নির্বাচনের মৌসুমেও আশানুরূপ ব্যবসা নেই প্রিন্টিং প্রেসে!

“এর আগে নির্বাচনের সময় অনেক কাজ থাকতো, দিনরাত কাজ করে দম নেয়ার সময় পেতাম না। এবার দল অল্প কয়েকটা, তাই পোস্টারের অর্ডারও অন্যবারের চেয়ে অনেক কম।”

নির্বাচনের মৌসুমেও আশানুরূপ ব্যবসা নেই, তাই এভাবেই আক্ষেপ করছিলেন পুরান ঢাকার বাবুবাজারের প্রিন্টিং প্রেস ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম।

এবারের জাতীয় নির্বাচনে অন্যতম বিরোধী দল বিএনপি সহ একাধিক দল অংশগ্রহণ না করায় ছাপাখানাগুলোর কাজের চাহিদা কমে গেছে বলে দাবি করছেন তার মত অনেক প্রিন্টিং প্রেস ব্যবসায়ী।

নির্বাচনের প্রচারণাকে ঘিরে সবসময়ই প্রার্থীদের পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন, লিফলেট ছাপার কাজ হয়ে থাকে ছাপাখানাগুলোয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ছাপা হয় প্রার্থীদের পোস্টার।

গত ২৭ বছর ধরে ছাপাখানার ব্যবসার সাথে জড়িত শহিদুল ইসলাম বলছিলেন অন্যান্যবার নির্বাচনের আগে পোস্টার ছাপানো নিয়ে ছাপাখানাগুলোর নিজেদের মধ্যে একরকম প্রতিযোগিতা হত, কিন্তু এবার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা।

“আগে দেখা যেত একই প্রার্থীর পোস্টার ছাপাত একাধিক ছাপাখানা, নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হত যে কে কত বেশি কাজের অর্ডার নিয়ে আসতে পারবো। প্রায় সব প্রেসেই পোস্টারের কাজ হত। এবার হাতে গোনা কয়েকটা প্রেসে পোস্টারের কাজ হচ্ছে।”

বাবুবাজার এলাকার কয়েকটি ছাপাখানার মালিকের সাথে কথা বলে একই রকম ধারণা পাওয়া গেল। অধিকাংশ ছাপাখানার মালিকই বলছিলেন যে আগের নির্বাচনের তুলনায় এবার পোস্টার, ব্যানার ছাপানোর হার অনেক কম।

ব্যবসার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মাইক ও সাউন্ড সিস্টেম ব্যবসায়ীদের কণ্ঠেও হতাশা ফুটে ওঠে। নির্বাচনের সময় প্রচারণার কাজে ব্যবহার হয় বলে এই পণ্যটিরও এ সময়ে সাধারণত ব্যাপক চাহিদা থাকে।

তাদের ভাষ্য, আগের জাতীয় নির্বাচনের তুলনায় এবার মাইক ও সাউন্ড সিস্টেমের চাহিদাও অনেক কম।

নরসিংদীর মাইক ও সাউন্ড সিস্টেম ব্যবসায়ী জামাল হোসেন নির্বাচনের আগে প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা খরচ করে পুরনো মাইক ঠিক করেন আর নতুন মাইক কিনেছেন। তার আশা ছিল নির্বাচনের প্রচারণার কাজে ভাড়া দিয়ে এক লাখ টাকার বেশি আয় করতে পারবেন তিনি।

কিন্তু প্রচারণা শুরুর পর নয়দিন হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত তিন দিন চার সেট মাইক ভাড়া দিতে পেরেছেন তিনি। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে মূলধনের টাকা উঠে আসবে কিনা, তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি।

জামাল হোসেন বলছিলেন, “প্রচারণার অর্ধেক শেষ। এখনও অর্ধেক মূলধনই ওঠে নাই। ”

জাতীয় নির্বাচনের আগে সবসময়ই মাইক ও সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবসায়ীরা নতুন যন্ত্রপাতি কিনে থাকেন। সারা বছর ব্যবসা ভালো না থাকলেও নির্বাচনের মৌসুমে তা পুষিয়ে নেয়ার চিন্তা থেকেই এই বিনিয়োগ করেন তারা।

কিন্তু এবার নতুন যন্ত্রপাতি কেনা তো দূরের কথা, ব্যবসায়ীদের পুরনো যন্ত্রপাতিই অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে বলে বলছিলেন সিলেট জেলার মাইক ও সাউন্ড সিস্টেম মালিক কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক নাজিকুল ইসলাম ভুইঞা।

“জাতীয় নির্বাচনে সব ব্যবসায়ীর হাতেই বিপুল পরিমাণ কাজ থাকে বলে বাইরে থেকে মাইক ও সাউন্ড সিস্টেম ভাড়া করা সম্ভব হয় না। আগের জাতীয় নির্বাচনে আমাদের সমিতির অধীনে থাকা ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ ও বড় প্রতিষ্ঠানগুলো তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করে নতুন যন্ত্রপাতি কিনেছিল। হাতে যথেষ্ট কাজ থাকায় অধিকাংশই সেই টাকা উঠিয়ে নিতে পেরেছিল।”

এবারের নির্বাচনের প্রচারণার এক সপ্তাহের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। কিন্তু এখনও অনেক প্রতিষ্ঠানই কাজ ছাড়া অলস সময় পার করছে বলে বলছিলেন মি. ভুইঞা।

ছাপাখানা ও সাউন্ড সিস্টেম ব্যবসায়ীরা বলছেন, সবগুলো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে আসলে প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব থাকতো এবং পোস্টার, মাইকের মত পণ্যের চাহিদাও তুলনামূলক বেশি থাকতো।

অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যদিও মনে করছে সব দল না থাকায় তাদের আশানুরূপ ব্যবসা হচ্ছে না, সব ব্যবসায়ী সংগঠন কিন্তু তাদের এই যুক্তি মানছেন না।

যেমন ছাপাখানাগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ রব্বানি জব্বারের মতে ছাপাখানায় কাজ কমে যাওয়ার পেছনে সব রাজনৈতিক দলের অংশ না নেয়ার সরাসরি সম্পর্ক নেই।

তিনি বলছিলেন সব দল অংশ না নিলেও অনেক আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের সম্ভাবনা আছে। যার ফলে প্রার্থীরাও পোস্টার ছাপাতে কার্পণ্য করেননি।

আগের নির্বাচনের তুলনায় কিছু পোস্টার কম ছাপা হলেও সেই সংখ্যাটা বেশি না বলে মনে করেন তিনি।

তিনি অনুমান করছিলেন সব দল অংশ না নেয়ায় আগের বারের চেয়ে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পোস্টার কম ছাপা হতে পারে।

ছাপাখানা গুলোয় কাজের চাহিদা কমে যাওয়ার বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেন তিনি।

মুদ্রণ প্রযুক্তির পরিবর্তন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি, আবহাওয়া সহ বেশ কিছু বিষয়ের কারণে ছাপাখানা গুলোয় কাজ কমেছে বলে বলছিলেন তিনি।

“কয়েক বছর আগেও কিন্তু সারা দেশে এত প্রিন্টিং প্রেস ছিল না। এখন জেলায় তো বটেই, অনেক উপজেলাতেও আধুনিক প্রেস রয়েছে।”

“তাই একসময় যেমন সব ছাপার কাজ ঢাকায় আসতো, এখন কিন্তু তেমনটা হয় না। কাজের পরিমাণে খুব বেশি পার্থক্য হয়নি, কিন্তু কাজটা অনেক ছাপাখানার মধ্যে ভাগ হয়ে পড়ায় কাজের চাপ কমেছে”, বলছিলেন জব্বার।

পাশাপাশি ডিজিটাল প্রিন্টিংয়ের প্রসারের ফলে পুরনো প্রযুক্তি নির্ভর প্রেসগুলোর কাজও কমেছে।

“আধুনিক মেশিনে ঘণ্টায় আট-দশ হাজার পোস্টার প্রিন্ট করা যায়। পুরনো প্রেসের তুলনায় এতে সময় অনেক কম লাগে। তাই খরচ কিছুটা বেশি হলেও অনেকেই এখন ডিজিটাল মেশিনে প্রিন্ট করেন”, বলছিলেন মি. রাব্বানি।

নির্বাচন কমিশনের বিধান অনুযায়ী একজন প্রার্থী প্রচারণার কাজে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা খরচ করতে পারবেন। তাই গত নির্বাচনের তুলনায় কাগজ ও কালির দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রার্থীরা এবার কিছুটা কম পোস্টার ছাপাচ্ছে বলে ধারণা প্রকাশ করেন মি. জব্বার।

মুদ্রণ শিল্প সমিতির হিসেব অনুযায়ী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পোস্টার, ব্যানার, লিফলেট, ফেস্টুন সহ বিভিন্ন জিনিস ছাপার পেছনে মোট ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল।

জব্বারের অনুমান অনুযায়ী, এবারের নির্বাচনে পোস্টার ছাপা ১০ ভাগ কম হলেও আগের নির্বাচনের তুলনায় এবার ছাপার কাজ বাবদ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেশি অর্থ খরচ হবে।

এসএইচ-০৭/২৭/২৩ (অনলাইন ডেস্ক, বিবিসি)