তফসিলের আগেই রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগের চিন্তা

সাধারণত নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময়ই রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিলের আগেই রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করার চিন্তা করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগের ৭ থেকে ১০ দিন পর তফসিল ঘোষণা করার কথা ভাবা হচ্ছে। এবার তফসিল ঘোষণাও হতে পারে অন্যবারের তুলনায় লম্বা সময় রেখে।

নির্বাচন–বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তফসিলে লম্বা সময় রাখা হলে বিরোধী আন্দোলনের মুখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখাসহ অন্যান্য ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখা কঠিন হতে পারে। এ কারণে হয়তো তফসিল ঘোষণা না করেও রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে ইসি আগেভাগে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকে যেতে চায়।

নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তফসিল হবে এবং জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভোট হবে; গত মাসে এমনটি বলেছিলেন নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান। তবে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধন করার কথা রয়েছে। তফসিলের পর এমন উদ্বোধন নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। তাই তফসিল ঘোষণা না করেও নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে ইসি নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ঢুকতে চাইছে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আগের সব নির্বাচনে তফসিলের সময়ই রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। এবার কেন আগে নিয়োগের চিন্তা করছে, সেটি তাঁর বোধগম্য নয়।

ইসি সূত্র জানিয়েছে, তফসিল নিয়ে নির্বাচন কমিশনাররা ইতিমধ্যে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন। সাধারণত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দিন থেকে ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে ভোট গ্রহণ করা হয়। ইসির এবারের চিন্তা ভোটের প্রায় দুই মাস আগে তফসিল দেওয়া। এতে কী কী সুবিধা বা অসুবিধা হতে পারে, সেটি নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য ঝুঁকির দিকটিও বিবেচনা করতে হচ্ছে। বিগত সময়ে বিভিন্ন জাতীয় নির্বাচনের তফসিল বিশ্লেষণ করছেন নির্বাচন কমিশনাররা। এর মধ্যেই নতুন চিন্তা যুক্ত হয়েছে, তফসিল ঘোষণার আগেই রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি।

এ ক্ষেত্রে ইসির একটি সূত্রের যুক্তি হচ্ছে, জাতীয় নির্বাচন–সংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ধারার যে ক্রম, সেটি অনুসরণ করতে চায়। এতে প্রথমে বলা আছে, প্রতিটি নির্বাচনী এলাকা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করবে। এরপর রিটার্নিং কর্মকর্তা প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তাদের প্যানেল প্রস্তুত করবেন এবং সেখান থেকে কর্মকর্তা নিয়োগ দেবেন।

এরপর নির্বাচনের তফসিল বা সময়সূচি ঘোষণার কথা উল্লেখ আছে। আইনের ৭ নম্বর ধারায় রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ আর ১১ নম্বর ধারায় ভোটের তারিখ বা তফসিলের বিষয়ে বলা আছে। তবে অতীতের নির্বাচনগুলোতে তফসিল ঘোষণার পরই রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগসহ বাকি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। আর জাতীয় নির্বাচনে জেলা প্রশাসকেরা রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ইসির এখন নতুন চিন্তা হচ্ছে, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হবে। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শেষ করার জন্য তাঁদের ৭ থেকে ১০ দিন সময় দেওয়া হবে।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ইসির এখন নতুন চিন্তা হচ্ছে, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হবে। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শেষ করার জন্য তাঁদের ৭ থেকে ১০ দিন সময় দেওয়া হবে। তারপর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। সেটি হতে পারে ১২ নভেম্বরের পরে। তবে যেদিন রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগের ঘোষণা দেওয়া হবে, সেদিনই কবে তফসিল ঘোষণা করা হবে তা জানিয়ে দেওয়া হবে।

জাতীয় সংসদের পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। চলতি একাদশ সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হবে আগামী ২৯ জানুয়ারি। এর আগের ৯০ দিন; অর্থাৎ আগামী ১ নভেম্বর থেকে ২৯ জানুয়ারির মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন করতে হবে। তবে ভোটের তফসিল কবে ঘোষণা করতে হবে, এ বিষয়ে আইনে সুনির্দিষ্ট কিছু বলা নেই।

নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান প্রথম আলোকে বলেন, নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে। ডিসেম্বরের শেষে বা আগামী জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভোট গ্রহণ করা হতে পারে। এ দুটি বিষয় যথাসময়ে নির্বাচন কমিশনের বৈঠকে চূড়ান্ত করা হবে।

সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে ভোট করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তফসিল ঘোষণা থেকে ভোটের দিন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কত দিন রাখা হবে, তা আইনে সুনির্দিষ্ট করা নেই। তবে আইনে বলা আছে, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের দিন থেকে ভোটের দিনের মধ্যে অন্তত ১৫ দিন সময় রাখতে হবে।

ইসি সূত্র জানায়, এর আগের সংসদ নির্বাচনগুলোতে তফসিল ঘোষণার দিন থেকে ভোট গ্রহণের মধ্যে ৪০-৪৫ দিন সময় রাখা হয়েছিল। অবশ্য কয়েকটি নির্বাচনে কয়েকবার ভোটের তারিখ পেছানোর কারণে সময় বেড়েছিল। সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছিল ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর। মাঝখানে ৪৫ দিন সময় রেখে ভোটের তারিখ ছিল ২৩ ডিসেম্বর। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির মুখে ভোটের তারিখ এক সপ্তাহ পিছিয়ে ৩০ ডিসেম্বর করা হয়েছিল।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দিন থেকে ভোট গ্রহণের মাঝে সময় ছিল ৪০ দিন। এর আগে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছিল ২০০৮ সালের ২ নভেম্বর।

প্রথমে ভোটের তারিখ ঠিক করা হয়েছিল তফসিল ঘোষণার ৪৭ দিন পর, ১৮ ডিসেম্বর। পরে রাজনৈতিক দলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভোটের তারিখ পিছিয়ে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর করা হয়েছিল। এর আগে ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে তফসিল ঘোষণার দিন থেকে ভোটের দিনের মাঝে সময় ছিল ৪৪ দিন।

১৯৯৬ সালের নির্বাচনে সপ্তম সংসদ নির্বাচনে তফসিল ঘোষণার দিন থেকে ভোটের দিনের মাঝে সময় ছিল ৪৬ দিন। আর ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে তফসিল ঘোষণার দিন থেকে ভোটের দিনের মাঝে সময় ছিল ৭৮ দিন। তবে পরে ভোটের তারিখ এক সপ্তাহ এগিয়ে আনা হয়েছিল। সেই হিসাবে সময় ছিল ৭১ দিন।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আগের সব নির্বাচনে তফসিলের সময়ই রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। এবার কেন আগে নিয়োগের চিন্তা করছে, সেটি তাঁর বোধগম্য নয়। তিনি বলেন, রিটার্নিং কর্মকর্তাদের প্রস্তুতির যে বিষয়, যেমন প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তা নিয়োগের মতো বিষয়গুলো নিয়ে একধরনের প্রস্তুতি সব সময় থাকেই; বরং এটি বেশি আগেভাগে করা হলে সমস্যা হতে পারে।

অতীতে নির্বাচন কর্মকর্তাদের নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার খোঁজখবর করা ও হয়রানির অভিযোগ উঠেছিল। ইসিকে মূলত নজর দিতে হবে, তারা কীভাবে সবকিছু নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখবে সেদিকে।

এসএইচ-০৯/২৫/২৩ (অনলাইন ডেস্ক, সূত্র : প্রথম আলো)