বিএনপি’র আন্দোলন এবং বিদেশি চাপ সামলাতে নির্বাচনে আ’লীগের কৌশল!

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ-বিএনপি’র মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, গেলো একযুগ ধরে সেটা মূলত: চলছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে কঠোর আন্দোলনের কৌশল নিয়েছিলো বিএনপি। কিন্তু সে আন্দোলন সফল হয়নি। কৌশলের খেলায় জয়ী হয় আওয়ামী লীগ।

অনেকেই মনে করেন, বিএনপি’র নির্বাচন বর্জন ছিলো আওয়ামী লীগের ফাঁদে পা দেয়া। আওয়ামী লীগ সেসময় বিএনপিকে নির্বাচন আনার কোন চেষ্টাই করেনি। বরং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের আয়োজন সম্পন্ন করে। আর রাজপথে নেয় বিএনপিকে ঠেকানোর কৌশল।

নির্বাচনে দেড়শো’রও বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিজয় ছিলো বড় চমক। এসবের কোন জবাব ছিলো না বিএনপি’র কাছে।

অন্যদিকে ২০১৮ সালের নির্বাচনে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল বিএনপিকে নির্বাচনে এনে অংশগ্রহণমূলক ভোটের আয়োজন করতে চেয়েছে আওয়ামী লীগ।

খালেদা জিয়া-তারেক রহমানের মতো শীর্ষ নেতাদের সাজা, দুর্বল সাংগঠনিক অবস্থা এবং পরপর দুটি নির্বাচনে অংশ না নিলে নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি সামলাতে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি।

নির্বাচনের আগে বিএনপি’র নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে সরকারের সঙ্গে সংলাপও করে বিএনপি। কিন্তু বিতর্কিত সেই নির্বাচনে সুবিধা করতে পারেনি দলটি।

রাজনৈতিক কৌশলের খেলায় সেবারও জয়ী হয় আওয়ামী লীগ।

কিন্তু ২০২৩ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন।

অনেকেই মনে করছেন আওয়ামী লীগের সামনে বেশ কিছু বাস্তব চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে।

একদিকে বিএনপি’র জোরদার আন্দোলন, অন্যদিকে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলোর চাপ।

এমন অবস্থায় আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগের কৌশল কী হতে যাচ্ছে?

বিএনপি রাজপথে সক্রিয় আছে প্রায় একবছর ধরে। দলটির সমাবেশ এবং পদযাত্রার মতো কর্মসূচিগুলোতে লোকজমায়েত প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যেও।

ফলে বিএনপি’র মতো আওয়ামীলীগও রাজপথে পালন করছে একের পর এক সমাবেশের কর্মসূচি।

কখনো শান্তি সমাবেশ আবার কখনো শান্তি ও উন্নয়ন শোভাযাত্রার মাধ্যমে রাজপথে উপস্থিতি বাড়িয়েছে দলটি।

সবশেষ বিএনপির তিনটি সংগঠনের তারুণ্যের সমাবেশের বিপরীতে আওয়ামী লীগেরও তিনটি সংগঠন একইরকম সমাবেশের ঘোষণা দেয়। যার মূল উদ্দেশ্য নির্বাচনের মাঠ যেন হাতছাড়া না হয়।

তবে রাজপথে উপস্থিতি বাড়ালেও এটাকে বিএনপি’র পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে দেখছে না আওয়ামী লীগ।

দলটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, নির্বাচনী প্রচারণা এবং কৌশলের অংশ হিসেবেই জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে সমাবেশ করছে আওয়ামী লীগ। তিনি জানান, এরকম সমাবেশের জন্য দলের ভেতর থেকেই নেতা-কর্মীর চাপ আছে।

“আমরা এখানে ইলেকশনের প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করছি। শান্তি সমাবেশ বা শোভাযাত্রা এগুলোর ভেতর দিয়েই রাজনৈতিকভাবে দল এবং সরকারের কর্মকাণ্ড আমরা তুলে ধরছি। এটা নির্বাচনের কৌশল। এটা কারো বিরুদ্ধে না, কাউকে ঠেকানোর জন্যও না।”

আওয়ামী লীগ মনে করছে, এবারের নির্বাচকে ঘিরে বিদেশি চাপ মূলত: নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি-না সেটা নিয়ে।

দলটির মূল্যায়ন হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পশ্চিমা দেশগুলো এখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কথা বলবে না। সুতরাং কোন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, তা নিয়ে বিদেশি চাপ নেই।

দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “বিদেশিরা কখনোই তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলে না। সেটা তারা আইন অনুযায়ী বলতেও পারেনা। বাংলাদেশে সংবিধানের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। এখানে যে সংবিধানের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে সেটাই তাদের জানানো হয়েছে।”

আওয়ামী লীগ এখন গুরুত্ব দিচ্ছে, আগামী নির্বাচন যে সুষ্ঠু হবে, বিদেশি রাষ্ট্রগুলোকে সেটা বোঝানোর উপর।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ বাহাউদ্দিন নাছিম বলছেন, “বিদেশিরা সুষ্ঠু নির্বাচন চায়, আমরাও সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। এখানে আমাদের সঙ্গে তো বিদেশিদের কথার কোন পার্থক্য নেই। অর্থাৎ নির্বাচনটা এখানে হওয়া দরকার। এটাই মূল কথা। এবং সেই নির্বাচনটা হবে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করে।”

তিনি বলছেন, আওয়ামী লীগের লক্ষ্য নির্বাচন শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ করা। যেন এটা গ্রহণযোগ্যতা পায়।

তবে বিদেশি রাষ্ট্রগুলো কখন, কোন পদক্ষেপ নেয় সেটা নিয়েও আওয়ামী লীগের মধ্যে একধরণের অস্বস্তি আছে।

র‍্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা এবং মার্কিন ভিসা নীতির পর সেটা বেড়েছে।

তবে দলের ভেতরে কথা বলে জানা যাচ্ছে, বিদেশিদের পদক্ষেপে দল, সরকার কিংবা বিশেষত: কর্মীদের মনোবলে যেন প্রভাব না পড়ে সে বিষয়েও দৃষ্টি আছে আওয়ামী লীগের।

এরই প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি ঢাকা-১৭ আসনের উপ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলমের উপর হামলা ইস্যুতে প্রতিক্রিয়া দেয়া ১৩ বিদেশি দূতকে একযোগে তলব করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়।

বৈঠকে ‘কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণে বাংলাদেশের অসন্তোষের’ কথা জানিয়ে দেয়া হয় বিদেশি দূতদের।

সম্প্রতি ঢাকা-১৭ আসনের উপ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলমের উপর হামলা ইস্যুতে প্রতিক্রিয়া দেয়া ১৩ বিদেশি দূতকে একযোগে তলব করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেন সুষ্ঠু হয় সে বিষয়ে বিদেশিদের চাপ আছে এতে কোন সন্দেহ নেই।

তবে এটাও ঠিক সে নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে সে বিষয়ে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর নির্দিষ্ট কোন বক্তব্য নেই। আওয়ামী লীগ সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করতে চায়।

এর বিপরীতে বিএনপি বলছে তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া নির্বাচন অংশ নেবে না। বিএনপি যদি আবারো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকে তাহলে আবারো বিএনপিকে ছাড়াই নির্বাচনের পরিস্থিতি তৈরি হবে বলে অনেকেই মনে করেন।

বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরেও আলোচনা আছে। তারা মনে করছে, নির্বাচন সুষ্ঠু হলে সেখানে বিএনপি’র না থাকা বড় কোন সংকটের কারণ হবে না কিংবা গ্রহণযোগ্যতার সংকট তৈরি করবে না।

আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ বলেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচন অংশ নেবে এটাই বড় কথা। বিএনপি বা অন্য কোন দল না এলে আওয়ামী লীগ কারো জন্য অপেক্ষা করবে না।

আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যেই তৃণমূলে দলীয় কর্মসূচি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। যার মূল উদ্দেশ্য নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করা।

ইতোমধ্যেই আগামী ছয়ই অগাস্ট ঢাকায় তৃণমূল নেতাদের নিয়ে বিশেষ বর্ধিত সভা ডেকেছে দলটি।

বাহাউদ্দিন নাছিম জানান, বর্ধিত সভা থেকেই তৃণমূলে নির্বাচনী প্রস্তুতির বার্তা দেয়া হবে।

দলের বাইরে মহাজোটের শরীক দলগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ বাড়িয়েছে আওয়ামী লীগ।

সম্প্রতি মহাজোটের শরীক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছেন খোদ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এছাড়া নির্বাচনের আগে অক্টোবরের মধ্যেই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের উদ্বোধন করতে যাচ্ছে সরকার।

ইতোমধ্যেই মেট্রোরেলের পূর্ণাঙ্গ উদ্বোধন ডিসেম্বরের বদলে এগিয়ে আনা হয়েছে অক্টোবর মাসে।

এসব কিছুর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ চায় দেশের ভেতরে রাজনীতিতে একটা নির্বাচনের আবহ তৈরি করতে।

সবমিলিয়ে বিএনপি’র সরকার পতনের আন্দোলনের বিপরীতে রাজপথে পাল্টা কর্মসূচি আর নির্বাচন নিয়ে বিদেশী চাপের বিপরীতে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজনীতিকে নির্বাচনমুখী করা -আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের কৌশল আপাতত: এটাই।

এসএইচ-০৪/৩০/২৩ (তাফসীর বাবু,বিবিসি)