় বিদেশিরা

বাংলাদেশের রাজনীতি এবং নির্বাচন নিয়ে এখন বিদেশিরা কী বলছেন এটা নিয়েই মানুষের আগ্রহ বেশি৷ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো কী করছে সেটা নিয়ে আলোচনা তেমন নেই৷ বলা চলে রাজনীতির মাঠ বাংলাদেশের হলেও খেলোয়াড় বিদেশিরা৷

ক্ষমতাসীন এবং বিরোধীরা বিদেশিদের ভূমিকা নিয়ে কথা তো বলছেনই৷ দেশের সাধারণ মানুষেরও প্রশ্ন বিদেশিরা বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে কী করছেন? আর এই আলোচনায় শীর্ষে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ তারপর চীন ও ভারত৷ দূরবর্তী হলেও রাশিয়া নিয়েও কথা হচ্ছে৷ আর ইউরোপের দেশগুলোর অবস্থান সম্পর্কেও আরো তথ্য চান এখানকার লোকজন৷

বিএনপি নেতা সৈয়দ এমরান সালে প্রিন্স বলেন, ‘‘বাংলাদেশ বৃহৎ শক্তিগুলোর খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে৷ এটা ব্যাটেল গ্রাউন্ড হয়ে যেতে পারে৷ বাংলাদেশ ক্রসফায়ারে পড়ে যেতে পারে৷ এর জন্য দায়ী বর্তমান সরকার৷”

আর এর জবাবে আওয়ামী লীগ নেতা এস এম কামাল হোসেন বলেন, ‘‘সাধারণ মানুষ সচেতন হয়েছেন তাই বিদেশিরা যা বলছেন তা নিয়ে কথা বলছেন৷ তথ্য বিশ্লেষণ করছেন৷ আর বাংলাদেশের গুরুত্বের কারণে বিদেশিরা বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলছে৷”

বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘‘দেশের মানুষ মনে করছেন রাজনৈতিক দলগুলো দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে উদ্যোগী হবে না৷ যদি বিদেশি চাপে হয় তো হতে পারে৷ আর সরকার বা বিরোধী সব রাজনৈতিক দলই তাদের মতো করে বিদেশিদের সমর্থন নিতে চাইছে৷ রাজনীতির মাঠে যে যাই বলুক না কেন তার আসল উদ্দেশ্য চাপ কমানো এবং নিজেদের দিকে সমর্থন নেয়া৷”

বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নতুন মার্কিন ভিসা নীতির পর রাজনীতিতে দেশীয় কেনো উপাদানের আর প্রধান্য দেখা যাচ্ছেনা৷ সরকার এবং বিরোধীরা ওই ভিসা নীতি নিয়েই আছে৷ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলই আবার ভিসা নীতির পক্ষে কথা বলছে৷ কিন্তু নতুন ভিসা নীতির পর বিএনপির আন্দোলনের তেজও আর বাড়ছে না৷ আর সরকার তথা আওয়ামী লীগও কিছুটা সহনশীল৷

এর মধ্যে রাজনীতির মাঠে নতুন এসেছে সেন্টমার্টিন দ্বীপ৷ রাশেদ খান মেনন সংসদে সেন্টমার্টিনের সঙ্গে সরাসরি অ্যামেরিকাকে যুক্ত করলেও প্রধানমন্ত্রী কোনো দেশের নাম যুক্ত না করেই বলেছেন সেন্টমার্টিন লিজ দিলে ক্ষমতায় থাকতে অসুবিধা নেই৷ দেশের কোনো সম্পদ বিদেশিদের দিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চান না তিনি৷

সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হকও মনে করেন এখন বাংলাদেশের রাজনীতি ও আগামী নির্বাচন নিয়ে বিদেশি বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়েই কথা হচ্ছে বেশি৷ তিনি বলেন, ‘‘বাইডেন প্রশাসন গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার নিয়ে তাদের অবস্থান বার বার স্পষ্ট করছে৷ বাংলাদেশে তারা সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়৷ এজন্য তারা সক্রিয় আছে৷ কিন্তু এর ভিতরে তাদের কোনো হিডেন এজেন্ডা থাকতে পারে৷ তবে সেটা কী আমি জানিনা৷ কারণ গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে অনেক দেশেই সমস্যা আছে৷ যুক্তরাষ্ট্র কি বাংলাদেশকে ব্যতিক্রম হিসেবে নিচ্ছে? নিলে সেটা কেন?”

তার কথা, ‘‘বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের ভূমিকা সবার জানা৷ আর চীন হচ্ছে তার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান থেকে কথা বলে৷ ইউরোপ এবং যুক্তরাজ্যের কথায় মার্কিন নীতির প্রতিফলন আছে৷ তারাও বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন চায়৷”

তিনি বলেন, ‘‘দেশের মানুষ একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়৷ দেশের সরকার, রাজনৈতিক দল সেই প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে৷ তাই স্বাভাবিক কারণেই মানুষ বিদেশিদের তৎপরতা নিয়ে আগ্রহী৷ আর রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতা ধরে রাখা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিদেশিদের সঙ্গে সব সময়ই যোগাযোগ রাখে- যা লাজ্জার৷”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, ‘‘এর নানা ধরনের লেন্স আছে৷ একটি হলো বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়েছে৷ এর ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়েছে৷ ফলে অনেক দেশেরই বাংলাদেশ নিয়ে আগ্রহ আছে৷ তাই তারা কথা বলেন৷ কথা বলেন বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে৷ আবার বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় যারা ক্ষমতায় ছিলেন তারা দেশের জনগণকে গুরুত্ব দেননি৷ ফলে এখন সেটা হচ্ছে বিদেশিরা কথা বলছেন, দেশের মানুষ শুনছেন৷ রাজনৈতিক দলগুলোও বিদেশমুখী হচ্ছে৷ তাদের কাছে সাধারণ মানুষ গুরুত্ব না পাওয়ায় ও তাদের প্রত্যাশা পুরণ না হওয়ায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে৷”

তার কথা, ‘‘দেশের সাধারণ মানুষেরও যতটা তৎপর বা প্রতিবাদী হওয়া প্রয়োজন ততটা হচ্ছেনা৷ তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই কথা বলছে কেউ কেউ৷ ফলে সব দিকেই একটা প্রবণতা বাইরে থেকে কেউ কিছু একটা করে দেবেন৷”

বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘‘আওয়ামী লীগ অনৈতিকভাবে ক্ষমতা ধরে রাখতে এবং আবারো একটি সাজানো, পাতানো ও ষড়যন্ত্রের নির্বাচন করতে গিয়ে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক খেলার মাঠে পরিণত করেছে৷ এটা ব্যাটেল ফিল্ডে পরিণত হয়ে যেতে পারে৷ আমাদের আশঙ্কা বাংলাদেশ এই ব্যাটেল ফিল্ডে না আবার ক্রসফায়ারে পড়ে যায়৷ বাংলাদেশ একটা অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে৷”

তার কথা, ‘‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ছাড়া এই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার আর কোনো পথ নাই৷”

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘গণতন্ত্র, নির্বাচন ও মানবাধিকারের বিষয়গুলো বিশ্বব্যাপী এবং সার্বজনীন৷ বিদেশিরা এগুলো নিয়ে তো কথা বলবেই৷ অ্যামেরিকা তো বলছেই যে তারা এই বিষয়গুলো এখন ফোকাস করছে৷ তারা তো নির্বাচন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার এই বিষয়গুলো নিয়েই কথা বলছে৷ এর বাইরে অন্য কোনো উদ্দেশ্য তো আমরা দেখছিনা৷ বরং প্রধানমন্ত্রী অযাচিতভাবে সেন্টমার্টিন ইস্যু টেনে এনে যে কথা বলছেন এর পক্ষে তো আমরা কোনো তথ্য প্রমাণ দেখছিনা৷ এটা একটা অপকৌশল৷”

আর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন মনে করেন, ‘‘দেশের সাধারণ মানুষও যে বিদেশিদের কথা ও ভূমিকা নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে এটা ইতিবাচক৷ তারা বিদেশিদের কথা বুঝতে চায়, তথ্য চায়৷ জানতে চায় তারা যা বলছে তা সঠিক কী না৷ মানুষ সচেতন হচ্ছে৷ আর বাংলাদেশ ভূ-রাজনৈতিক দিক দিয়ে একটি গুরত্বপূর্ণ দেশ৷ এই কারণে অনেকেই বাংলাদেশকে নিয়ে কথা বলছে, ভাবছে৷”

তার কথা, ‘‘যেসব রাজনৈতিক দল দেউলিয়া তারাই বিদেশিদের কাছে যায়, ধরনা দেয়৷ আওয়ামী লীগ যায়না৷ আমরা বিদেশিদের সঙ্গে কথা বলি, ধরনা দিইনা৷”

তিনি বলেন, ‘‘পাকিস্তানে কোনো গণতন্ত্র নাই, বাংলাদেশে তো কিছুটা হলেও আছে৷ সেই পাকিস্তানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নতুন কোনো ভিসা নীতি নাই৷ বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি হয়েছে৷ কেন, এর কারণ কী? এর জবাব খুঁজলেই আসল কারণ বোঝা যাবে৷”

এসএইচ-০২/২৫/২৩ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)