ভারতের সম্পর্ক শুধু আ’লীগের সাথেই, বিএনপির নয়!

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিশেষ আমন্ত্রণে জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রবিবার বিকেলেই বাংলাদেশে ফিরে গেছেন। গত শুক্রবার দিল্লিতে পা রাখার কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদীর ‘ফলপ্রসূ’ দ্বিপাক্ষিক বৈঠকও হয়েছে।

নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে এনিয়ে গত ন’বছরে দিল্লি, ঢাকা বা শান্তিনিকেতনে দু’জনের মধ্যে অন্তত ন’বার মুখোমুখি দেখা হল। এছাড়া ভার্চুয়ালি তাঁদের মধ্যে কতবার বৈঠক হয়েছে, তার কোনও ইয়ত্তা নেই।

লক্ষ্যণীয় হল, এই পুরো সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের যারা প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি (পার্লামেন্টে না-হলেও), সেই বিএনপি’র সঙ্গে ভারতীয় নেতৃত্বর প্রকাশ্যে অন্তত কোনও বৈঠকই হয়নি। না বাংলাদেশে, না ভারতে।

প্রধানমন্ত্রী মোদী তো দূরের কথা, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা সিনিয়র ক্যাবিনেট মন্ত্রীরাও যখন বাংলাদেশ সফর করেছেন, তাঁরাও কেউ বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বা ওই দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে দেখা করেননি।

অথচ এই সময়ের মধ্যে শুধু দু’দেশের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের মধ্যেই নয়, সরকারি বা দলীয় পর্যায়েও বিজেপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে বহুবার পাল্টাপাল্টি সফর, মতবিনিময় ইত্যাদি হয়েছে। কখনো ট্র্যাক ওয়ান, কখনো বা ট্র্যাক-টু পর্যায়ে।

অন্যদিকে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে ভারত শেষবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ২০১২ সালের অক্টোবরে। তখন দিল্লির ক্ষমতায় ছিল মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে ইউপিএ-টু সরকার, দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন সালমান খুরশিদ।

দিল্লির সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমহা রাও (ডানে)। ১৯৯৫

সেই সফরের পরও ভারতীয় নেতৃত্ব ও বিএনপি’র মধ্যে শীতলতা আদৌ কমেনি।

২০১৪ সালের মে মাসে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি ভারতের ক্ষমতায় আসার পরও সে পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন হয়নি। বরং বিএনপি’র মধ্যে এই ধারণাই ক্রমশ বদ্ধমূল হয়েছে যে ভারত বাংলাদেশে শুধু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গেই সম্পর্ক রেখে চলে।

বিএনপি’র শীর্ষ নেতারা ভারতের এই ‘অবস্থানে’র সমালোচনা করে বহুবার প্রকাশ্যেই কথা বলেছেন।

কিন্তু বাস্তবেও পরিস্থিতিটা কী সত্যিই সে রকম? বাংলাদেশে ভারত যদি সত্যিই শুধু আওয়ামী লীগের সঙ্গেই সম্পর্ক রেখে চলে, তাহলে সেটা কেন?

নাকি পর্দার আড়ালে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গেও তাদের যোগাযোগ আছে?

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের রাজনীতি, কূটনীতি বা নিরাপত্তাগত বিষয়গুলো নিয়ে যারা ওয়াকিবহাল এবং নিয়মিত মাথা ঘামান – দিল্লিতে এমন একাধিক বিশেষজ্ঞর সঙ্গে কথা বলে বিবিসি বাংলা এই প্রতিবেদনে সেই প্রশ্নগুলোরই উত্তর খুঁজেছে।

স্বাধীন বাংলাদেশের অর্ধশতাব্দীরও বেশি ইতিহাসে মোটামুটি তেইশ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকেছে। বাকি ২৭ বছর দেশটিতে হয় সামরিক শাসন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার অথবা বিএনপি সরকার ছিল।

ভারতে পর্যবেক্ষকরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, এই ২৭ বছরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক থেমে থাকেনি।

এমনকি শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের মাত্র পাঁচদিনের মাথায় ঢাকায় ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত সমর সেন সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাক আহমেদের সঙ্গে।

পরদিন দু’জনের হাসিমুখে করমর্দনের ছবিও বেরিয়েছিলে ভারতের ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকার প্রথম পাতায়।

“পুরো আশির দশকটা জুড়েই জেনারেল এরশাদের সরকারের সঙ্গেও ভারতের কিন্তু রীতিমতো সুসম্পর্ক ছিল”, মনে করিয়ে দিচ্ছেন ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, বিজেপি নেতা তথা বর্ষীয়ান সাংবাদিক এম জে আকবর।

কয়েক বছর আগেও যারা ভারত সরকারের হয়ে ‘বাংলাদেশ অ্যাফেয়ার্স’ দেখতেন, নরেন্দ্র মোদীর প্রথম ক্যাবিনেটের সদস্য মি আকবর তাদেরই একজন।

তিনি বিবিসি বাংলাকে যা বলেছেন, তার মোদ্দা কথাটা হল – ভারতীয় নেতৃত্ব বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ছাড়াও আরও বহু দলের সঙ্গে বহু বছর ধরে ‘ডিল করেছে’।

সাম্প্রতিক অতীতেও জাতীয় পার্টি, এমনকি সূফী ভাবধারার বহু ইসলামপন্থী দলকেও ভারতে সরকারিভাবে ‘দাওয়াত’ দিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। ওই সব দলের নেতারা দিল্লিতে এসে ভারতের নেতা-মন্ত্রী, নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠকও করে গেছেন।

কিন্তু বিএনপি’র কথাটা একেবারেই আলাদা – বিশেষ করে ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মেয়াদে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময়কার অভিজ্ঞতার পর থেকে।

দিল্লিতে প্রবীণ নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ শান্তনু মুখার্জি ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসেও দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন।

তিনি বলেন, “বিএনপি আমলে ভারতের নিরাপত্তাগত স্বার্থ যেভাবে কম্প্রোমাইজড হয়েছিল তাতে ওই দলটিকে নিয়ে আমাদের দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও সন্দেহ থাকাটা খুব স্বাভাবিক।”

বিবিসি বাংলাকে তিনি আরও বলছিলেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জঙ্গী গোষ্ঠীগুলো সে সময় বাংলাদেশে ঢালাও আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়েছিল – এমনকি সরকারি মদতে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ওই জঙ্গীদের জন্য বিপুল পরিমাণ অস্ত্রের চালান পর্যন্ত পাঠানো হয়েছিল।

“অথচ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সেই সব কর্মকাণ্ড সমূলে উৎপাটন করেছে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি এখন অনেকটাই শান্ত।”

“যে রাজনৈতিক দলটির মদতে ভারতেরই একটা বিস্তীর্ণ অংশে দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গীবাদ প্রশ্রয় পেয়েছে, তাদের সঙ্গে নতুন করে কোনও সম্পর্ক স্থাপনের আগে ভারতকে যে বহুবার ভাবতে হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই”, বলছিলেন মি মুখার্জি।

শুধু নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নয়, অর্থনীতি বা বাণিজ্যেও বিএনপি আমলে ভারতের অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর ছিল না।

ওপি জিন্দাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ শ্রীরাধা দত্ত যেমন বলছিলেন, “খালেদা জিয়ার আমলেই কিন্তু এনার্জি ডিল (জ্বালানি চুক্তি) করার চেষ্টা ভেস্তে গিয়েছিল, বাংলাদেশে বিপুল বিনিয়োগের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েও ভারতের টাটা শিল্পগোষ্ঠী ব্যর্থ হয়ে ফিরেছিল।”

সব মিলিয়ে ওই পাঁচ বছরের বিএনপি শাসনে ঢাকা ও দিল্লির মধ্যেকার কূটনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। আর সেই তিক্ত অভিজ্ঞতাই আজ দেড় দশক পরেও ভারতকে বিএনপি সম্পর্কে সন্দিগ্ধ করে রেখেছে।

বিএনপি-কে ঘিরে ভারতের আর একটা বড় সমস্যা হল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তাদের সংস্রব।

জামাত নেতা মতিউর রহমান নিজামী। বিএনপি জোট সরকারে তিনি শিল্পমন্ত্রী থাকাকালীনই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে অস্ত্র পাচারের ঘটনা ঘটেছিল

“জামায়াতে ইসলামী ভারতের চোখে প্রায় একটি নিষিদ্ধ সংগঠন। আর ভারত আজও বিশ্বাস করে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি এখনও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলে”, বিবিসিকে বলছিলেন দিল্লিতে সিনিয়র রাজনৈতিক বিশ্লেষক জয়ন্ত ঘোষাল।

যতদিন না জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি’র সম্পর্ক পাকাপাকিভাবে ছিন্ন হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত ভারতের পক্ষে বিএনপি’র সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করাও একরকম অসম্ভব বলেই মি. ঘোষালের অভিমত।

আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের পারস্পরিক আস্থার সম্পর্ক শুধু ঐতিহাসিকই নয় – ভারতে কংগ্রেস, জনতা পার্টি, যুক্তফ্রন্ট বা বিজেপি যারাই ক্ষমতায় থাকুক সেই সম্পর্কে কখনো চিড় ধরেনি।

একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া থেকেই এই সম্পর্কের সূত্রপাত – ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ মুজিবর রহমান উভয়েই যাকে শক্তিশালী করে তুলতে ভূমিকা রেখেছিলেন।

তবে এটা ঠিকই যে শেখ মুজিবের জীবদ্দশাতেই ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কে কিছুটা শীতলতা দেখা দেয়, যার ফলে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সম্বন্ধেও দিল্লিতে কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল।

কিন্তু ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যখন দীর্ঘ একুশ বছর পর বাংলাদেশের ক্ষমতায় ফেরে, তখন থেকেই ভারতের সঙ্গে দলটির ঘনিষ্ঠতার নতুন পর্বের শুরু – যাতে আজও ভাঁটা পড়েনি।

বস্তুত শেখ হাসিনা প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মাত্র কয়েকমাসের মধ্যেই ভারতের তদানীন্তন যুক্তফ্রন্ট সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে ঐতিহাসিক গঙ্গা চুক্তিতে সই করেছিল, যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আজও একটি মাইলফলক হিসেবে রয়ে গেছে।

দিল্লিতে বহু পর্যবেক্ষকই ধারণা করেন, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ক্ষমতায় থাকলে সে দেশের সংখ্যালঘু হিন্দুরা তুলনামূলক ‘নিরাপদ’ থাকবেন এবং তাদের ভারতে চলে আসতে হবে না – এই ধারণাটাও হয়তো ভারতের সিদ্ধান্তকে কিছুটা প্রভাবিত করেছে।

ঢাকায় ভারতের সাবেক হাই কমিশনার রিভা গাঙ্গুলি দাস যেমন বলছিলেন, “আসলে বাংলাদেশ তো খুব প্রাচীন কোনও দেশ নেয়, মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সী নবীন একটা দেশ। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে সমকালীন ইতিহাসের একটা ছায়া পড়বে অবধারিতভাবে।”

“এখানে মনে রাখতে হবে তাঁর জীবনের খুব কঠিন একটা সময়ে শেখ হাসিনা এই ভারতেই সপরিবার রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছিলেন।”

“ফলে আমার মনে হয় ভারতের জন্য তাঁর কাছে সব সময় যেমন একটা আলাদা জায়গা আছে, তেমনি ভারতে যে সরকারই আসুক না কেন তারাও কিন্তু শেখ হাসিনাকে সব সময় বিশেষ চোখে দেখে”, বলছিলেন তিনি।

সাবেক বিজেপি এমপি এম জে আকবর আবার বিষয়টাকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে চান।

তাঁর কথা হল, “প্রতিবেশী একটা দেশে ভারত সরকার তো সবার আগে নিজের স্বার্থই দেখবে, তাই না?”

“এখন সে দেশে যে দল বা যারা ভারতের স্বার্থর প্রতিও যত্নবান হবে তাদের সঙ্গেই ভারতের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকবে। এর মধ্যে তো কোনও রকেট সায়েন্স নেই!”, বলছিলেন মি আকবর।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী পার্টি বা বিএনপি যে তাদের তথাকথিত ভারত-বিরোধিতার রাজনীতিকে পেছনে ফেলে ইদানীংকালে দিল্লির সঙ্গে একটা নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেয়েছে এর মধ্যেও কোনও ভুল নেই।

বিবিসি জানতে পেরেছে, বিশেষত ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে একটি হিন্দুত্ববাদী ও দক্ষিণপন্থী সরকার দিল্লির ক্ষমতায় আসার পর বিএনপির পক্ষ থেকে ভারতের নীতিনির্ধারকদের কাছে অনেকবার রাজনৈতিক ‘ফিলার’ পাঠানো হয়েছে।

বিএনপি’র নেতাদের সঙ্গে দিল্লিতে দেখা করেছেন, এমন একজন বিজেপি নেতাই বিবিসিকে বলছিলেন, “আসলে বিএনপি’র বোধহয় একটা ধারণা ছিল যে কংগ্রেসের সঙ্গে শেখ হাসিনার একেবারে পারিবারিক ঘনিষ্ঠতার সম্পর্ক, ক্ষমতা থেকে তাদের বিদায়ের পর বিজেপির সঙ্গে নতুন সম্পর্কের খাতা খোলাই যেতে পারে।”

কিন্তু নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পরে পরেই ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ (প্রতিবেশীরা সবার আগে) পররাষ্ট্রনীতি ঘোষণা করে বুঝিয়ে দেন কংগ্রেস জমানার বাংলাদেশ নীতিতে তিনি কোনও পরিবর্তন আনবেনই না – বরং ঘরের পাশে এই বন্ধু দেশটি তাঁর সরকারের কাছে সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে।

পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও অতি দ্রুত তাঁর একটা ‘পার্সোনাল কেমিস্ট্রি’ বা ব্যক্তিগত রসায়নও গড়ে ওঠে।

ফলে বিএনপিকে শুধু হতাশই হতে হয়নি, কংগ্রেস জমানায় তাদের সঙ্গে দিল্লির তবু যেটুকু সম্পর্ক ছিল সেটাও ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে এসেছে।

বস্তুত ২০১২ সালে কংগ্রেস আমলেই শেষবারের মতো বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে ভারতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ দিল্লিতে তাঁর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকও করেছিলেন।

খালেদা জিয়ার সেই দিল্লি সফরের সময় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরউদ্দিন এমনও পর্যন্ত বলেছিলেন, “আগে যা ঘটেছে তা ঘটে গেছে। আমরা এখন সামনে এগোতে চাই, আর রিয়ার ভিউ মিররে তাকাতে চাই না!”

কিন্তু এর মাস চারেকের মধ্যেই ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির ঢাকা সফরে তখনকার বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়া তাঁর সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করেন – দু’পক্ষের সম্পর্ক আবার যে তিমিরে ছিল, ফিরে যায় সে তিমিরেই।

এই মুহূর্তে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে ভারতের ‘টুকটাক’ যেটুকু সম্পর্ক, সেটাও কিন্তু কখনোই প্রকাশ করা হয় না।

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ শান্তনু মুখার্জির কথায়, “এর পরও অবশ্য বিএনপি নেতারা নিয়মিতই ভারত সফরের ভিসা পান। আমি জানি তাঁদের অনেকেই চিকিৎসার কারণে ভারতে আসেন, অনেকেই আবার আজমির শরিফে মাজার জিয়ারত করতে যান।”

“তো এই সব সফরে কার কার সঙ্গে তাদের দেখা হচ্ছে সেটা তো আর আমরা সব সময় জানতে পারি না। সব কিছু আসলে বাইরে প্রকাশও করা যায় না”, বলছিলেন মি মুখার্জি।

বিএনপি’র সঙ্গে ভারত যে একেবারে যোগাযোগের সব রাস্তা বন্ধ করে দেয়নি, নানা সময়ে তার অবশ্য নানা প্রমাণও মিলেছে।

বছরতিনেক আগেও ঢাকায় ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত বিএনপি নেতা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে দলের ইফতার পার্টিতে যোগ দিয়েছেন। বর্তমান হাই কমিশনারও বিএনপি নেতাদের নিজ বাসভবনে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

বিএনপির হাতেগোনা এমপি-দের মধ্যেও কেউ কেউ সংসদীয় প্রতিনিধিদলের অংশ হিসেবে ভারত সফর করে গেছেন।

বিএনপি-র অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নেতা ও খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত সালাউদ্দিন আহমেদও অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করার দায়ে শিলংয়ে দীর্ঘদিন সাজাভোগ করার পর এখন আদালত থেকে অব্যাহতি পেয়ে দিল্লিতে অবস্থান করছেন।

সব মামলা মিটে যাওয়ার পরও ভারত কেন তাঁকে এ দেশে থাকার অনুমতি দিয়েছে, সেই কারণটা অনুমান করাও বোধহয় খুব কঠিন কিছু নয়।

রাজনীতি বা কূটনীতিতে স্থায়ী শত্রু বা স্থায়ী বন্ধু বলে কিছু হয় না – এটা প্রায় একটা আপ্তবাক্য বলে মানা হয়।

বস্তুত বাংলাদেশের একটি প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিএনপি-র সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার তাগিদ ভারতের দিক থেকেও আছে, কিন্তু এখানে আওয়ামী লীগই একটা বড় বাধা হয়ে দেখা দিচ্ছে বলে কোনও কোনও পর্যবেক্ষকের অভিমত।

নাম প্রকাশ না-করার শর্তে ভারতের একজন সাবেক কূটনীতিক বিবিসিকে বলছিলেন, “বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভাজনটা এত শক্তিশালী যে অন্য কোনও দেশের সঙ্গে তার আসলে তুলনাই চলে না।”

“আওয়ামী লীগ মনে করে ভারত যদি তাদের সঙ্গে সম্পর্ককে মর্যাদা দেয়, তাহলে বিএনপি-র সঙ্গে ভারতের কোনও যোগাযোগই রাখা উচিত নয়। আবার বিএনপি ক্ষমতায় থাকলেও নিশ্চয় ঠিক একইরকমভাবে ভাবত।”

“আমরা তো ঠাট্টা করে এক সময় বলতাম বাংলাদেশে বোধহয় ‘এ’ আর ‘বি’ – শুধু এই দুটোই ব্লাড গ্রুপ। একদল আওয়ামী লীগ, অন্যরা বিএনপি – এর বাইরে আর কিছু নেই”, হাসতে হাসতে বলছিলেন দীর্ঘদিন ঢাকায় কাজ করে আসা অবসরপ্রাপ্ত ওই কর্মকর্তা।

দক্ষিণ এশিয়ার যে সব দেশের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক শক্তিশালী, তার প্রায় প্রতিটিতেই ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল – উভয়ের সঙ্গেই ভারত যোগাযোগ রেখে চলে, এটাই মোটামুটি দস্তুর।

অর্থাৎ নেপালে যখন কমিউনিস্ট পার্টি বা ধরা যাক সাবেক মাওবাদীরা ক্ষমতায়, তখন নেপালি কংগ্রেসের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ বা ‘চ্যানেল অব কমিউনিকেশন’গুলো বন্ধ হয়ে যায় না।

কিংবা শ্রীলঙ্কায় যখন ভারতের মিত্র বলে পরিচিত মৈত্রীপালা সিরিসেনা ক্ষমতায় ছিলেন, প্রভাবশালী রাজাপাকসা পরিবারের সঙ্গেও ভারত নিয়মিত সম্পর্ক রেখে চলত। শ্রীলঙ্কা সরকারেরও সেটা অজানা ছিল না।

“কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটা একেবারেই আলাদা। ওখানে ধরেই নেওয়া হয় আপনি হয় আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন, কিংবা অন্য পক্ষের সাথে। আমরা কিংবা ওরা – এর মাঝামাঝি কিছু নেই”, বলছিলেন ওই সাবেক কূটনীতিক।

বহু নামী থিঙ্কট্যাঙ্কের হয়ে দীর্ঘদিন বাংলাদেশ নিয়ে গবেষণা করা শ্রীরাধা দত্তর মতে, বাংলাদেশের দুটো প্রধান রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে ‘বিদ্বেষটা একেবারে প্যাথোলজিকাল’ বলেই সেখানে এরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

ভারতের বহু বিশেষজ্ঞ বা পর্যবেক্ষক যখন ঢাকায় বা চট্টগ্রামে যান, তারা যদি সেখানে গিয়ে দুই দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গেই এমন কী সামাজিকভাবেও মেলামেশা করতে যান তাহলেও তাদের অন্য পক্ষের ক্ষোভ বা অনুযোগের মুখে পড়তে হয়।

“তবে এটার পেছনে কিছু কারণও আছে। যেমন ধরুন ২০০৪ সালে যে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যা করার চেষ্টা হয়েছিল তাতে জিয়া পরিবারের সরাসরি হাত ছিল বলেও অভিযোগ উঠেছে।”

“ফলে আওয়ামী লীগ কেন বিএনপিকে এতটুকুও ছাড় দিতে রাজি নয় বা কেন পারস্পরিক বিদ্বেষটা এত প্রবল তা বোঝা কঠিন নয় মোটেই”, বিবিসিকে বলছিলেন দিল্লির জেএনইউ-তে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন অধ্যাপক, যাকে গবেষণার কাজে নিয়মিত বাংলাদেশে যেতে হয়।

আরএসএস নেতা রাম মাধব ‘ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন’ নামে যে সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত, তারা গত বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের সুশীল সমাজ ও রাজনীতিবিদদের সঙ্গে ভারতের ট্র্যাক-টু আলোচনার আয়োজন করে আসছে।

কখনো ঢাকায়, কখনো বা দিল্লি বা সিমলাতে এই বৈঠকগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে বাংলাদেশের তরফে শুধু আওয়ামী লীগ নেতা-মন্ত্রী বা ওই দলের সমর্থকদেরই বৈঠকে দেখা যায়।

“আমরা যখনই বৈঠকে বিএনপি নেতাদেরও ডাকার কথা বলেছি, তখন কিন্তু শাসক দলের দিক থেকেই বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। বলা হয়েছে, বিএনপি-র সঙ্গে এক মঞ্চে কোনও আলোচনাই সম্ভব নয়!”, বিবিসিকে বলছিলেন এই বৈঠকগুলোর আয়োজনের সঙ্গে জড়িত একজন কর্মকর্তা।

ফলে বাংলাদেশে কেন শুধু একটিমাত্র রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই ভারতকে প্রকাশ্য যোগাযোগ রেখে চলতে হয়, তা সহজবোধ্য। আর তাতেই ভারতের স্বার্থ সবচেয়ে ভালভাবে রক্ষিত হচ্ছে, এটাও অবশ্যই দিল্লিতে নীতিনির্ধারকদের মাথায় থাকে।

এসএইচ-০৩/১২/২৩ (শুভজ্যোতি ঘোষ,বিবিসি)