ভোট না দিলে ভাতা বন্ধের হুমকি

রোববার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটারদের কেন্দ্রে উপস্থিত করাই এখন আওয়ামী লীগ, সরকার ও নির্বাচন কমিশনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য তারা নানা কৌশল অবলম্বন করছেন।

ভোট না দিলেসরকারি ভাতার কার্ড বন্ধের কথাও বলা হচ্ছে কোনো কোনো এলাকায়।

অন্যদিকে বিএনপি রোববার ভোটের দিনসহ ৪৮ ঘণ্টার হরতাল কর্মসূচি পালন করছে। তারা ভোট বর্জন ও ভোটারদেরও ভোট কেন্দ্রে না যেতে বলছে।

সাতক্ষীরা সদরের ধুলিহর ইউনিয়নের ৮ নাম্বার ওয়ার্ডের ইউপি মেম্বার মৃণাল মোর্শেদ। তিনি জানান, ‘‘আমরা ভোটকেন্দ্রে ভোটাররা যাতে যায় তার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করেছি। আমাদের চেয়াম্যান মো. মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে কাজ করছি। এর মধ্যে একটি হলো সরকারের বিভিন্ন ধরনের যারা ভাতাভোগী তাদের মৌখিকভাবে জানিয়ে দিয়েছি তাদের অবশ্যই ভোটকেন্দ্রে আসতে হবে। নয়তো তাদের ভাতা বন্ধের আশঙ্কাসহ নানা সমস্যা হবে। ইউনিয়ন পরিষদের ভাতাভোগীদের তালিকা আছে। সেই তালিকা ধরে সবাইকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।”

ওই ইউয়িনে মোট নয়টি ওয়ার্ড। সব ওয়ার্ডেই একইভাবে ভোটারদের কেন্দ্রে নেয়ার জন্য কাজ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।তিনি বলেন,” এভাবে আরো অনেক কৌশল অবলম্বন করেছেন আমাদের চেয়ারম্যান সাহেব। উঠান বৈঠক করে বুঝিয়েছেন। বলেছেন ভোট গণতান্ত্রিক অধিকার। এটা দিতে হবে।”

ভাতাভোগীরা ভোট না দিতে গেলে তাদের চিহ্নিত করার ব্যবস্থাও করা হয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ভাতাভোগীদের তালিকা এবং ভোটার নাম্বার তো আছে। যারা ভোট দেবেন কেন্দ্রের ভোটার লিষ্টে তাদের নামের পাশে তো টিক চিহ্ন দেয়া থকবে। যারা ভোট দেবেন না তাদের নামের পাশে তো টিক চিহ্ন থাকবেনা।

তিনি জানান, তার ওয়ার্ডে তিন হাজার ৫০০ ভোটার। তার মধ্যে প্রবীণ নাগরিক, বিধাব, প্রতিবন্ধী সবমিলিয়ে প্রায় ৮০০ ভাতাভোগী আছেন।

শনিবার ভোটের আগেরদিন রাত ১২ পর্যন্ত ভোটাদের কেন্দ্রে নেয়ার নানা কৌশলে কাজ চলবে বলে জানান ওই ইউপি সদস্য। তবে তার কথা, ” ভোটের দিন আসলে বোঝা যাবে এই কৌশল কতটা কাজ করেছে।”

তিনি আরো জানান, ‘‘আমরা ভেটারদের কেন্দ্রে নেয়ার জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা করছি। এছাড়া সকারের পক্ষ থেকেও প্রতিটি ওয়ার্ডে তিনটি করে ইঞ্জিন চালিত ভ্যান দেয়া হয়েছে ভোটারদের নেয়ার জন্য।”

গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ভোলা-৪(চরফ্যাশন-মনপুরা) আসনের আসলামপুর ইউনিয়নের আয়েশাবাদ গ্রামে পাঁচ-ছয়টি উঠান বৈঠক হয়। আয়োজক ছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নূর আলম মাস্টার। ওই বৈঠকে উপস্থিত এক নারী শাহানারা বেগম ( প্রকৃত নাম নয়) জানান,” তারা আমাদের বলেছেন আপনারা ভোট দেন বা না দেন ভোট কেন্দ্রে যাবেন এবং অনেকক্ষণ থাকবেন। আমাদের কিছু বড় ভাই আসবেন তারা ছবি তুলবেন। ছবি তোলার পর আপনারা চলে যাবেন।”

তিনি বলেন,” তারা আরো বলেছেন আমরা ভোট দিতে না গেলে এখানকার কোনো উন্নয়ন হবে না। ব্যবসাবাণিজ্য হবেনা। আর পুরুষদের বলেছে আমরা( নারীরা) উঠান বৈঠকে না গেলে আপনারা যে রেশন কার্ড পান তা আর পাবেন না। সব মহিলাদের উঠান বৈঠকে পাঠিয়ে দেবেন।”

তার কথা,” উঠান বৈঠকে আমাকে বলা হয়েছে আপনার আশপাশের সবাইকে নিয়ে ভোট কেন্দ্রে যাবেন। আর কারা কারা না যায় তাদের নাম জানাবেন।”

এক নারী বলেন, “আমি বিএনপি বা আওয়ামী লীগ কোনো দলের না। ওই দিন আমরা যারা উঠান বৈঠকে গেছি তারা ভয়ে গিয়েছি। না গেলে আমাদের যদি কোনো ক্ষতি হয়।”

ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন আরেকজন নারী জানান,” আমরা গরিব মানুষ। সবাই যা বলে তা করতে হয়। যদি ভোট দিতে না যাই তাহলে আমাদের পিছনে অনেকে লাগতে পারে। তখন আমরা বিপদে পড়ব। তাই আমি ভোট দিতে যাব।”

মংলার চাঁদপাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তরিকুল ইসলাম বলেন,”ভোটারা ভোট কেন্দ্রে যাবে না, এরকম কোনো শব্দ আমার ইউনিয়নে নেই। এখানে বিএনপির কোনো আন্দোলন নাই, কোনো হরতাল অবরোধ নাই। ভেটারদের ভোট কেন্দ্রে নেয়ার সব ব্যবস্থা করেছি। আমরা এলাকায় ৯০ শতাংশ ভোট পড়বে।” তিনি জানান, মেম্বার ছাড়াও চৌকিদার, দফাদাররাও ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে নেয়ার কাজ করছেন।”

ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে নেয়ার জন্য ঢাকায়ও কাজ করছেন আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীর।

ঢাকার কলাবাগানের বসিরউদ্দিন রোড ইউনিট আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আনোয়ার হোসেনকে শনিবার দুপুরে দেখা গেল ভোটার স্লিপ তৈরি করছেন বিতরণের জন্য। তার ব্যস্ততার ফাঁকে জানতে চাই ভোটারদের সাড়া কেমন? ভোটরার কি ভোট কেন্দ্রে যাবেন? তার সাফ জবাব, “ভোট কেন্দ্রে না যাওয়া বলে কোনো শব্দ নাই। ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের যেতে হবে। এর কোনো বিকল্প নাই। ভোটারদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। তারা আমাদের কথা দিয়েছেন ভোট কেন্দ্রে যাবেন। না যাওয়ার কোনো সুযোগ নাই।”

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা জানান, “যারা বয়স্ক ভাতা পায়, রেশন কার্ড আছে তাদের আলাদা তালিকা করেছি। ডাবল ডাবল টিম করেছি। তাদের মনিটরিং-এ রাখা হবে। ভোট কেন্দ্রে না যাওয়া বলে কথা নেই। আমরা বাসা থেকে তাদের ভোট কেন্দ্রে নিয়ে যাবো। রিকশা, অটোরিকশা, ভ্যান থাকবে। চা-নাস্তার ব্যবস্থা থাকবে। তারা গিয়ে কোন মার্কায় ভোট দেবে জানিনা। কিন্তু ভোট কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হবে।”

ভোট দিতে না গেলে যাদের কার্ড আছে তা বাতিল করা হবে কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন,” বাতিলের প্রশ্ন কেন? তারা তো ভোট দিতে যাবেন। ভোটেও না হবেনা, কার্ডও বাতিল হবেনা।”

তিনি আরো জানান, ‘‘আমার ইউনিটে ২০টি নারী টিম করেছি। স্বেচ্ছাসেবক লীগের ২০ জন এবং আওয়ামী লীগের ২০ জন নিয়ে পুরুষদের টিম করা হয়েছে। আমাদের এই ইউনিটে সাত হাজারের মতো ভোটার আছে। সবাইকে ভোট কেন্দ্রে যেতে বলা হয়েছে। তারা যান কী না তা আমরা খেয়াল রাখবো।”

দেশের সব এলাকায়ই ভোটাররা যাতে ভোট কেন্দ্রে যান তা নিশ্চিত করতে কমিটি গঠন করা হয়েছে। দলীয় নেতা-কর্মী ছাড়াও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার, চকিদার , দফাদার সবাইকে এই কাজে লাগানো হচ্ছে । তারা বিভিন্ন এলাকায় এটা নিয়ে ভোটাদের ডেকে বৈঠকও করেছেন। আর আনসার সহ সরকারি কর্মকর্তাদেরও ভোট দিতে বলা হয়েছে যার যার কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে। আর যারা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত তাদের এবং পরিবারের সদস্যদের সকালেই ভোট কেন্দ্রে যেতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

এর আগে বগুড়া-৪ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য জিয়উল হক মোল্লা নির্বাচনে ভোট দিতে না গেলে প্রকাশ্য সনসভায় সব সরকারি সুযোগসুবিধা বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেন। তিনি নির্বাচনী সভায় বলেন,” কী কী সরকারি সুযোগ সুবিধা? যেমন ভিজিডি, ভিজিএফ, বিধবা ভাতা, বয়স্ক-ভাতা এই ধরনের বিভিন্ন ভাতা আছে। সরকার এগুলোর তালিকা করবে এবং যারা ভোট দিতে যাবে না এগুলোর সুবিধা থেকে ভবিষ্যতে বঞ্চিত হবে।” পরে অবশ্য তিনি তার বক্তব্যেও জন্য ক্ষমা চেয়েছেন।

আর নৌকা প্রতীকে ভোট না দিলে ভোটার আইডি থেকে নাম কাটার হুমকি দেন বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আসাদুর রহমান দুলু নির্বাচনি সভায়।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন,” ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে যেতে চাপ দেয়ার অভিযোগ ঠিকনা। এগুলো বিএনপির প্রচারণা। আমরা ভোটাদের কাছে সরকারের উন্নয়ন, বয়স্কভাতা, বিধাবভাতার কথা তুলে ধরছি। আমরা যা করেছি তা বলব না? এগুলো তুলে ধরে ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে যেতে অনুরোধ করছি। ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে নেয়া তো প্রার্থীদের দায়িত্ব। তারা সেই চেষ্টা করছেন।”

তার কথায়,” ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে নিতে কেন্দ্র কমিটিসহ নানা কমিটি করা হয়। বিএনপি নির্বাচনের আসলে তারাতো একই কাজ করত।”

এদিকে বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে কূটনীতিকরা জানতে চেয়েছেন ভোটারদের ভোট দেয়ার জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে কি না। জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল,” আমরা স্পষ্ট করে দিয়েছি, এ ধরনের কোনো চাপ নেই। বরং আমরা ভোটদান প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের জন্য জনগণকে উৎসাহিত করছি।”

এসএইচ-০২/০৬/২৪ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)