বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞার তালিকায় সহস্রাধিক ব্যক্তি!

অর্থপাচার ও হুন্ডি প্রতিরোধের মাধ্যমে বৈধ উপায়ে রেমিট্যান্স বাড়াতে এবং ডলার সংকট কাটাতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। এক্ষেত্রে বিদেশে অর্থপাচারকারী ও চোরকারবারি হিসেবে সন্দেহভাজন সহস্রাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে পর্যায়ক্রমে বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় বুধবার প্রথমবারের মতো ২৫ ব্যক্তির পাসপোর্টের ফটোকপি ও ছবি ইমিগ্রেশন পুলিশকে দিয়েছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।

এভাবে একের পর এক অর্থপাচারকারীদের তালিকা যাবে ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে। এ ছাড়া ঘন ঘন বিদেশ গমনকারী সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের মধ্যে গত এক বছরে কে কতবার বিদেশ গমন করেছেন- ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে তার একটি তালিকা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।

এদিকে বিমানবন্দর কাস্টমস কর্তৃপক্ষ অর্থপাচার ও স্বর্ণের চোরাকারবার রোধে ১২ সদস্যের ৪টি সার্ভেইলেন্স টিম গঠন করেছে। দেশের বিমানবন্দরে এবারই প্রথম এমন অর্থপাচার প্রতিরোধ ইউনিট গঠন করা হলো কাস্টমস কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে।

এ বিষয়ে ঢাকা কাস্টমস হাউসের যুগ্ম কমিশনার মিনহাজ উদ্দিন বলেন, বিশ্বব্যাপী এখন ডলার সংকট, আমাদের এখানেও আছে। এসব কারণে মুদ্রা পাচারের ঘটনা বেশি ঘটছে। এসব রোধে আমরা কাজ করছি। এ ইউনিটের তৎপরতায় বিমানবন্দর হয়ে ডলার পাচার থেকে শুরু করে সব ধরনের অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ হবে বলে আমরা আশা করছি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মাসে তিনবারের বেশি বিদেশে ভ্রমণকারীদের তথ্য-উপাত্ত (ডেটাবেজ) তৈরি করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এমন ব্যক্তিদের পাসপোর্ট, নাম ও সামাজিক অবস্থান যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। সন্দেহভাজন এসব ব্যক্তি যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই কিছুদিন পরপর বিদেশ গমন করেন। এসব ব্যক্তি খোলাবাজার থেকে ডলারসহ বৈদেশিক মুদ্রা কিনে বিদেশে নিয়ে যান। আবার অনেক ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত বাংলাদেশিরা পরিবারের কাছে হুন্ডির এজেন্টদের মাধ্যমে টাকা পাঠান। এক্ষেত্রে এজেন্টরা দেশে টাকা দিয়ে বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে। সেই বৈদেশিক মুদ্রায় হুন্ডির এজেন্টরা স্বর্ণ ও মাদকসহ বিভিন্ন পণ্য কিনে চোরাইপথে দেশে নিয়ে আসে। এর মধ্যে স্বর্ণের একটি বড় অংশ পাশর্^বর্তী দেশে পাচার হয়ে যায়। এভাবে অর্থপাচার ও হুন্ডির কারণে দেশে ডলারসহ বৈদেশিক মুদ্রার সংকট তৈরি হয়েছে। তাই অর্থপাচার, হুন্ডি ও স্বর্ণ চোরাচালান রোধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। পাশাপাশি কেউ যেন হয়রানির শিকার না হন, সেদিকেও লক্ষ্য রাখা হবে।

ঢাকা কাস্টম হাউসের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, অর্থপাচারকারী ও স্বর্ণ চোরাকারবারিদের ধরতে বিভিন্ন কার্যক্রম শুরু করছে ঢাকা কাস্টমস হাউস। যারা প্রায়ই বিদেশ ভ্রমণ করেন, এমন সন্দেহভাজনদের তালিকা ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে দেবে শুল্ক বিভাগ। সেসব ব্যক্তি ইমিগ্রেশন করতে গেলে তাদের পাঠানো হবে কাস্টমস কর্মকর্তাদের কাছে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে তারা সন্তোষজনক জবাব দিতে পারলে তবেই বিদেশে যেতে পারবেন। এ ছাড়া দেশে ফেরার সময় স্বর্ণ নিয়ে এলে সেই স্বর্ণ কেনার টাকার উৎস সম্পর্কেও জানাতে হবে কাস্টমসকে।

কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিদিনই বিভিন্ন দেশ থেকে ক্যারিয়ারের মাধ্যমে দেশে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ নিয়ে আসা হয়। তারা নির্দিষ্ট অংকের টাকার বিনিময়ে এসব স্বর্ণ বহন করে। ওই স্বর্ণে তাদের কোনো বিনিয়োগ নেই। হুন্ডির বড় চক্রগুলো এসব স্বর্ণ কিনে ক্যারিয়ারের মাধ্যমে দেশে পাঠায়। এখন থেকে এসব ক্যারিয়ারের স্বর্ণ কেনার অর্থের উৎসের বিষয়ে কড়াকড়িভাবে হিসাব নেওয়া হবে। এর ফলে হুন্ডির অর্থে স্বর্ণসহ মূল্যবান পণ্য এনে দেশে ও পাশ্ববর্তী দেশে বিক্রি করা বন্ধ হবে। যথাযথভাবে এ কার্যক্রম চললে ধীরে ধীরে হুন্ডির পরিমাণ কমে আসবে এবং রেমিট্যান্স আসার হার বাড়তে থাকবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভের পরিমাণও বাড়বে।

সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা কে কতবার গত এক বছরে বিদেশে গেছেন তা জানতে বুধবার স্পেশাল সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ (ইমিগ্রেশন) বরাবর চিঠি পাঠিয়েছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘রাজস্ব সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ, চোরাচালান ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করছে ঢাকা কাস্টম হাউস।

বিদেশ থেকে শুল্ক ফাঁকি, নিষিদ্ধ এবং নিয়ন্ত্রিত পণ্য পরিবহনসহ চোরাচালানের দায়ে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের নিকট অভিযুক্ত হয়েছেন এবং এ সংক্রান্ত মামলাসমূহ বিচারাধীন রয়েছে। এসব যাত্রীর মাধ্যমে অবৈধভাবে বৈদেশিক মুদ্রা পরিবহন ও পাচারের ঝুঁঁকি রয়েছে। সন্দেহভাজন পাসপোর্টধারী যাত্রীরা বিদেশ ভ্রমণকালে বিমানবন্দর কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার জন্য অনুরোধ করা হলো। একই সঙ্গে যাত্রীরা এক বছরে কোন কোন দেশে কতবার ভ্রমণ করেছেন, তা জানানোর জন্য অনুরোধ করা হলো। সরকারি রাজস্ব সুরক্ষা, বৈদেশিক মুদ্রা পাচার ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধকল্পে বিষয়টি অতিজরুরি।’

কাস্টমস সূত্র জানিয়েছে, সরকারি রাজস্ব সুরক্ষায় চোরাচালান ও মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ ও গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং বিশেষ তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১২ জন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার সমন্বয়ে ৪টি সার্ভেইলেন্স টিম গঠন করা হয়েছে। একজন যুগ্ম কমিশনারের নেতৃত্বে ইউনিটের কর্মকর্তারা চার শিফটে দায়িত্ব পালন করবেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তারা হলেন- মোহাম্মদ জাফর, তৌহিদুজ্জামান, জান্নাতুল মাওয়া, মো. সোহেল, মো. সানোয়ার হোসেন, জুয়েল চক্রবর্তী, আল আমিন রিয়ন, নাজমুল বাশার, মো. সারোয়ার কবির, একেএম আনিসুর রহমান ও খাদেমুল ইসলাম।

১৫ অক্টোবর ঢাকা কাস্টমস হাউস কর্তৃপক্ষের এক আদেশে বলা হয়, চোরাচালান ও মুদ্রা পাচার প্রতিরোধসহ বহির্গমনের সময় তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে বিশেষায়িত এই ইউনিট।

এসএইচ-০২/১৯/২৩ (অনলাইন ডেস্ক, সূত্র : আমাদের সময়)