ঢাকা অচল করার মতো কর্মসূচি বিএনপিকে করতে দেবে না আ’লীগ!

অবরোধ, ঘেরাও, অবস্থান—ঢাকা অচল করার মতো এসব কর্মসূচি বিএনপিকে করতে দেবে না আওয়ামী লীগ। এ ধরনের কর্মসূচি এলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দলীয়ভাবে আওয়ামী লীগ সর্বাত্মকভাবে প্রতিরোধ করবে। বিএনপি ও তাদের মিত্ররা শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করতে চাইলে তাতে বড় বাধা তৈরি করবে না ক্ষমতাসীনেরা। তবে একই ধরনের পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে নজরদারি রাখবে তারা।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী একাধিক সূত্র বলছে, অবরোধ, ঘেরাও, অবস্থান—এ ধরনের কর্মসূচিকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির এবং সরকার অচল করার কর্মসূচি বলে মনে করে আওয়ামী লীগ। এর সঙ্গে গণতান্ত্রিক অধিকার ও নির্বাচন সুষ্ঠু করার সম্পর্ক নেই। তাই এ ধরনের কর্মসূচি কঠোর হাতে দমন করা হবে। তবে নির্বাচনের প্রস্তুতি বা বিরোধীদের সভা-সমাবেশকে স্বাভাবিক কর্মসূচি হিসেবে বিবেচনা করবে আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, বিএনপির শনিবারের ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি সুযোগ পেলেই ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালের মতো জ্বালাও-পোড়াও শুরু করবে—আওয়ামী লীগের এই ব্যাখ্যা আরও জোর পাবে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়ন্ত্রণ কতটা শক্ত, এ বিষয়ে প্রশাসন-রাজনৈতিক মহলে কানাঘুষা শোনা গেছে। শনিবার বিএনপির অবস্থান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগের যৌথ তৎপরতায় এই সংশয় কেটে গেছে।

আওয়ামী লীগ ও সরকারের নীতিনির্ধারণী সূত্র জানিয়েছে, মার্কিন ভিসা নীতি, র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও পশ্চিমা চাপ—এসব কারণে বিরোধীদের আন্দোলন কর্মসূচিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যত্রতত্র ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত আছে। এ জন্য এত দিন পুলিশ খুব বেশি চড়াও হয়নি।

ভবিষ্যতে সাধারণ সভা-সমাবেশে এই নীতি বহাল থাকবে। কিন্তু শনিবার বিএনপি ও তাদের মিত্রদের ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি ছিল ‘অচলাবস্থা’ সৃষ্টির কর্মসূচি। এ জন্যে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও আক্রমণাত্মক ভূমিকায় নামে।

বিরোধী দলের ওই কর্মসূচি নিয়ে আওয়ামী লীগের মূল্যায়ন হচ্ছে—বিএনপি শনিবার সরকার ও আওয়ামী লীগের শক্তি যাচাই করতে চেয়েছে। বিএনপি যথাযথ জবাব পেয়েছে। সেদিন পুলিশ ও দলের নেতা–কর্মীদের ভূমিকায় দুটি অর্জন দেখছে আওয়ামী লীগ।

প্রথমত, মার্কিন ভিসা নীতির কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দমে যাবে মনে করা হচ্ছিল। অনেকে মনে করেছিলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে ভয় তৈরি হয়েছে।

কিন্তু শনিবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিএনপিকে নিষ্ক্রিয় করার ব্যাপারে ত্বরিত ব্যবস্থা নিয়েছে। একই সঙ্গে গয়েশ্বর রায়কে ‘আপ্যায়নের’ মাধ্যমে চতুরতার পরিচয়ও দেখিয়েছে পুলিশ। দ্বিতীয়ত, বিএনপির কর্মসূচির দিন আওয়ামী লীগ কেন পাল্টা কর্মসূচি দিচ্ছে—এ নিয়ে বিভিন্ন মহলের প্রশ্নের মুখে পড়েছে আওয়ামী লীগ। পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে না থাকলে বিএনপি ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে, এটাও প্রমাণিত হয়েছে বলে দলটি মনে করছে।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগ রাজপথ ছেড়ে দিলে বিএনপি কী করতে পারে, শনিবার এটা প্রমাণিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ ওই দিন মাঠে থাকতে চায়নি। কিন্তু বিএনপি যখন ধ্বংসাত্মক হওয়ার চেষ্টা করেছে, তখনই আওয়ামী লীগ মাঠে নেমেছে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘বিএনপি নৈরাজ্য সৃষ্টি করে ঢাকা অচল বা সরকারকে অচল করতে চায়। এটা তো গণতান্ত্রিক কর্মসূচি নয়। সরকার তো জনগণের জানমালের ক্ষতি ও মানুষের দুর্ভোগ হতে দিতে পারে না। সরকার ও আওয়ামী লীগ শক্ত অবস্থানে থাকবে।’

ভোটের এখনো প্রায় পাঁচ মাস বাকি। এত আগে বিএনপিকে রাজপথ থেকে একেবারে উঠিয়ে দিতে গেলে দেশে-বিদেশে সমালোচনা হতে পারে, এটিও বিবেচনায় রাখছে আওয়ামী লীগ।

ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, সরকার একটি অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে আন্তরিক নয়—এটা প্রমাণ হয়ে পড়ুক, তা তাঁরা চাইছেন না। বিএনপিসহ বিরোধীদের ভোটে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না—এমন অভিযোগ যাতে না ওঠে, সে ব্যাপারেও তাঁরা সতর্ক। এ জন্য বিএনপিকে সাধারণ সভা-সমাবেশ করতে দেওয়া হবে। তবে সাধারণ সভা-সমাবেশের আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুমোদন নিতে হবে। তবে অনুমোদনহীন যেকোনো কর্মসূচিতে পুলিশ ঝামেলা তৈরি করবে। যেমন স্থান নির্বাচনের বেলায় পুলিশের দ্বিমত থাকতে পারে। বড় জমায়েতের ক্ষেত্রে তল্লাশি জোরদার করা হতে পারে।

সরকার ও আওয়ামী লীগের সূত্র বলছে, মার্কিন ভিসা নীতি ও র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং পশ্চিমা দেশগুলোর চাপের বিষয়টিও একেবারে ভুলে যায়নি সরকার। এ জন্য ভোটের আগপর্যন্ত যতটা সম্ভব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘সুরক্ষা’ দরকার আছে। বিএনপি নেতা গয়েশ্বর রায়কে পেটানোর পর আপ্যায়ন করা এবং আমানউল্লাহ আমানকে আটকের পর ফল নিয়ে দেখতে যাওয়ার পেছনেও কৌশল আছে। এর পেছনে একটা লক্ষ্য ছিল বিএনপির কর্মীদের মধ্যে নেতাদের নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো। এ ছাড়া সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভিন্ন ভাবমূর্তি দেখানো এবং মারপিটের উল্টো ব্যাখ্যা তৈরি করা।

আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নীতিনির্ধারকের ধারণা, শনিবারের কর্মসূচি সফল না হওয়ায় বিএনপি আগস্টে আর এই পথে হাঁটবে না। তারা সেপ্টেম্বরে আবারও মরণকামড় দিতে চাইবে। এ সময়টায় আওয়ামী লীগের কর্মীদের চাঙা রেখে শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। এ সময় প্রশাসনকেও নিজেদের পরিকল্পনা সাজাতে হবে। অর্থাৎ সরকার ও বিরোধী দল—দুই পক্ষই একটা দম নেওয়ার ফুরসত পেল মনে হয়।

গত ডিসেম্বর থেকে বিএনপির পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে আওয়ামী লীগ রাজপথে ছিল। এখন থেকে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত প্রতিদিনই কোনো না কোনো কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। যাতে কেউ বিএনপির পাল্টা হিসেবে প্রচার না করতে পারে। আগস্ট শোকের মাসে এমনিতেই প্রতিদিন কর্মসূচি থাকবে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা পর্যন্ত তা টেনে নেওয়া হবে।

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, বিএনপি ঘোষিত কর্মসূচির বাইরেও নানা উপায়ে ঢাকা অচল করার চেষ্টা করতে পারে। সে জন্য প্রতিদিনই সতর্ক পাহারা, সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল, শান্তি সমাবেশে কর্মসূচি পালন করা হবে। তবে নেতা-কর্মীরা ক্লান্ত যাতে না হন, সে বিষয়টিও মাথায় রাখা হবে।

ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, গতকাল রোববার বিএনপির কোনো কর্মসূচি না থাকলেও আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড ও থানায় বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচি ছিল। তবে এসব কর্মসূচি জোরালোভাবে পালন করতে হবে, এমন কোনো নির্দেশনা ছিল না। ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ দুপুরে তেজগাঁওয়ে কর্মিসভা করে। থানা ও ওয়ার্ডে দায়সারাভাবে বিক্ষোভ পালন করা হয়। মহানগর দক্ষিণে সহযোগী সংগঠনগুলো তৎপর ছিল। থানা ও ওয়ার্ডে খুব একটা জোর দেওয়া হয়নি।

মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আজ বিএনপির কর্মসূচি থাকায় পাড়ায় পাড়ায় সতর্ক পাহারা দেওয়ার বিষয়ে কড়া নির্দেশনা আছে। কেন্দ্রীয় নেতারাও তা পর্যবেক্ষণ করবেন। তিনি জানান, শনিবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সকাল থেকে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নেতাদের নিয়ে অবস্থান করেন। দিনভর বিএনপির ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি কীভাবে দমন করা হয়েছে, তা পর্যবেক্ষণ করে সন্ধ্যায় দলীয় কার্যালয় ছাড়েন।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ ও মহাসমাবেশে বিপুলসংখ্যক মানুষের উপস্থিতি নিয়ে এখন আলোচনা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সমাবেশ করলেও তা দৃষ্টি কাড়তে পারছে না—এমন আক্ষেপ আছে কোনো কোনো নেতার। এ জন্য একটি বড় সমাবেশ করার পরিকল্পনা আছে ক্ষমতাসীন দলের।

ওই সূত্র আরও জানায়, সোমবার আগারগাঁওয়ে পুরোনো বাণিজ্য মেলা মাঠে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ও উত্তর আওয়ামী লীগের সম্মিলিতভাবে একটি সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা থেকে সরে আসে দল। বরং প্রস্তুতি নিয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ বা অনেক দূর পর্যন্ত দেখানো যায়—এমন কোনো স্থানে সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এসএইচ-০১/৩১/২৩ (অনলাইন ডেস্ক, সূত্র : প্রথম আলো)