বিএনপির অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিচ্ছে মানুষ!

জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি বলছে, অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়ার সপ্তাহ খানেক পর মানুষের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। তারা দাবি করছে, আদালতে হাজিরা বর্জন-সহ কর ও খাজনা দেয়া থেকেও বিরত থাকছেন দলীয় নেতা-কর্মীরা।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুহুল কবির রিজভী বলেন, “আমরা প্রতিক্রিয়াগুলো দেখছি, তাতেই মনে হচ্ছে যে তারা (জনগণ) আমাদের পক্ষে রয়েছে।”

দলটির তৃণমূল স্তরের নেতাকর্মীরা বলছেন, জনসংযোগ ও প্রচারণা চালাতে গিয়ে তারা মানুষের সাড়া পাচ্ছেন তো বটেই, একই সাথে মানুষ তাদেরকে আরো কঠোর কর্মসূচিতে নামার জন্যও অনুপ্রাণিত করছে।

গত ২০শে ডিসেম্বর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ‘বর্তমান সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত’ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয় বিএনপি। সাতই জানুয়ারির ভোট বর্জন করা, ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ কিনা তা ভাবা এবং আদালতে মামলায় হাজিরা দেয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানায় দলটি।

একই সাথে কর ও বিভিন্ন সেবার বিল না দেয়ার জন্য প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

বৃহস্পতিবার কর আদায়কারী কর্তৃপক্ষ অবশ্য জানিয়েছে যে, বিএনপির এই আন্দোলনের কারণে গত সপ্তাহ খানেক সময়ে কর আদায়ে কোনও প্রভাব পড়তে দেখা যায়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কর আদায়ের ক্ষেত্রে তারা অসহযোগ আন্দোলনের কোন প্রভাব দেখছেন না।

তিনি বলেন, গতবারের তুলনায় এ বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত কর আদায়ের প্রবৃদ্ধি বেশি।

“সে ক্ষেত্রে আমার এখানে অসহযোগ বা ট্যাক্স দিচ্ছে না এরকম মনে হচ্ছে না,” বলছিলেন তিনি।

অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়ার পরদিন রাজধানীর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে বিএনপির নেতাকর্মীরা হাজিরা দিতে এসেছেন।

বিশেষ করে যারা নাশকতার মামলায় জামিনে রয়েছেন শর্ত অনুযায়ী নির্ধারিত দিনে হাজির হয়েছেন তারা। এমন বেশ কয়েক জন নেতার সাথে বিবিসি বাংলার কথাও হয়।

তবে এদিন কারাগারে থাকা দলটির বেশ কয়েক জন সিনিয়র নেতা আদালতে হাজিরা দেয়া থেকে বিরত ছিলেন।

সবশেষ গত ২৭শে ডিসেম্বর (বুধবার) আগামী ১লা জানুয়ারি থেকে ৭ই জানুয়ারি পর্যন্ত আপিল বিভাগ, হাইকোর্ট বিভাগসহ সারাদেশের সকল আদালত বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম।

এ সম্পর্কিত এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব কায়সার কামাল ওই সাতদিন আপিল বিভাগ, হাইকোর্ট বিভাগ, সমস্ত জেলা আদালত, সেশন আদালত, মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত, মুখ্য জুডিশিয়াল আদালতসহ সমস্ত আদালত বর্জন করার কথা জানান।

বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা বলছেন, নানা ধরণের মামলা আর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি থাকার কারণে জেলা পর্যায়ে নেতাকর্মীদের আদালতে হাজিরা দেয়ার পরিমাণ এক সপ্তাহ পর কমে এসেছে।

তারা বলছেন, অসহযোগ আন্দোলন কতটা সফল হবে তা ৭ই জানুয়ারির পর বোঝা যাবে। তবে জনসংযোগ চালাতে গিয়ে ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছেন তারা।

ময়মনসিংহ জেলার মহানগর ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজিজুল হাকিম বলেন, নির্বাচন বর্জনের জন্য তারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছেন।

তিনি জানাচ্ছেন, “প্রতিনিয়ত আমরা কথা বলতেছি, জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতেছি এবং মানুষের মধ্যে খুব উৎসাহ উদ্দীপনা কাজ করতেছে।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা লিফলেট বিতরণের কার্যক্রমে যদি ২০ জন যাই, আমাদের সাথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আরো ২০ জন সাধারণ মানুষ এসে যোগ দেয়, আমাদের কাছ থেকে লিফলেট চেয়ে নেয়। আমাদের মৌন সম্মতি জানায়।”

জেলার বিএনপির নেতাকর্মীরাও এরই মধ্যে আদালতে হাজিরা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে বলেও জানান তিনি। এছাড়া রাষ্ট্রীয় কর ও খাজনা দেয়া থেকেও তারা বিরত থাকছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় এই নেতা।

তিনি বলেন, সাধারণ মানুষদের অনেকেই জানিয়েছে যে, তারা আসলে ৭ তারিখেও ভোট কেন্দ্রে যাবেন না এবং পরিচিত জনদেরও কেন্দ্রে যেতে নিরুৎসাহিত করবেন।

মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম খান বলেন, নেতাকর্মীদের আদালতে হাজিরা দেয়ার পরিমাণ কমে গেছে। বেশিরভাগ নেতাকর্মীরাই যাচ্ছে না।

কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “এমনিতেই নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নতুন নতুন মামলা দেয়া হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। আবার দ্রুত বিচার কাজ শেষ হওয়ার কারণে অনেকেরই সাজা হয়ে গেছে। এমন অবস্থায় গ্রেফতার এড়াতে বেশিরভাগ নেতাকর্মীই পলাতক। তাই আদালতে হাজিরা না দেয়ার বিষয়টি এমনিতেই হয়ে যাচ্ছে।”

“আমাদের বেশিরভাগ পলিটিক্যাল নেতারা তো এমনিই পলাতক। হাজিরা দেয়ার সুযোগ তাদের নাই। আর যাদের পদ-পজিশন আছে, তারা কেউই হাজিরা দিচ্ছে না কোর্টে।”

গণসংযোগ নিয়মিত চলছে উল্লেখ করে মি. খান আরও বলেন, প্রত্যন্ত এলাকাতে গিয়েও তারা দেখেছেন যে বিএনপির অসহযোগ আন্দোলন কর্মসূচি সম্পর্কে জানেন এমন মানুষের সংখ্যাই বেশি। তাই তাদের খুব বেশি কিছু বলতেও হচ্ছে না।

তিনি বলেন, বিএনপির মূল টার্গেটই হচ্ছে সাত তারিখের নির্বাচন। “মানুষকে জানানো যে, এই নির্বাচনটা আসলে ডামি নির্বাচন।”

তবে লিফলেট বিতরণ করতে গেলে সাধারণ মানুষ অনেক ক্ষেত্রে তাদেরকে আরো কঠোর কর্মসূচি দিতে অনুপ্রাণিত করে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

খান বলেন, “তারা অনেক সময় আমাদের ইন্সপায়ারও করে। যে আপনারা চালায় যান। এর চেয়েও কঠোর কিছু থাকলে আমাদের বলতে বলে। কিন্তু আমরা তো … সহিংস কোন কর্মসূচিতে আমাদের দল যাচ্ছে না আর কী।”

“অনেক সময় জনগণ আমাদের তো দেখা যায়, বিভিন্ন কোয়েশ্চেন অ্যারাইজ করে যে, আপনারা তো কঠিন কোন কর্মসূচিতে যাচ্ছেন না। তারা হয়তো ভাবতেছে যে … কিন্তু জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচি তো আমাদের নাই!”, বলছিলেন সাউফুল ইসলাম খান।

বিএনপি ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলন সফল করতে প্রাথমিকভাবে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ করা হচ্ছে। এর আওতায় জনসংযোগ ও লিফলেট বিতরণের কাজ করছে দলটি।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুহুল কবির রিজভী বলেন, অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।

“আমরা যখন লিফলেট বিতরণ করছি, তখন উপস্থিত যারাই থাকুক, সবজি বিক্রেতা, রিকশাচালক – যারাই থাকুক, তাদের যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেটিকে গ্রহণ করা, এবং এটা নিয়ে তাদের যে আমরা প্রতিক্রিয়াগুলো দেখছি, তাতেই মনে হচ্ছে যে তারা (জনগণ) আমাদের পক্ষে রয়েছে।”

তিনি বলেন, “আমাদের যে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি, নির্বাচন বর্জনের কর্মসূচি, তাতে তারা পূর্ণ মাত্রায় সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।”

আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। এখন চলছে প্রচারণা। বিএনপি তাদের আন্দোলনের ঘোষণায় বলেছে, এই নির্বাচনকে বর্জন করতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করাই তাদের মূল টার্গেট। আর এই লক্ষ্যের প্রতি এগিয়েও যাচ্ছে তারা।

রিজভী বলেন, তারা মনে করছেন যে, আগামী সাতই জানুয়ারির ভোটের দিনেও মানুষ বিএনপির আদর্শকে সমর্থন করে ভোট বর্জন করবে এবং বিএনপি-র ভাবধারা বিজয়ী হবে।

এরআগে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল যে, তৃণমূলে দলটির নেতাকর্মীরা বাড়িতে থাকতে পারছে না এবং বিএনপির নেতাকর্মীদের উপর ধরপাকড় চালানো হচ্ছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও দলটির এই অসহযোগ কর্মসূচি সফল করতে তারা অংশ নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন মি. রিজভী।

তিনি বলেন, “এর মধ্যেও কিন্তু নেতাকর্মীরা নামছেন। এতো কিছু তারা ধারণ করেও, এতো কিছু সহ্য করেও তারা নামছেন।”

অসহযোগ আন্দোলনের একটি ঘোষণা ছিল, নেতাকর্মীদেরকে আদালতে হাজিরা দিতে যেতে নিষেধ করা। বিএনপির এই নির্দেশ মানা হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মি. রিজভী বলেন, এক্ষেত্রেও তারা ভাল অংশগ্রহণ দেখতে পাচ্ছেন।

তিনি বলেন, “আমাদের প্রত্যেকের নামে মামলা, প্রতিদিন মামলা হচ্ছে, কিন্তু আমরা যতটুকু পারছি, আমরা আমাদের অবস্থান থেকে আমরা সেখানে যাচ্ছি না। আমাদের নেতাকর্মীরা যাচ্ছে না। যারা সমর্থক তাদেরকে আমরা বলছি, তারাও এটাতে সাড়া দিচ্ছেন।”

“নিঃসন্দেহে একটা প্রভাব তৈরি হচ্ছে। আমরা জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলছি। জনগণ তো আমাদের পক্ষেই থাকবে এবং তাদের সাড়া থাকবে বিরোধী দলের যে কর্মসূচি সেই কর্মসূচির প্রতি।”

“হয়তো অনেকে ভয় পেয়ে রাস্তায় নামতে ভয় পাচ্ছে। কিন্তু তার অবস্থান থেকে তারা কিন্তু সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে”, জানাচ্ছেন তিনি।

এসএইচ-০১/২৮/২৩ (মুন্নী আক্তার,বিবিসি)