জামায়াত সখ্যতা গড়ে তুলছে আ’লীগ না বিএনপির সাথে?

সরকারের সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক আছে কি নেই; কিংবা জামায়াত বিএনপির ‘বি’ টিম কিনা, তা নিয়ে দেশের রাজনীতিতে নানা আলোচনা চলছে। ১০ বছরের বেশি সময় পর গত ১০ জুন জামায়াত নেতাকর্মীরা ঢাকায় সমাবেশ করলে মূলত এ আলোচনার সূত্রপাত ঘটে। কেউ কেউ প্রশ্ন করছেন- মার্কিন ভিসানীতির কারণেই কি জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে; নাকি তলে তলে সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে? অবশ্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা এ সম্পর্কের কথা সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন। এ গুঞ্জনকে গুজব বলছেন জামায়াতের নেতারাও। আবার দীর্ঘদিনের মিত্র বিএনপির সঙ্গে যে তারা নেই, সেটাও বলছেন। এমন প্রেক্ষাপটে রাজনীতিতে জামায়াতের গন্তব্য কোন দিকে, এ প্রশ্নই জোরেশোরে উঠেছে।

সরকারের সম্পর্কের বিষয়ে সর্বশেষ ঠাকুরগাঁওয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যে জামায়াত তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়। এ ছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে কোন পথে হাঁটবেন, তা নিয়ে জামায়াতের জ্যেষ্ঠ নেতারা সম্প্রতি বৈঠকও করেছেন বলে জানা গেছে।

দলটির গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতা জানান, বৈঠকে চলমান পরিস্থিতিতে জামায়াতের করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়। আপাতত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে জামায়াত স্বাতন্ত্র্য অবস্থানে থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এ জন্য সতর্কতার সঙ্গে পথ চলার নীতিও গ্রহণ করেছে দলটি। রাজপথের আন্দোলন কর্মসূচি সফল করা, বক্তব্য-বিবৃতিসহ সব কর্মকা- পরিচালনার ক্ষেত্রে এই সতর্কতা অবলম্বনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা।

দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের বাইরে গণমাধ্যমে বক্তব্য-বিবৃতি দিতেও বারণ করা হয়েছে। এখন থেকে দলটির সব কর্মকা- পরিচালিত হবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ তাদের ঘোষিত ১০ দফাকে ঘিরে। এ জন্য আগস্টের মধ্যে সব বিভাগীয় শহরে সমাবেশ করবে দলটি। ‘নির্যাতিত’ এলাকা হিসেবে সাতক্ষীরা ও বগুড়ায় সমাবেশ করার কথাও রয়েছে।

এদিকে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে যুগপৎ আন্দোলনের খসড়া রূপরেখা তৈরির কমিটিগুলোর বৈঠক হবে। সেখানে বিএনপির সঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের রূপরেখা নিয়ে মতপার্থক্য নিরসন করার কথা রয়েছে। বৈঠকে রূপরেখা ঘোষণার পদ্ধতি এবং দিনক্ষণও চূড়ান্ত করা হবে। সেখানে জামায়াত থাকবে কিনা, তা নিয়েও নানা আলোচনা হচ্ছে।

গত রোববার কর্মী সম্মেলনে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দলনিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জামায়াত কর্মীদের দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এবং গণআন্দোলনের মুখে সরকার পদত্যাগে বাধ্য হবে।

জামায়াতের প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, বিভাগীয় সমাবেশ করার বিষয়ে জামায়াতের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বশীল নেতাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রথমদিকে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট ও রাজশাহীতে সমাবেশ করার কথা ভাবা হচ্ছে। আমাদের সমাবেশ শন্তিপূর্ণ হবে। আশা করি প্রশাসন সমাবেশের অনুমতি দেবে।

জামায়াতের অনেক নেতা মনে করেন, মার্কিন ভিসানীতি ঘোষণার পর গত ১০ জুন শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ছিল তাদের জন্য টার্নিং পয়েন্ট। এরপর প্রতিটি ইউনিটে সাংগঠনিক কার্যাক্রমে গতি আনা হয়।

দলের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা বলেন, সাংগঠনিক কার্যক্রমের পাশাপাশি নির্বাচন সামনে রেখে তিন ধরনের (ক্যাটাগরি) শতাধিক প্রার্থীকে মাঠে নামানো হয়েছে। এর মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা ২৬ জন নেতাকে ‘এ’ ক্যাটাগরি এবং ১১ জন নেতাকে ‘বি’ ক্যাটাগরিতে রাখা হয়েছে। বাকি ৭০ থেকে ৮০ জন নেতা আছেন ‘সি’ ক্যাটাগরিতে।

জামায়াত নেতারা বলেন, তারা এমন অবস্থায় পথ চলতে চান, যেন কেউ বলতে না পারেন জামায়াত বিএনপির ‘বি’ টিম অথবা বিএনপির শত্রু। আবার সরকারের সঙ্গে জামায়াতের আতাত আছে, এমন অভিযোগের আঙুলও যেন কেউ তুলতে না পারে। এ ছাড়া প্রশাসনের অনুমতির বাইরে আপাতত কোনো কর্মসূচিতে যাবে না দলটি। ক্ষমতাসীনদের দিক থেকে হামলা হলে পাল্টা হামলা না করার সিদ্ধান্তও আছে দলটির।

আগামী ২৩ জুলাই মার্কিন দূতাবাসে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান হবে। এবার প্রথমবারের মতো ভারপ্রাপ্ত আমির মুজিবুর রহমানসহ তিনজন আমন্ত্রণ পেয়েছেন বলে জামায়াতের এক নেতা জানিয়েছেন।

বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্য সঙ্গতিপূর্ণ

গত শুক্রবার ঠাকুরগাঁওয়ে বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে দুই দলের মধ্যে যে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়েছিল, তা অনেকটা কেটে গেছে। দ্বিতীয় দফায় দেওয়া ব্যাখ্যায় বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমার বক্তব্যকে কয়েকটি গণমাধ্যমে ভুলভাবে প্রকাশিত হয়েছে। সরকার পদত্যাগ, সংসদ বাতিল, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবিতে চলমান আন্দোলনে যুগপৎভাবে জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল রয়েছে। এই নিয়ে বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ নেই। আমি বলেছি, সরকারের বিরুদ্ধে যেসব রাজনৈতিক দল আন্দোলন করছে, তাদের সবাইকে আমরা ওয়েলকাম করি। ঠাকুরগাঁওয়ে আমার বক্তব্যকে বিকৃত করা হয়েছে। ঠাকুরগাঁওয়ে বুঝাতে চেয়েছি, সরকার প্রমাণ করতে চায় জামায়াতের সঙ্গে তাদের স্পষ্ট যোগাযোগ আছে।

সোমবার এ নিয়ে জামায়াতের উচ্চপর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলেন, প্রথমে বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্য জামায়াতের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলেও দ্বিতীয় দফায় দেওয়া বক্তব্য আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে করে জামায়াত।

যে কারণে সন্দেহ

বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে সন্দেহ প্রকাশ্যে আসে গত বছরের আগস্ট মাসে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের এক বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। দলের ভার্চুয়াল সভায় তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা এতদিন একটা জোটের (২০ দলীয় জোট) সঙ্গে ছিলাম। ছিলাম বলে আপনারা হয়তো ভাবছেন কিছু হয়ে গেছে নাকি? আমি বলি হয়ে গেছে।’ এরপর থেকে জামায়াতকে সন্দেহের চোখে দেখে বিএনপি। এই অবস্থায় গত ১০ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকার সমাবেশের আগে বিএনপি জোট নেতাদের ডেকে ২০ জোট ভেঙে দেওয়ার কথা জানায়। যুগপৎ আন্দোলন শুরু হলে ২০ দলীয় জোটের শরিকরা মিলে দুটি জোট করে। এই জোট গঠনে বিএনপির হাত ছিল বলে অভিযোগ আছে। জামায়াত নেতারা বলেন, তারা কর্মীনির্ভর দল। আর বিএনপি জনপ্রিয় দল। ক্ষমতায় গেলে বিএনপি যাবে। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির বর্তমান আচরণ মেনে নেওয়া কঠিন।

বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা বলেন, এবার পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জামায়াত নেতারা কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছেন। অনেকে মেয়রপদে নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়েছেন- এ খবরও বিএনপির কাছে আছে। এ থেকে কী প্রমাণ করে? যেখানে বিএনপি ভোট বর্জনের ঘোষণা দেয়, যেখানে ভোটার উপস্থিতি না হোক, সেটা চায়- সেখানে কাউন্সিলর পদে জামায়াত নির্বাচন করে। আবার জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রার্থীও চূড়ান্ত করে। জামায়াতকে সন্দেহ করার তো বহু কারণ আছে। বিএনপির মধ্যেও কিছু নেতার কর্মকা- সন্দেহজনক মনে হয়। যেখানে যে সন্দেহ আছে, তা সবাইকে দূর করতে হবে।

জামায়াতের সম্ভাব্য প্রার্থী

‘এ’ ক্যাটাগরিতে আছেন- মাওলানা আবদুল হাকিম (ঠাকুরগাঁও-২), মাওলানা মোহাম্মদ হানিফ (দিনাজপুর-১), মোহাম্মদ আনোয়ারুল ইসলাম (দিনাজপুর-৬), মনিরুজ্জামান মন্টু (নীলফামারী-২), মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম (নীলফামারী-৩), অধ্যাপক গোলাম রব্বানী (রংপুর-৫), মাজেদুর রহমান সরকার (গাইবান্ধা-১), মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান (সিরাজগঞ্জ-৪), মাওলানা ইকবাল হুসাইন (পাবনা-৫), অধ্যাপক মতিয়ার রহমান (ঝিনাইদহ-৩), আবু সাঈদ মুহাম্মদ শাহাদাত হোসাইন (যশোর-২), অ্যাডভোকেট আবদুল ওয়াদুদ (বাগেরহাট-৩), অধ্যাপক আবদুল আলীম (বাগেরহাট-৪), অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার (খুলনা-৫), মাওলানা আবুল কালাম আযাদ (খুলনা-৬), মুহাদ্দিস আবদুল খালেক (সাতক্ষীরা-২), মুফতি রবিউল বাশার (সাতক্ষীরা-৩), সাতক্ষীরা ৪-এ গাজী নজরুল ইসলাম, পিরোজপুর ১-এ শামীম সাঈদী, ঢাকা ১৫-এ ডা. শফিকুর রহমান, সিলেট ৫-এ মাওলানা ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী, সিলেট ৬-এ মাওলানা হাবিবুর রহমান, কুমিল্লা ১১-এ ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, চট্টগ্রাম ১৫-এ আ ন ম শামসুল ইসলাম, কক্সবাজার ২-এ হামিদুর রহমান আযাদ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনে নুরুল ইসলাম বুলবুল।

‘বি’ ক্যাটাগরিতে আছেন ডা. ফজলুর রহমান সাঈদ (জয়পুরহাট-১), অধ্যক্ষ শাহাদাতুজ্জামান (বগুড়া-২), মাহাবুবুর রহমান বেলাল (রংপুর-৩), ডা. আবদুল বাসেত/নাজিবুর রহমান মোমেন (পাবনা-১), অধ্যাপক আবু তালেব ম-ল (পাবনা-৪), তাজউদ্দিন (মেহেরপুর-১), গাজী এনামুল হক (যশোর-৫), অধ্যাপক মুক্তার আলী (যশোর-৬), অধ্যাপক জসিম উদ্দিন (যশোর-৬), শাহজাহান চৌধুরী (চট্টগ্রাম-১০), মাওলানা জহিরুল ইসলাম (চট্টগ্রাম-১৬)। দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা জানান, ‘এ’ ক্যাটাগরি নেতাদের মনোনয়ন চূড়ান্ত বলে ধরে নেওয়া যায়। ‘বি’ ক্যাটাগরির সবাই মনোনয়ন পাবেন, এটা নিশ্চিত নয়।

এসএইচ-০২/০৪/২৩ (অনলাইন ডেস্ক, সূত্র : আমাদের সময়)