পথশিশুরা ডেঙ্গু ঝুঁকিতে

‘রাস্তাঘাটত থাকি, কই আর থাকমু! কয়েকদিন আগে জ্বর হইছিল, এরপরে সাইরা গেছেগা।’ বলতে বলতেই শরীর চুলকাতে থাকে ১১ বছর বয়সী সাকিব। পথশিশু সাকিবের দেখা মিললো ঢাকা ফার্মগেট মেট্রো স্টেশনের কাছেই।

ফুটপাতে শুয়ে ছিল সে। এক ভিক্ষুক হাতের লাঠি দিয়ে উঠানোর চেষ্টা করতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে পড়ে সে। প্রথমে কিছুক্ষণ চোখ ডলে, তারপর গা এলিয়ে বসে। শৈশবেই বাবা-মা হারিয়েছে সাকিব, কেবল নানি বেঁচে আছেন। দিনভর নানি ভিক্ষা করেন, পেটে ক্ষুধা জানান দিলে সাকিবও চেয়ে-চিন্তে খাবার জোগাড় করে।

ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হলের সামনের আইল্যান্ডে শুয়ে রাত কাটে তার। মশারি টানাও কি না জানতে চাইলে সাকিবের সরল জবাব, ‘মশারি পামু কই, অইহানেই চিৎ হইয়া হুইয়া থাকি!’

ডেঙ্গু সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সাকিব জানায়, মশা কামড়ে যে ডেঙ্গু হয় এটিই কেবল জানে সে।

গত কয়েক দিনে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে এবং প্রায় ২০ জনের মতো পথশিশুর সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, ডেঙ্গুর বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য নেই তাদের কাছে। এসব পথশিশুদের রাত কাটে ঢাকার বিভিন্ন সড়কের ফুটপাতে, রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ও পলিথিনে আচ্ছাদিত অস্থায়ী ঘুপচি ছাউনির নিচে নয়তো বস্তিতে।

গত কয়েক বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি ঘেঁটে দেখা গেছে, সাধারণত বছরের জুলাই মাসের শেষ দিকে বা আগস্ট মাসের শুরুতে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলেও চলতি বছরের জুলাই মাসের শুরু থেকেই ডেঙ্গুর সংক্রমণ জটিলাকার ধারণ করেছে। কার্যকর প্রতিরোধ না নেওয়ার কারণে দেশের প্রতিটি জেলাতেই ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, ‘ডেঙ্গু সম্পর্কে সচেতনতা না থাকায় পথশিশুরা ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে প্রচণ্ড ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে এই শিশুদের মধ্যে যেসব শিশু বর্জ্য সংগ্রহ বা ব্যবস্থাপনার কাজ করে থাকে তাদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

ডেঙ্গুতে পথশিশুদের ঝুঁকি কেন সবচেয়ে বেশি জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজীর আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘পথশিশুরা যেসব স্থানে থাকছে সেসব স্থানগুলো ডেঙ্গুর হটস্পট। এমনিতেই পথশিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল। তাছাড়া তাদের সচেতনতারও অভাব রয়েছে। ফলে ডেঙ্গু হলেও তারা বুঝতে পারছে না। বিশেষ করে যেসব শিশু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত তারা ডেঙ্গুর মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে।’

যেসব শিশু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত তারা ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছে | ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক/স্টার
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. ইফফাদ আরা শামসাদ ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সব বয়সীদের মধ্যে শিশুদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গু প্রচণ্ড বিপজ্জনক হতে পারে। আবার অন্য শিশুদের তুলনায় পথশিশুদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। কারণ তাদের কারোরই সচেতনতা নেই। আমরা দেখতে পাচ্ছি, ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে লক্ষণ ও দেখা যায় না। জ্বর হওয়ার পরেও ওরা বিষয়টি আমলেই নিচ্ছে না। যখন খুব ভয়াবহ অবস্থা হয় তখনই দেখা যায়, তাদের হাসপাতালে আনা হচ্ছে। তবে তারা যেন প্রাথমিক অবস্থাতেও চিকিৎসা সেবাটি পায় সে জন্য আমরা হাসপাতাল থেকেও সর্বাত্মক গুরুত্ব দিচ্ছি। এ জন্য পথশিশুদের মধ্যে সচেতনতা কার্যক্রমও বাড়ানো উচিৎ।’

বর্তমানে ঢাকায় পথশিশু সংখ্যা কত সে সম্পর্কিত কোনো পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পাওয়া যায় না। তবে ২০২২ সালে ইউনিসেফের সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘পথশিশুদের জরিপ ২০২২’ এ ইউনিসেফ বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, পথশিশুদের সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি হতে পারে।

বিবিএসের সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের মোট পথশিশুর মধ্যে ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশ পথশিশুই ঢাকা বিভাগে বসবাস করে। ঢাকার ২ সিটি করপোরেশনেই বসবাস করে দেশের ৪১ শতাংশ পথশিশু। জরিপের তথ্যানুযায়ী এই পথশিশুদের মধ্যে ২০ দশমিক ৯ শতাংশ শিশুই বর্জ্য সংগ্রহের কাজ করে থাকে।

পথশিশু কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ড. ফজলুল হক বলেন, ‘পথশিশুদের জন্য ডেঙ্গু ইতোমধ্যেই চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। এর মধ্যে অসংখ্য পথশিশুর নীরবে ডেঙ্গু হলেও বেশিরভাগ পথশিশুই টেস্ট করাচ্ছে না, যে কারণে তাদের ডেঙ্গুও বিষয়টি সামনে আসছে না। প্রচুর পথশিশুর ইতোমধ্যে ডেঙ্গু হয়ে গেছে কিন্তু তারা যেহেতু ডেঙ্গু টেস্ট করাচ্ছে না, তাই তাদের ডেঙ্গুটা ধরা পড়ছে না। পথশিশুদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আমরা বেশ কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছি। ইতোমধ্যে কড়াইল বস্তি, মহাখালী বাসস্ট্যান্ড, কারওয়ান বাজারসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে এবং ঢাকার শহরের বাইরেও আমরা গণসচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি কড়াইল বস্তিতে সবচেয়ে বেশি পথশিশু বাস করে থাকে। সেখানেও আমরা লিফলেট বিতরণ করে বলেছি, যেন জ্বর হলেই দ্রুত তারা আমাদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে। এতে পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারবো এটি ডেঙ্গু না কি অন্য কোনো ভাইরাসজনিত জ্বর। পুরো বিষয়টিই আমরা বিনামূল্যে করছি।’

‘আমাদের ট্রাস্টের বেশ কিছু মোবাইল টিম রয়েছে, যেখান থেকে সার্বক্ষণিকভাবে পথশিশু এবং সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সেবা দেওয়া হচ্ছে। এখন এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সবার সম্মিলিত উদ্যোগই একমাত্র প্রয়োজন,’ বলেন তিনি।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকারের কী করা উচিৎ জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজীর আহমেদ বলেন, ‘আমাদের তথ্যগত ঘাটতিও প্রকট। তথ্যের দুষ্প্রাপ্যতাও ডেঙ্গু মোকাবিলার ক্ষেত্রে বড় একটি বাধা। ইতোমধ্যেই তথ্যের বিভ্রাটটি সবাই দেখেছে। প্রথমত পরিপূর্ণ তথ্যের বিষয়টি সামনে আনা প্রয়োজন। এই দুর্যোগকালে সরকারের উচিৎ বিনামূল্যে ডেঙ্গু টেস্টের পদক্ষেপ নেওয়া। সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডেই মেডিকেল সেন্টার করা উচিৎ, যেখানে ফ্রি ডেঙ্গু পরীক্ষা করা যায় এবং প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। প্রয়োজনে তাদের হাসপাতালে প্রেরণ করা।’

তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সরকার কখনোই এককভাবে এই পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে না। যারা এ নিয়ে কাজ করছে তাদের সঙ্গে বসে একসঙ্গে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া এককভাবে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না।’

এসএইচ-০১/২৪/২৩ (অনলাইন ডেস্ক, সূত্র : ডেইলি স্টার)