রাজপথে সংঘাতের রাজনীতি শুরু?

দুই দলের ঢাকায় সমাবেশের পরদিনই রাজপথে সংঘাত শুরু হয়েছে। ঢাকার প্রবেশ পথে বিএনপির অবস্থান কর্মসূচি নিয়ে বৃহস্পতিবার এই সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।

পুলিশের সঙ্গে বিএনপির, আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির; এই সংঘাতে আহত হয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। আটক করা হয়েছে বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান আমানউল্লাহ আমানকে। তিনিও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ঢাকার মাতুয়াইল এলাকায় তিনটি বাসে আগুন, শ্যামলীতে পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর এবং আরো কয়েকটি এলাকায় প্রাইভেট কার ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।

বিএনপি শুক্রবার সমাবেশের পরই ঢাকার প্রবেশ পথগাবতলী, উত্তরা, নয়া বাজার ইউসুফ মার্কেট ও শনির আখড়ায় শনিবার সকাল ১১টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি দেয়। আর আওয়ামী লীগও ওইসব এলাকায় বিএনপির কর্মসূচি ঘোষণার পর সমাবেশের কর্মসূচি দেয়। কিন্তু রাতেই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ( ডিএমপি) জানায় তার কোনো দলকেই কর্মসূচি পালনের অনুমতি দেয়নি। পুলিশ রাতেই ওইসব এলাকায় অবস্থান নেয়, শনিবার সকালে অবস্থান আরো শক্ত করে।

শনিবার সকাল ১১ টার দিকে পুরনো ঢাকার ধোলাইখালে অবস্থান নেয়াবিএনপির নেতা-কর্মীদের পুলিশ ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। পুলিশের ধাওয়ায় তারা কিছুটা পিছু হটে পুলিশকে ধাওয়া দিলে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় আহত হন। তার মাথা ফেটে রক্ত পড়তে দেখা যায়। তিনি শুয়ে পড়লে তাকে পুলিশ লাঠিপেটা করে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। এরপর তাকে পুলিশ নিয়ে যাওয়ার সময় জানায় তাকে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে। পরে তাকে ডিবি অফিসে নেয়া হয়। বিকেলে পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়।

ধোলাইখালে এক ঘণ্টা ব্যাপী এই সংঘর্ষে পুলিশ লাঠিচার্জ ছাড়াও কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে। বিএনপির নেতা-কর্মীরা ইটপাটকেল ছোড়ে।

এদিকে সকাল ১১টার দিকে গাবতলী এলাকায় সড়কের পাশে বিএনপির নেতা-কর্মীরা ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমানের নেতৃত্বে অবস্থান নেন। তার অল্প দূরেই অবস্থান নেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। দুপুর ১২ টার দিকে পুলিশ আমানকে সরে যেতে বললে তিনি রাজি হননি। পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়।

এক পর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পুলিশ তাকে হাসপতালে নিয়ে যায়। তাকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি হাসপাতালে ভর্তির পর প্রধানমন্ত্রী তার প্রতিনিধির মাধ্যমে তাকে ফল ও খাবার পাঠান। চিকিৎসার খোঁজ নেন এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য যেকেনো জায়গায় যেতে চাইলে তার ব্যবস্থার আশ্বাস দেন। পরে আমান আটকমুক্ত হয়ে সেখান থেকে এভারকেয়ার হাসপাতালে যান।

এছাড়া উত্তরায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও পুলিশের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়েছে। সেখানে অন্তত ১০ জন আহত হন। গাবতলীতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। মাতুয়াইলে পুলিশ ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংষর্ষ হয়েছে। ওই এলাকায় তিনটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেয়া হয়। শ্যামলী এলাকায় পুলিশের একটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। যাত্রাবাড়ি এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এই সব সংঘর্ষের ঘটনায় কমপক্ষে অর্ধশত আহত হয়েছেন।

ডিএমপির উপকমিশনার (মিডিয়া) ফারুক আহমেদ সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছে তারা এই সব ঘটনায় মোট ৯০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে। পুলিশের একজন যুগ্ম কমিশনারসহ ২০ পুলিশ সদস্য আহত হন। পুলিশের গাড়ি ছাড়াও সাধারণ মানুষের ২০টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। তার কথা,” কর্মসূচির কোনো অনুমতি না দেয়ার পরও তারা কর্মসূচি পালন করেছে।”

এদিকে এই সংঘাত সংঘর্ষের পর আওয়ামী লীগের নেতা-কমীরা ঢাকার প্রবেশ পথগুলোতে অবস্থান নিয়েছে। আওয়ামী লীগের জরুরি সভা ডাকা হয়েছে। বিএনপি সন্ধ্যায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি দিয়েছে। পরবর্তী করণীয় নিয়ে তারা বৈঠকে বসেছে।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ আজম খান বলেন,” পুলিশ আজ যে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে তাতে তাদের ফ্যাসিবাদী চরিত্রের প্রকাশ ঘটেছে। তারা সরকারের পেটোয়া বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। পুলিশ আর আওয়ামী লীগ আজকে একযোগে হামলা চালিয়েছে। তারা সিনিয়র নেতাদেরও রেহাই দেয়নি। ততে আমরা দমে যাবো না। রাজপথেই ফয়সালা হবে। এই সরকারের পতন ঘটিয়ে তবে আমরা ঘরে ফিরব।”

তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন,” এই কর্মসূচি পালনে পুলিশের অনুমতির দরকার নেই। আমরা তো সরকার পতনের আন্দোলন করছি। পুলিশ তো সরকারের বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। তারা আর জনগণের বাহিনী নয়। তারা কি আমাদের অনুমতি দেবে? আমরা অবহিত করেছি পুলিশকে। তাদের দায়িত্ব ছিলো আমাদের নিরাপত্তা দেয়া।”

এর জবাবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন,” বিএনপি যে একটা সন্ত্রাসী দল সেটা আবার প্রমাণ হলো। তারা আজ কর্মসূচি পালনের নামে পুলিশের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাঙচুর এবং গাড়িতে আগুন দিয়েছে। তারা আগুন সন্ত্রাসে বিশ^াসী। পুলিশ বা আওয়ামী লীগের কেউ হামলা করেনি।”

তার কথা,” আমরা এখন সতর্ক অবস্থানে আছি। আমাদের নেতা-কর্মীরা মাঠে আছে।এই সন্ত্রাসী কাজ আর করতে দেবো না।”

বিএনপির সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে পুলিশ চেকপোস্টহ বিভিন্ন এলাকায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের মোবাইল ফোন তল্লাশি করছে। ফোনের ছবি, এসএমএস, কললিস্ট সব পরীক্ষা করছে। এসব দেখে তাদের গ্রেপ্তারও করা হয়। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ আজম খান বলেন,” এটা নাগরিকদের ব্যাক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন। পুলিশের হয়রানি সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এখানে আইন বলতে আর কিছু নাই। সরকার ইচ্ছে মতো পুলিশকে ব্যবহার করছে।”

আর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন,” কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া পুশিল এটা পারেনা। সংবিধান এবং আইন নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার দিয়েছে।”

তার কথা,” এটা শুধু এখন নয়, বিএনপির সময়ও আমরা দেখেছি সভা সমাবেশ বা আন্দোলনের সময় পুলিশ মোবাইল ফোন তল্লাশি করে। আসলে এর মূল উদ্দেশ্য হয়রানি করা। সরকার যা বলে পুলিশ তাই করে।”

অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন,” সংঘাত তো শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু বিপদের বিষয় হলো সরকার দলের নেতা-কর্মীরা পুলিশের ভূমিকায় নেমেছে। তারা বলতে শুনলাম আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় মাঠে আছে। তাহলে পুলিশেল কী কাজ। পুলিশ কেস আছে? এভাবে চললে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে।”

আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন,” আজকে যে সংঘাত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে তাতে মনে হচ্ছে রাজপথের রাজনীতিতে সংঘাত সংঘর্ষ ফিরে আসছে। দুইটি দল যে ভাবে পয়েন্ট অব নো রিটার্নে চলে যাচ্ছে তাতে আশঙ্কা বাড়ছে। তবে আজকে যা হয়েছে তার চেয়ে অতীতে অনেক ভয়াবহ সংঘাত, হামলার ঘটনা ঘটেছে। আমরা চাইনা সেই অবস্থা ফিরে আসুক।

এসএইচ-০৪/২৯/২৩ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)