হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতন: পুলিশ মামলা নিতে চায় না!

দেশে হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতন প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট আইন থাকলেও তা তেমন প্রয়োগ হচ্ছেনা।  এর প্রধান কারণ এই আইনে পুলিশ মামলা নিতে চায়না। আর সাধারণ মানুষও আইনটি সম্পর্কে তেমন জানেন না।

কিন্তু এই আইনে কঠোর শাস্তির বিধান আছে। আর এই আইনে মামলা হলে আসামিকেই প্রমাণ করতে হবে যে তিনি নির্দোষ। হেফাজত বলতে শুধু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নয়, সরকারি যেকোনো ধরনের হেফাজতকেই বুঝানো হয়েছে আইনটিতে। ফলে সরকারি কর্মকর্মকর্তরা সবাই এই আইনের মধ্যে চলে আসেন।

শাহবাগ থানায় ছাত্রলীগ নেতাদের ডেকে নিয়ে নির্মম নির্যাতনের ঘটনার পর এই আইনটির কথা আবার আলোচনায় এসেছে। যদিও প্রশাসনিক তদন্তের বাইরে ওই ঘটনায় নির্যাতনের শিকার ছাত্রদের পক্ষ থেকে এখনো কোনো মামলা করা হয়নি।

শাহবাগ থানায় ছাত্রলীগ নেতাদের নির্যাতনের ঘটনা আলোচিত হলেও বাংলাদেশে ওই রকম হেফাজতে নির্যাতনের ঘটনা প্রায়ই ঘটে।মৃত্যুর ঘটনাও অনেক।চলতি বছরে এপর্যন্ত হেফাজতে মৃত্যুর সাতটি ঘটনার কথা জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র(আসক)। ২০২২ সালে হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ১৯টি।

কিন্তু এইসব নির্যাতনের ঘটনায় কখনো মামলা হয়। আবার কখনো মামলা হয়না। মামলা হলেও তা বিশেষ আইনে না হয়ে সাধারণ আইনে হয়। আর এই কারণেই ২০১৩ সালে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনটি কার্যকর হওয়ার পর এপর্যন্ত মামলা হয়েছে মাত্র ২৯টি। আর শাস্তি হয়েছে মাত্র একটি মামলায়। ২০১৪ সালে মিরপুরের পল্লবী এলাকায় জনি নামে এক ব্যক্তি পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনে মারা যান। তার পরিবার এই আইনে মামলা দায়ের করেন। ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আদালত পল্লবী থানার তখনকার এসআই জাহিদুর রহমান জাহিদ, এসআই রশিদুল ইসলাম এবং এএসআই কামজ্জামান মিন্টুসহ এই তিন জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন৷ তাদের দুইজন সোর্সকে দেয়া হয় সাত বছরের কারাদণ্ড ৷

হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু(নিবারণ) আইনটি বাংলাদেশে জাতিসংঘের বাধ্যবাধকতার কারণে করা হয়। ১৯৮৪ সালের ১০ ডিসেম্বর নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার অথবা দণ্ড বিরোধী সনদে স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। আর সে কারণেই আইনটি করতে হয়েছে। তবে আইনটি প্রণয়নের প্রেক্ষাপটে আরো বলা হয়েছে-

যেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার ও দণ্ড মৌলিকভাবে নিষিদ্ধ করেছে এবং যেহেতু জাতিসংঘ সনদের ২(১) ও ৪ অনুচ্ছেদ নির্যাতন, নিষ্ঠুর, অমানবিক ও লাঞ্ছনাকর ব্যবহার ও কারাদণ্ড অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করে নিজ নিজ দেশে আইন প্রণয়নের দাবি করে।

এই আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং মামলা করতে হয় বিচারক অথবা পুলিশের এসপি পদ মর্যাদার কোনো কর্মকর্তার কাছে। আর আদালত বা পুলিশ যেখানেই মামলা করা হোক না কেন মামলার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তার শারীরিক পরীক্ষা করিয়ে প্রতিবেদন দিতে হবে। নিরাপত্তা দিতে হবে। আর মামলা দেশের যেকোনো এলাকায় করা যাবে। ফলে হেফাজতে নির্যাতনের প্রতিকার পেতে এই আইনের সুবিধা অনেক।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন,” এই আইনটির একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো বাদীকে নয়, আসামিকেই প্রমাণ করতে হবে যে তিনি অপরাধী নন। কারণ কেউ যখন হেফাজতে নির্যাতনের শিকার হন তখন নির্যাতনকারীরা সাক্ষী রেখে নির্যাতন করেনা। আর যার হেফাজতে নির্যাতন হয় পরিস্থিতি পুরোপুরি তার নিয়ন্ত্রণে থাকে। ফলে তাকেই প্রমাণ করতে হবে যে নির্দোষ। তারই তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করতে হয়। ”

তবে এই মামলাটির তদন্তে কোনো প্রশিক্ষণ নেই তদন্তকারীদের। ফলে যে অল্প কিছু মামলা হয়েছে তার অধিকাংশই ফাইনাল রিপোর্টে তদন্তকারী বলেছেন, বাদী মামলা প্রমাণ করতে পারেননি। কিন্তু এই আইনে মামলা বাদীর প্রমাণের বিষয় নয়, আসামি প্রমাণ করবেন যে তিনি নির্দোষ। বলেন এই আইনজীবী।

এই আইনে ৯০ দিনের মধ্যে মামলার তদন্ত এবং ৩০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার বিধান আছে। ইশরাত হাসান বলেন,” শুরু থেকেই পুলিশ এই আইনটির বিরোধিতা করে আসছে পুলিশ। তারা চায়না এই আইনটি কার্যকর হোক এবং এই আইনে মামলা হোক। ”

মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের(আসক) সাধারণ সম্পাদক নূর খান বলেন,” আইনটির যা অবস্থা তা দেখে বলা যায় যে জাতিসংঘ সনদের বাধ্যবাধকতার কারণে আইনটি করা হয়েছে। এটা প্রয়োগ বা কার্যকর করার আদৌ কোনো ইচ্ছা সরকারে নাই। এই আইনটি নিয়ে তেমন প্রচারও নেই।”

তবে তার কথায়,” এই দেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে মামলা করা এত সহজ নয়। তারা এমন একটা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে যে কেউ মামলা করতে সাহস পায়না। আর সাহস করে কেউ মামলা করলেও তাকে নানাভাবে হয়রানি করা হয়।”

তিনি বলেন,” ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ নেতাদের থানায় নিয়ে নির্যাতনের পর অনেক কথা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে তারা এখনো দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের মামলা করেননি। এই ঘটনায় হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু(নিবারণ) আইনেও মামলা করা যায়। কিন্তু মামলা তো তারা করছেনা। এ থেকে পরিস্থিতি যে কত খারাপ তা বোঝা যায়।”

মানবাধিকার কর্মী বলেন, “আর পুলিশ শুরু থেকেই এই আইনটি বাতিলের দাবী করে আসছে। তারা চায়না তাদের হেফাজতে নির্যাচন ও মৃত্যুর জন্য আলাদা কোনো আইন থাকুক। তারা একটি দায়মুক্তির পরিবেশ চায়।”

আর ইশরাত হাসান বলেন,” ছাত্রলীগ নেতাদের নির্যাতনের ঘটনায় হেফাজতে নির্যাতন ও মুত্যু(নিবারণ) আইনে একটি এবং আরেকটি অপহরণ মামলা হতে পারে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু কোনো মামলা তো আমরা দেখছিনা।”

এসএইচ-০৮/১৭/২৩ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)