আ’ লীগ অন্তত ৫০ ভাগ ভোটারের উপস্থিতি চায়!

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন দোরগোড়ায়৷ বিএনপিবিহীন এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা কতটা এ প্রশ্নের জবাব সরকারি দল আওয়ামী লীগ খুঁজছে ভোটারের উপস্থিতিতে৷

প্রতিদিনের মতো আজও সকাল আটটায় দোকান খোলেন আমিনুল ইসলাম৷ মতিঝিল শাপলা চত্বরের ব্যস্ত সড়কের রিকশা-গাড়িগুলো তার দিকে ধুলো ছিটিয়ে চলে গেলেও এই ফুটপাতই তার প্রিয়৷ একটা মোটা চাদরই তার দোকানঘর৷ সেটির ওপর লুঙ্গি আর গামছার বেশ রঙিন পসরা সাজিয়ে বসেছেন তিনি৷

‘‘শুভ নববর্ষ৷ কেমন আছেন?’’ প্রশ্ন করতেই মাথা তুলে তাকালেন৷ কেউ বোধ হয় এমন প্রশ্ন করেন না৷

আবার প্রশ্ন করলাম, ‘‘নির্বাচনের বছর কেমন শুরু করলেন?’’

‘‘টাকাগুলোই নষ্ট,’’ এবার উত্তর দিলেন৷

আটচল্লিশ বছর বয়সd আমিনুলের কাঁচা-পাকা দাড়ি৷ একটু আগে পান চিবিয়ে ঠোঁট লাল করে রেখেছেন৷

‘‘এত এত টাকা খরচ করে এই নির্বাচন করে লাভ কী? ফলাফল তো সবারই জানা,” একটু উষ্মা তার কণ্ঠে৷

ভোট দিতে যাবেন কি না, এমন প্রশ্নের উত্তর মিললো না আমিনুলের কাছে৷ গেল কয়েকদিন এমন উৎসাহের অভাব চোখে পড়েছে অনেকের মধ্যেই৷ কেউ কেউ অবশ্য বলেছেন, তারা ভোট দিতে যাবেন৷ কিন্তু না যাওয়া বা দ্বিধায় থাকা মানুষেরও অভাব নেই৷

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি এবারের নির্বাচনে না থাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর মোটা দাগে ফলাফলের অনিশ্চয়তার অভাবে মানুষের মাঝে উৎসাহের এমন অভাব দেখা গেছে৷

বিএনপি এবারের নির্বাচন বর্জন করেছে৷ ২৮ অক্টোবরের পর তাদের নেতা-কর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড়ের ফলে নির্বাচনে যাবার আর কোনোও সুযোগ ছিল না বলে অনেকের মত৷

তাদের নেতা-কর্মীরা বলছেন, এই নির্বাচনের আর কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই৷ তারা মানুষকে ভোটকেন্দ্রে যেতে অনুৎসাহিত করছেন৷

অন্যদিকে, বিএনপি যেহেতু নেই, ভোটের মাঠে মোটা দাগে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাও নেই আওয়ামী লীগের৷ কিন্তু নির্বাচনকে দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যও করতে হবে৷ সে কারণে তারা এবার গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে বেছে নিয়েছে ভোটারের উপস্থিতিকে৷ তারা মনে করছে, অন্তত ৫০ ভাগ ভোটার উপস্থিত হলেই সাধারণ মানুষ বিএনপিকে বর্জন করেছে বলে যুক্তি দিতে পারবেন দলটির নেতারা৷

ভোটার আনতে কৌশল

৭ জানুয়ারি ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে আওয়ামী লীগ কয়েক স্তরের কৌশল হাতে নিয়েছে৷ তাদের এই কৌশলের প্রথম স্তর হলো আওয়ামী লীগের সব কর্মী ও তাদের পরিবারের ভোটারদের সবাইকে ভোটকেন্দ্রে আনা৷ তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের তেমনই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে৷ এর বাইরে সাধারণ ভোটারদের তালিকা করে তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটকেন্দ্রে আসার অনুরোধ করা হচ্ছে৷ এছাড়া এলাকায় বয়োজ্যেষ্ঠদের নিয়ে করা হচ্ছে উঠান বৈঠক৷ সেসব উঠান বৈঠকে প্রার্থীরাও কখনো কখনো আসছেন৷ তৃণমূল পর্যায়ে কর্মীদের এমনকি লক্ষ্যও নির্ধারণ করে দেয়া হচ্ছে৷

সরেজমিন রাজধানীর কয়েকটি আসনে ঘুরে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছেন৷

যেমন, ঢাকার জুরাইন এলাকায় কথা হচ্ছিল ঢাকা-৪ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী সানজিদা খানমের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে৷ তিনি স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট৷

‘‘আমরা আমাদের পরিবারের ভোটগুলো সুনিশ্চিত করবো৷ এটা আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার,’’ বললেন রাজ্জাক৷ ‘‘সকল জায়গায় সকল কর্মীর কাছে এরই মধ্যে আমরা নির্দেশনা পৌঁছে দিয়েছি৷’’

রাজ্জাক বলেন, দ্বিতীয় পর্যায়ে তারা পুরুষ ও নারী কর্মীদের বিভিন্ন এলাকায় পুরুষ ও নারী ভোটারদের কাছে পাঠাচ্ছেন৷

‘‘আমরা বলছি, আপনারা ভোট দিতে আসবেন৷ আপনারা যেন সুষ্ঠুভাবে সুন্দরভাবে ভোট দিতে পারেন, সরকারি দল হিসেবে আমরা তা নিশ্চিত করছি,” বলেন রাজ্জাক৷

এছাড়া প্রত্যেক কর্মীর জন্যও টার্গেট নির্ধারণ করে দেয়া হচ্ছে বলে জানালেন রাজ্জাক৷

‘‘আমরা প্রত্যেক কর্মীকে বলছি, পাঁচ জন করে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসবেন৷ আমাদের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কর্মী ৮১ জন৷ এছাড়া ইউনিট আছে ১২টি৷ সেখানে ৩৭ জন করে৷ এছাড়া আছে সহযোগী সংগঠন৷ আছে দু’টি থানা কমিটি৷’’

এভাবে অন্তত ৫০ ভাগ ভোট নিশ্চিত করতে পারবেন বলে মনে করছেন রাজ্জাক৷

কিন্তু ভোটাররা কেন্দ্রে যাবেন তাদের ইচ্ছায়৷ তাদের এভাবে ভোটকেন্দ্র উপস্থিত করাটা কতটা যৌক্তিক? এ প্রশ্নের জবাবেপ্রধানমন্ত্রীর সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান বলেছেন, এটা কোনো সমস্যা নয়৷

‘‘অনেক দেশে ভোটারদের ভোটদানে বাধ্য করার আইন আছে৷ আমাদের দেশে সেটি নেই৷ আওয়ামী লীগ যদি ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসতে উৎসাহিত করে, সেটিতে কোনো অন্যায় নেই৷ যদি আওয়ামী লীগ শুধু নিজেদের ভোটারদের টেনে আনতো, তাহলে সেটি নিয়ে সমালোচনা করা যেতো৷’’

নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি শুধু ভোটার উপস্থিতি কিনা সে বিষয়ে ভিন্নমত আছে অনেকের৷ তার একজন ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন৷ সাবেক এই নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল ভোটার উপস্থিতির মাধ্যমে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে৷

তিনি বললেন, ‘‘যদি বলা হয়, ভোটারদের উপস্থিতি হলেই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে, তাহলে তা সঠিক নয়৷ তাছাড়া আপনি ভোটারদের বাধ্য করতে পারেন না৷ এটা ঐচ্ছিক বিষয় তাদের জন্য৷’’

সাখাওয়াত বলেন, যদি আওয়ামী লীগ ভোটারদের আনতে প্রচারণাও চালায় তারপরও খুব বেশি সংখ্যক মানুষ ভোটকেন্দ্রে আসবেন না, যদি না তারা নিজেরা চান৷

‘‘তারা হয়তো তাদের সমর্থকদের আনতে পারবেন৷ কিন্তু শুধু তাদের দিয়ে খুব বেশি ভোট কাস্টিং হবে বলে আমি মনে করি না৷’’

তার কাছে প্রশ্ন ছিল কত ভোটার উপস্থিত হলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়? জবাবে সাখাওয়াত বললেন, ‘‘এমন কোনো সংজ্ঞা নেই যে এত শতাংশ ভোট পড়লে আপনি দ্বিতীয় পর্যায়ে যাবেন৷ এখন গড়ে বাংলাদেশে ৭০ ভাগ ভোট পড়ে নির্বাচনগুলোতে, তা-ও যদি সব দল অংশ নেয়৷’’

তিনি মনে করেন, এই নির্বাচনে কোনভাবেই ৭০ ভাগ ভোট পড়ার সম্ভাবনা নেই৷

এসএইচ-০২/০১/২৪ (যুবায়ের আহমেদ, ডয়চে ভেলে)