দেশে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ‘অসহযোগ আন্দোলনের’ অংশ হিসেবে নিজ দলের নেতা-কর্মীদের মামলায় হাজিরা না দেয়ার আহ্বান জানানোর পর প্রথম দিনে ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণে গিয়ে দলটির বেশ কিছু কর্মীকে আদালতে হাজিরা দিতে দেখা গেছে। তবে কারাগারে থাকা দলটির বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা আদালতে হাজিরা দিতে আসেনি।
বৃহস্পতিবার সকাল পৌনে নয়টায় ঢাকার সিএমএম আদালতে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিদিনের মতো এ দিন ও বিভিন্ন মামলায় যাদের হাজিরা রয়েছে সেসব আসামিদের কারাগার থেকে আদালতের হাজতখানায় এনে রাখা হয়। পরে যেসব কোর্টে হাজিরা রয়েছে সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের হাজির করেন।
ঢাকার সিএমএম আদালতের বেশ কয়েকটি এজলাস ঘুরে সকালে দেখা গেছে, ২০১২ সাল থেকে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে করা বেশ কিছু নাশকতার মামলার শুনানি রয়েছে। কারাগারে থাকা এসব মামলার আসামিদের পুলিশ হাজির করেছে।
আর দলটির যারা জামিনে রয়েছেন তারা শর্ত অনুযায়ী শুনানির নির্ধারিত দিনে আদালতে হাজির হয়েছেন।
এসব আদালতের সামনে কথা হয় নাশকতার মামলায় হাজিরা দিতে আসা বেশ কয়েকজনের সাথে।
অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. তোফাজ্জল হোসেনের আদালতে সকাল দশটা ৪৫ মিনিটে বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়। শুরুতেই দেখা যায়, যেসব মামলা শুনানির জন্য রয়েছে তাঁর বেশিরভাগই নাশকতার মামলা। পল্টন, বংশাল, বনানী, কদমতলি থানার ২০১২, ২০১৪, ২০২২ সালের মামলার শুনানি হচ্ছে।
এই আদালতে দেখা যায়, যেসব আসামি জামিনে থেকে আগের শুনানিতে ছিলেন কিন্তু আজ সময় আবেদন করেছেন তাদের আবেদন মঞ্জুর করা হয়েছে। কিন্তু যেসব আসামি দুই কার্যদিবসে শুনানিতে উপস্থিত না হয়ে আবারও সময় আবেদন করেছেন তাদের আবেদন নামঞ্জুর করা হয়েছে।
বনানী থানার দুই মামলায় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী সোহেল হাজির না হওয়ায় জামিন বাতিল করে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আদালত। একইসাথে সময় আবেদনও নামঞ্জুর করা হয়।
এ আদালতের সামনে কথা হয় মো. মাজেদ নামে বিএনপির একজন কর্মীর সাথে। তিনি জানান, তার বিরুদ্ধে ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত মতিঝিল থানায় ২৯টি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় জামিনে রয়েছেন বলে জানান তিনি। সেই হাজিরা দিতেই তিনি বৃহস্পতিবার আদালতে এসেছেন।
এই আদালতে তার বিরুদ্ধে আরো দুইটি মামলা রয়েছে। তিনি জানান, জামিনে থাকা অবস্থায় শুনানির নির্ধারিত দিনে হাজির না হলে জামিন বাতিল হওয়ার আশঙ্কায় কর্মসূচির দিনেও হাজিরা দিয়েছেন।
বিএনপি অসহযোগের আহ্বান জানানোর পরও কেন তিনি আদালতে এসেছেন তা জানতে চাইলে তিনি বলেন , ২০১৩ সালের মামলায় আগেই তিনি কারাভোগ করেছেন। পরিবার অনেক কষ্ট, হয়রানি ভোগ করেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “এখন আর কোন ঝামেলা চাই না”।
সিএমএম আদালতের চারতলায় আরেকটি এজলাসের সামনে কথা তরিকুল নামে আরেক ব্যক্তির সাথে। ঢাকায় বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন।
তিনি জানান, তার বিরুদ্ধে ডজনখানেক মামলা রয়েছে। পল্টন থানার ২০১৩, ২০১৪, ২০১৮ সালের মামলা এগুলো।
নিজের বড় ভাইয়ের সাথে প্রিন্টিং এর ব্যবসা করতেন। মামলা হওয়ার পর বড় ভাইও ব্যবসা নিয়ে বিপদে রয়েছে বলে জানান তরিকুল । ভাংচুর, পুলিশের কাজে বাধাদানের এসব মামলায় আজ হাজিরা রয়েছে।
তিনি বলেন, এমনিতেই মামলা মাথায় নিয়ে নিজে ও পরিবার ও বিপদে রয়েছে। সাংবাদিকদের সাথে কথা বলে আবারও বিপদে পড়তে চান না।
“পুলিশ পরিবারকেও হয়রানি করে” বলেন তিনি।
বিএনপি নেতা-কর্মীদের মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীরা জানান, কারাগারে থাকা বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস, খায়রুল কবির খোকন, আমানুল্লাহ আমান, শামসুজ্জামান দুদুর বিভিন্ন থানার মামলায় আজ হাজিরা দেয়ার কথা ছিলো। তবে, আদালত ঘুরে ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে কথা বলে জানা যায়, আজ তারা আসেননি হাজিরা দিতে।
আইনজীবীরা জানান, তারা কর্মসূচির অংশ অনুযায়ী, এজলাসে যাবেন না। জুনিয়র আইনজীবীরা এজলাসে যাবেন।
তবে বিএনপি নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন আলালসহ কয়েকজনকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। ২০১৩ সালের নাশকতার মামলায় তাদের আদালতে হাজির করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
দুপুর পৌনে একটায় ঢাকা আইনজীবী সমিতির সামনে অসহযোগ আন্দোলন কর্মসূচির সমর্থনে বিএনপির আইনজীবীদের মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করতে দেখা যায়। এখানে কথা হয় আইনজীবী আনোয়ারুল ইসলামের সাথে। তিনি বলেন, যারা আদালতে হাজিরা দিতে এসেছেন তারা পরিবার নিয়ে বিপাকে রয়েছেন।
ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর মো. আব্দুল্লাহ আবু জানান, বিএনপি যে কর্মসূচি দিয়েছে তা হঠকারী সিদ্ধান্ত। কারণ আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। শুনানির দিন রয়েছে কিন্তু জামিনে থাকা আসামি আদালতে হাজিরা না দিলে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হবে।
তিনি বলেন, বিএনপি নেতাকর্মীরা সুনির্দিষ্ট অভিযোগে করা এসব মামলাকে রাজনৈতিক মামলা বলে অভিহিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু এটা ঠিক নয়।
প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, পুলিশ-লাইন হাসপাতালে আগুন দিয়েছে। এ ধরণের সুনির্দিষ্ট অভিযোগে করা মামলাকে রাজনৈতিক মামলা বলে পার পাওয়া যাবে না। যারাই এ ধরণের অপরাধ করেছেন, বিচার হবে বলে মন্তব্য করেন আব্দুল্লাহ আবু।
বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল বলেন, “রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বিএনপির প্রায় ১৩শত নেতাকর্মীকে গত তিন মাসে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়া যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি”।
তার দাবি, গত ২৮ তারিখ থেকে এ পর্যন্ত হাজার হাজার নেতা কর্মীকে গ্রেপ্তার করলেও যাদের দলীয় পদ-পদবী আছে তাদের কাউকেই উচ্চ ও বিচারিক আদালত থেকে জামিন দেয়া হচ্ছে না।
“এ থেকেই প্রমাণিত হয় বিএনপিকে দমনের জন্য আদালতকে হাতিয়ার হিসেবে এ সরকার ব্যবহার করছে”
“বিএনপির যে নেতা-কর্মীরা কারাগারে রয়েছে তারা রাষ্ট্রীয় হেফাজতে থাকায় পুলিশ হাজির করছে। তবে অন্য নেতাকর্মী হাজিরের কথা আমাদের জানা নেই। দল ঘোষিত অসহযোগ কর্মসূচি বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা সর্বাত্মকভাবে পালন করবে” বলেন কামাল।
বুধবার বিএনপির মুখপাত্র ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ভার্চুয়াল এক সংবাদ সম্মেলনে ‘সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
একইসাথে সাতই জানুয়ারির আসন্ন নির্বাচনকে ডামি উল্লেখ করে তা বর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন।
এসএইচ-০১/২১/২৩ (জান্নাতুল তানভী,বিবিসি)