শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা বাড়ার কারণ কি?

তিনটি নাম। মঞ্জু শেখ, তানভীর আহমেদ ও সামিউল রহমান। তিনজনই তরুণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এদের কেউ সাহিত্য নিয়ে পড়ছিলেন, কেউ প্রকৌশল। পড়ছিলেন শব্দটা লিখতে হলো কারণ, তাঁরা এখন আর পড়ছেন না। পড়াশোনার পাঠ চিরজীবনের জন্য চুকিয়ে ফেলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসেই আত্মহত্যা করে, সহপাঠী ও সহশিক্ষার্থীদের মনে এক গভীর ক্ষত তৈরি করে দিয়েছেন। কিন্তু কেন?

শিক্ষার নানা ধাপ পেরিয়ে একজন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা নিতে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে আসেন। তরুণ চোখগুলোতে থাকে নানা স্বপ্ন। অসম্ভবকে জয় করার আকাঙ্ক্ষা পোষেন তাঁরা বুকের ভেতরে। এমনটাই তো হওয়ার কথা। কিন্তু দেখা যায় নানা বাস্তবতার কারণে অনেকের কাছেই স্বপ্নটা অধরা থেকে যায়। জীবন তাঁকে নিয়ে যায় অন্য কোনো ঠিকানার দিকে। একজন তরুণ এই সব চড়াই-উৎরাই পেরিয়েই এগিয়ে যান। তাঁদের এই লড়াই অন্য সব বয়সী মানুষকে লড়াইয়ের প্রেরণা দেয়। কিন্তু এই তরুণেরাই যদি আশাহত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন, তবে দুর্ভাবনা তো থাকেই।

শুরুতে বলা নামগুলোর দিকে একটু তাকানো যাক। ঘটনাটি খুব বেশি দিন আগের নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থী মঞ্জু শেখ। গত ২১ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলে তিনি গলায় মাফলার পেঁচিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে ছিলেন। হলের মুকুল মুর্শেদ নামের এক শিক্ষার্থী এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন। তিনি লেখেন, ‘ওর নাম শেখ মঞ্জু। প্রথম বর্ষে পরিচয়। বাংলা বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করেছে। এই তো কিছুদিন আগেও টিভি রুমে এসে প্রতিনিয়ত টেবিল টেনিস খেলত। টিভি রুমে কেউ থাকুক আর না থাকুক মঞ্জুকে ঠিকই পাওয়া যেত। কিন্তু হুট করেই মঞ্জুকে চুপচাপ আর একা একা চলতে দেখেছি। মঞ্জু আজ নিজের রুমেই আত্মহত্যা করেছে।’

এর কয়েক মাস আগে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট) তানভীর আহমেদ (২৪) নামের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। ১৭ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ লেফটেন্যান্ট সেলিম হল থেকে তাঁকে উদ্ধার করা। তানভীর আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৮তম ব্যাচের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি শহীদ লেফটেন্যান্ট সেলিম হলের ৩৫৫ নম্বর কক্ষে থাকতেন। (সূত্র: প্রথম আলো)

এর দুদিন পর রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) শিক্ষার্থী সামিউল রহমানকে ঝুলন্ত আবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। গত ২০ মে নগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানার সাধুর মোড় এলাকার রহিমা লজ নামে ছাত্রাবাস থেকে তাঁকে উদ্ধার করা হয়। সামিউল রুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৭ সিরিজের শিক্ষার্থী ছিলেন। (সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন)

দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই ধরনের আত্মহত্যার ঘটনা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। কেন শিক্ষার্থীরা শিক্ষাঙ্গনে পড়ালেখা করতে এসে আত্মহত্যার দিকে পা বাড়াচ্ছেন। কেন তাঁরা সম্ভাবনাময় জীবনকে এভাবে শেষ করে দিচ্ছেন।

বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ২০২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল ১০১ এবং ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৩২-এ। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত আট মাসে ৩৬১ জন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। গত আট মাসে গড়ে প্রতি মাসে প্রায় ৪৫ দশমিক ১৩ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। যেখানে স্কুল শিক্ষার্থী ১৬৯ জন, কলেজ শিক্ষার্থী ৯৬ জন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ৬৬ জন এবং মাদ্রাসা শিক্ষার্থী রয়েছে ৩০ জন। ৩৬১ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্র ১৪৭ ও ছাত্রী ২১৪ জন।

প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত আট মাসে আত্মহত্যা করা ৩৬১ শিক্ষার্থীর ৫৯ দশমিক ৩০ শতাংশই ছাত্রী। ছাত্রীদের আত্মহত্যার কারণ বিবেচনায় দেখা যায় ২৬ দশমিক ৬০ শতাংশই অভিমান, প্রেমঘটিত কারণে ১৮ দশমিক ৭০ শতাংশ, মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে ৮ দশমিক ৪০ শতাংশ, পারিবারিক বিবাদের কারণে ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ, আর ৫ দশমিক ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী যৌন হয়রানির কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। এ ছাড়া পড়াশোনার চাপ ও ব্যর্থতার কারণে আত্মহত্যা করেন ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী।

শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পেছনে সবচেয়ে বড় যে কারণটি কাজ করে, তা হলো অভিমান। এটি শুধু ছাত্রীদের ক্ষেত্রে নয়, ছাত্রদের ক্ষেত্রেও সত্য। আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, আত্মহত্যা করা মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩১ দশমিক ৬০ শতাংশই অভিমানের কারণে আত্মহত্যা করেছে। এর পরের অবস্থানেই আছে প্রেমঘটিত কারণ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান সাইকোলজিস্ট ড. আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘আত্মহত্যার প্রবণতা কমানো যায়, যদি কাউন্সেলিংয়ের সহযোগিতা নেওয়া হয়। মানুষের মন খারাপ, বিষণ্ণতা, অবসাদ হতেই পারে। সে সময় তাকে মনোবিজ্ঞানীর কাছে নিয়ে গেলে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেকাংশে কমতে পারে। দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা অপ্রতুল। মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়ে কাউন্সেলিং সেবা নিশ্চিত করা দরকার। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন উদ্যোগ নিতে পারে। পাশাপাশি ব্যক্তি যে পরিবেশে জীবনযাপন করছেন, তার মধ্যে স্বচ্ছতা, সাম্য ও ন্যয্যতা নিশ্চিত করা না গেলে টেকসই মানসিক স্বাস্থ্য ধরে রাখা কষ্টকর। তাই ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থে নিরাপদ আবাসন, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার, উদ্বেগহীন শিক্ষাব্যবস্থা, টেকসই মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’

সমাজ বা শুভাকাঙ্ক্ষীরা প্রায়ই সাফল্যের বদলে ব্যর্থতা নিয়ে বেশি কথা বলেন। জীবনে সফল হওয়ার জন্য তাড়না দিতেই হয়তো সমাজের তরুণ সদস্যটিকে প্রতিনিয়ত সতর্ক করার চেষ্টা করেন তাঁরা। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হয় অনেক ক্ষেত্রেই। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘নিজেরা করি’-এর সমন্বয়ক খুশী কবির মনে করেন, অনেক কারণেই মানুষ আত্মহত্যা করতে পারে। এর মধ্যে হতাশাই সবচেয়ে বড় কারণ। বিষণ্ণতায় ভোগা মানুষ যখন নিজের আশপাশে কাউকে পায় না, তখন সে বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হয়। ধীরে ধীরে আত্মহত্যার মতো চরম সিদ্ধান্তের দিকে এগিয়ে যায়।

খুশী কবির বলেন, ডায়াবেটিসের মতো বাইপোলার ডিসঅর্ডারও একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ। এ ক্ষেত্রেও ডায়াবেটিসের মতো ওষুধের পাশাপাশি কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। তবে বিষয়টি শুধু ওষুধ দিয়ে সারে না। পাশাপাশি কাউন্সেলিং, পরিবারের সদস্যদেরও সময় দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে বন্ধু হয়ে, ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমরা তার পাশে থাকতে পারি। এতে আত্মহত্যার প্রবণতা কমবে। আত্মহত্যা রোধে সমাজকে সচেতন হতে হবে। সামাজিক মূল্যবোধে পরিবর্তন ঘটাতে হবে।

এখনকার শিক্ষার্থীরা নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে অনেক বেশি চিন্তিত। এই সময়ের তরুণ-তরুণীরা নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে বেশি। এই আত্মকেন্দ্রিক তরুণেরা কোনো কারণে চরম হতাশ হলে আত্নহত্যার পথ বেছে নেয় বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইমতিয়াজ মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘মানুষের জীবনে একটা উদ্দেশ্য থাকতে হয়। না হলে জীবনটা আনন্দদায়ক হয় না। এই জীবন নিয়ে মানুষ একপর্যায়ে আশাহীন হয়ে পড়ে। তখন জীবনের মায়া ছেড়ে আত্মহত্যার দিকে পা বাড়ায়। ষাট, সত্তর বা আশির দশকের আগে পর্যন্ত তরুণ-তরুণীদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা কম ছিল। সে সময় সারা দেশে ছাত্র আন্দোলনের পরিধি ছিল বিস্তৃত। নারী আন্দোলনও ছিল তুঙ্গে। এসবের কারণে তরুণ-তরুণীদের মনে একটা লক্ষ্য থাকত।’

ইমতিয়াজ মাহমুদ বলেন, ‘মানুষের জীবনের একটা আদর্শ থাকতে হয়, যার জন্য বেঁচে থাকা যায়। সেটা যখন থাকে না, তখন মানুষ বাঁচার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলে। তরুণদের জীবন আনন্দময় হলে সমাজে আত্মহত্যা প্রবণতা কমতে পারে।’

এসএইচ-০৪/১০/২৩ (অনলাইন ডেস্ক, সূত্র : ইনডিপেনডেন্ট)