তফসিল দিলেই কি নির্বাচন নিশ্চিত?

নির্দলীয় সরকারের অধীনে বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর ধারাবাহিক সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচির মধ্যেই রাষ্ট্রপতির সাথে বৈঠকের পর নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে ‘নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই নির্ধারিত পদ্ধতিতেই’ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য দ্রুতই তফসিল ঘোষণা করা হবে।

“মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচন সম্পর্কিত প্রস্তুতি অবহিত করেছি আমরা। যে কোনও মূল্যে ২৯শে জানুয়ারির আগেই নির্বাচন করতে হবে। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সম্ভাব্য সময়সূচী ঘোষণা করবো আমরা,” রাষ্ট্রপতির সাথে বৈঠকের পর অপেক্ষমান সাংবাদিকদের বলেছেন বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচন কমিশনের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেছে তারা নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য দলীয় কার্যক্রম শুরু করেছে ।

অন্যদিকে বিএনপি নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগকে ‘একতরফা’ বলে আখ্যায়িত করে বলেছে তফসিল ঘোষণা করে ‘বিরোধী দলকে কাবু করতে সরকারের চেষ্টা সফল হবে না’।

বাংলাদেশের বেসরকারি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা জানিপপ- এর চেয়ারম্যান প্রফেসর ডঃ নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলছেন তফসিল ঘোষণা করলেই যে নির্বাচন হবে এমন কোন গ্যারান্টি নেই, বরং তফসিল ঘোষণার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কী পদক্ষেপ নেয় তার ওপরই নির্বাচন হবে কি না বা কেমন হবে সেটি নির্ভর করবে।

প্রসঙ্গত, জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমা বিশ্ব গত বেশ কিছুদিন ধরেই বাংলাদেশের আগামী সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সরকারের ওপর দৃশ্যমান চাপ প্রয়োগ করে আসছে।

ইতোমধ্যেই সুষ্ঠু নির্বাচনকে যারা ব্যাহত করতে চায় তাদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ প্রয়োগেরও ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

তবে এসব চাপ সত্ত্বেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলেছে সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনা সরকারের অধীনেই নির্ধারিত সময়ে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

অন্যদিকে বিরোধী বিএনপি ও সমমনা দলগুলো তফসিল ঘোষণাকে সামনে রেখেই ধারাবাহিক আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করে আসছে। তফসিল ঘোষণার পর আরও ‘কঠোর কর্মসূচি’ ঘোষণা করতে পারে এমন ইঙ্গিতও তারা দিয়ে রেখেছেন।

ফলে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যায়-তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন, কৌতূহল ও আশঙ্কা আছে।

রাষ্ট্রপতি ও কমিশনের বৈঠকে যা হল
সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশন মূলত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সাথে সাক্ষাত করে নির্বাচনের জন্য তাদের প্রস্তুতির বিষয়টি তুলে ধরেন।

পরে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের সিইসি বলেন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ‘নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই নির্ধারিত পদ্ধতিতেই’ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য দ্রুতই তফসিল ঘোষণা করা হবে।

“আমরা সার্বিক প্রস্তুতি সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করেছি। রাষ্ট্রপতি বলেছেন সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা যে কোন মূল্যে রক্ষা করতে হবে। আমরা বলেছি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে নির্ধারিত পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর।”

“আমরা আরও বলেছি আমরা আশাবাদী সবার সহযোগিতায় সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার আলোকে যথাসময়ে নির্বাচন করতে সক্ষম হবো”, বলছিলেন সিইসি।

কবে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে তার সুনির্দিষ্ট জবাব দেননি তিনি।

তিনি বলেন যে কোনও মূল্যে ২৯শে জানুয়ারির আগেই নির্বাচন করতে হবে এবং সেজন্য নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে দ্রুত নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবেন তারা।

আর নির্বাচন কবে হবে সে বিষয়ে তিনি কমিশনের আগের অবস্থান অর্থাৎ জানুয়ারির প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহের দিকেই ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। তবে বিরোধী দল বিএনপির চলমান আন্দোলন বা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন – এসব বিষয়ে কোন মন্তব্য তিনি করতে রাজি হননি।

অনুকূল পরিবেশ আদৌ আছে?
সিইসির নেতৃত্বে কমিশন সদস্যরা নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করলেও মাত্র ২০ দিন আগেই সংসদ নির্বাচন নিয়ে এক কর্মশালার জন্য সম্পাদকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে সে আমন্ত্রণপত্রের সঙ্গে একটি ধারণাপত্র দিয়েছিলো নির্বাচন কমিশন।

তাতে কমিশন বলেছিলো যে “অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর নির্বাচনের জন্য যে অনুকূল পরিবেশ প্রত্যাশা করা হয়েছিল, সেটি এখনো হয়ে ওঠেনি। প্রত্যাশিত সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে মতভেদের নিরসন হয়নি।”

বাস্তবতা হলো সেই পরিস্থিতির এখনো কোন উন্নতি হয়নি। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয় পক্ষ থেকেই সংলাপকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।

বিএনপি রাজপথে নানা কর্মসূচি পালন করছে এবং বিএনপিকে মোকাবেলায় রাজপথেই অবস্থানের পথ বেছে নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও।

আর উভয়পক্ষের এমন পরস্পরবিরোধী অবস্থানের জের ধরে ঘটছে নানা সহিংস ঘটনা। বিএনপির মহাসমাবেশও পণ্ড হয়েছে গত আটাশে অক্টোবর এবং ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় অন্তত দশ জনের মৃত্যু হয়েছে।

এর মধ্যেই উনত্রিশে জানুয়ারির মধ্যেই নির্বাচন করতে হবে -এমন আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি গ্রহণের কথা বলেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার।

প্রসঙ্গত, সংবিধান অনুযায়ী সংসদে মেয়াদ পূর্তির আগের নব্বই দিনের মধ্যে পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করতে হয়। বর্তমান সংসদের প্রথম অধিবেশন ছিলো ২০১৮ সালের ত্রিশে জানুয়ারি এবং সে কারণে এই সংসদের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ২৯শে জানুয়ারি।

ফলে সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনকে পহেলা নভেম্বর থেকে ২৯শে জানুয়ারির মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে হবে।

তফসিল দিলেই নির্বাচন নিশ্চিত?
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ২০০৭ সালের ২২শে জানুয়ারির নির্বাচন তফসিল ঘোষণার পরেও বাতিল হয়ে যাবার উদাহরণ রয়েছে।

সেবার বিএনপি তখনকার রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজ উদ্দিন আহমেদের সরকারের অধীনে নির্বাচন অনড় থাকলেও একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে থাকা আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলগুলো শেষ মূহুর্তে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপে ওই নির্বাচন শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়ে যায়।

এরপর দু বছর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনে ছিলো দেশ। পরে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট।

প্রফেসর ডঃ নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলছেন বিএনপি ও সমমনা দলগুলো এখন দৃশ্যত নির্বাচন প্রতিহত করার চেষ্টার দিকেই হাঁটছে বলে মনে করেন তিনি।

তবে তাঁর মতে তফসিল ঘোষণা হলেও সব কিছু নির্ভর করবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কী পদক্ষেপ নেয়- তার ওপর।

“হরতাল অবরোধে জনজীবন বিপর্যস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশনও তাদের রোডম্যাপের চূড়ান্ত পর্যায়ে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে তাদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা জানিয়েছে। তারা কী কৌশল নেয় তার ওপরই অনেক কিছু নির্ভর করবে সামনে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. কলিমউল্লাহ।

তার মতে তফসিল ঘোষণা হয়ে গেলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কোন হস্তক্ষেপ করলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে।

“যুক্তরাষ্ট্রসহ ৩৪টি দেশ যদি এক হয়ে কিছু বলে তাহলে সেটা অবশ্যই সরকারকে গুরুত্ব দিয়ে নিতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণেই সেটা সরকারকে বিবেচনা করতে হবে,” বলছিলেন তিনি।

২০০৭ সালের ২২শে জানুয়ারির বাতিল নির্বাচনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তফসিল হলে সরকার ও প্রশাসন সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। আবার বিএনপিও তাদের চেষ্টা করবে। সে ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দিকেই দৃষ্টি থাকবে সবার। মনে রাখতে হবে- তফসিল ঘোষণাই নির্বাচন হয়ে যাবার কোনও গ্যারান্টি এখন নয়”।

যা বলছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তফসিল ঘোষণার জন্য নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। দলটি বলছে নির্বাচনের জন্য দলীয় কার্যক্রমের প্রস্তুতিও তারা শুরু করেছেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দলের বৈঠকে নির্বাচন কেন্দ্রিক কিছু গুরুত্বপূর্ণ কমিটি গঠন হওয়ার কথা রয়েছে।

দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্ল্যাহ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, “আমরা নির্বাচনেই আছি। কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক হবে, সেখান থেকেও একটি দিক নির্দেশনা আসবে। তবে হয়তো এর চেয়ে ভালো পরিবেশে নির্বাচন হতে পারতো। কিন্তু ২৮ তারিখ বিএনপি তাণ্ডব করে সেই পরিবেশ নষ্ট করে দিয়েছে।”

কিন্তু নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ আছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলও সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য সংলাপের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

সে কারণে এখনো বিএনপির সাথে আলোচনার কোন সুযোগ সরকারি দল নেবে কি-না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “আলোচনা তো হতেই পারে। তারা (বিএনপি) যদি বুঝে সকলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হলে শান্ত পরিস্থিতি থাকবে, অর্থনীতি ভালো থাকবে তাহলে সহিংসতা বাদ দিয়ে নির্বাচনে তো তাদের আসাই উচিত।”

অন্য দিকে বিরোধী দল বিএনপি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে গত ২৮শে অক্টোবরের পর থেকেই ছুটির দিন বাদ দিয়ে প্রতিদিনই কর্মসূচি পালন করে আসছে।

চলতি সপ্তাহে মঙ্গলবার ছাড়া প্রতিদিনই অবরোধ কর্মসূচি পালনের পর আগামী সপ্তাহের শুরুতে রবি ও সোমবার আবারো সর্বাত্মক অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো।

ওদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচন কমিশনের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে এবং দলটি সভাপতিমন্ডীর সদস্য কাজী জাফর উল্ল্যাহ বলেছেন তারা ইতোমধ্যেই নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য দলীয় কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছেন।

যদিও বিএনপিসহ বিরোধী দল গুলো নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য বর্তমান সরকারের পদত্যাগের দাবিতে এখন দেশব্যাপী সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে। বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ডঃ আব্দুল মঈন খান বলছেন সরকার ভাবছে এভাবে একতরফা তফসিল দিয়ে বিরোধী দলকে কাবু করবে কিন্তু সেটি হবে তাদের জন্য দুরাশা।

“বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে এরকম তফসিল ঘোষণার উদাহরণ আমরা অনেক দেখেছি। তফসিল ঘোষণার পরে নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তিত হয়েছে, সে উদাহরণও আছে। শুধু তাই নয়, তফসিল ঘোষণার পর যে নির্বাচন হবার কথা, সেই নির্বাচন সম্পূর্ণ বাতিল হবার উদাহরণও দেখেছি,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

“কাজেই তফসিলের হুমকি দিয়ে বিরোধী দলকে দূরে রেখে গৃহপালিত বিরোধী দল দিয়ে নির্বাচন করে সরকার এবার দেশে বিদেশে কাউকে বোকা বানাতে পারবে না। দেশে মানুষ গণতন্ত্রের আন্দোলনে নেমেছে, আমরা গণতন্ত্র আনবো”।

খান বলেন, “এ মূহুর্তে সরকার একতরফা তফসিল ঘোষণা করলে পুনরায় প্রমাণ হবে যে আওয়ামী লীগ সরকার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বদলে একদলীয় স্টিম রোলার চালিয়েই দেশ শাসন করতে চায়”।

এসএইচ-০৬/০৯/২৩ (রাকিব হাসনাত,বিবিসি)