ভোটার আনার চ্যালেঞ্জ কি সফল হয়েছে?

বিএনপিসহ বেশকিছু দল নির্বাচন বর্জন করায় বড় কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হবে না আওয়ামী লীগকে, এমনটা নিশ্চিতই ছিল৷ তবে কে কতটা আসন পাবে, কারা হবে বিরোধী দল, এটিই এখন বড় প্রশ্ন।

বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটের আনুষ্ঠানিক পুরো ফল জানতে সোমবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে৷ কিন্তু বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং ভোটাধিকার বিষয়গুলো গুরুত্ব পাচ্ছে৷ নির্বাচনের পর বাংলাদেশের পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে?

নির্বাচন বর্জন করেছে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো৷ তারা ভোটের দিনসহ ৪৮ ঘণ্টার হরতাল কর্মসূচি পালন করছে৷ ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসতে নিরুৎসাহিতও করেছে৷ অন্যদিকে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, সরকার ও নির্বাচন কমিশনের নানা ধরনের তৎপরতা ছিলো ভোটার উপস্থিতি যাতে বেশি হয়৷ বিএনপি নির্বাচনে না থাকায় শাসক দল আওয়ামী লীগের প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিলো ভোটকেন্দ্রে ভোটার আনা৷ সেই চ্যালেঞ্জে তারা কতটা সফল হয়েছে সেটাই এখন বড় প্রশ্ন৷

ভোটের যে গতি-প্রকৃতি রোববার সারাদিন দেখা গেছে, তাতে অনেকে ভেবেছিলেন, ভোটের হার ৩০ শতাংশের বেশি হবে না৷ ঢাকার দুই-একটি আসন ছাড়া আর সবখানেই ভোটারের উপস্থিতি ছিলো খুবই কম৷ প্রথম এক ঘণ্টায় এক-দুই শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি৷ বিকেল ৩টা পর্যন্ত সারাদেশে ভোট পড়েছে ২৭ দশমিক ১৫ ভাগ বলে জানান কমিশন সচিব৷ এর এক ঘণ্টা পর বিকাল ৪টায় ভোট গ্রহণ শেষ হয়৷ কিন্তু ভোট শেষ হওয়ার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়াল সংবাদ সম্মেলনে জানান, সারাদেশে ভোটের হার ৪০ শতাংশ৷ তিনি অবশ্য বলেছেন, এটা প্রাথমিক হিসাব৷ পরে এ হার কিছুটা বেশি কম হতে পারে৷

সুশাসনের জন্য নাগরিকের ( সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ভোটের এ হার অসম্ভব বলে মন্তব্য করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের পর্যবেক্ষণে ভোটার উপস্থিতি খুবই কম ছিলো৷”

ভোটের হার কম হওয়া ছাড়াও নির্বাচনে জাল ভোট, ভোটকেন্দ্র দখলের ঘটনা ঘটেছে৷ কমিশন কয়েকটি ভোট কেন্দ্রের ভোট বাতিলও করেছে৷ নরসিংদীতে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুনের ছেলে মঞ্জুরুল মজিদ মাহমুদ সাদীকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছে কমিশন৷ চট্টগ্রাম-১৬ আসনে নৌকার প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমানের প্রার্থীতা বাতিলও করা হয়েছে৷ তবে প্রধান নির্বাচন কশিনার (সিইসি) হাবিবুল আউয়াল সন্তুষ্ট এই কারণে যে কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি৷ নির্বাচনে ১৪০টি কেন্দ্রে অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে৷ গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৪২ জনকে৷ নির্বাচন কমিশন এ তথ্য জানিয়েছে৷

নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট পড়েছিলো ৫৫ দশমিক চার শতাংশ৷ নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ওই নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়৷ এরপর ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি সরকারের অধীনে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ আরো কয়েকটি দল অংশ নেয়নি৷ ওই নির্বাচনে ভোট পড়েছিলো ২১ শতাংশ৷ বিএনপি জয়ী হলেও ওই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় বিএনপি সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়৷ ফলে চার মাস পর ওই বছরেরই ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট পড়ে ৭৫.৬ ভাগ৷ কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়৷ ২০০১ সালের ১ অক্টোবর কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচনে ভোট পড়ে ৭৪.৯৭ ভাগ৷ ওই নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়৷ ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে৷ ওই নির্বাচনে ৮৭.১৩ শতাংশ ভোট পড়ে এবং আওয়ামী লীগ জয়ী হয়৷ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে এবং বিএনপি ওই নির্বাচন বর্জন করে৷ ওই নির্বাচনে আওয়ামী লগি জয়ী হয় এবং ভোট পড়ে ৩৯.৫৮ শতাংশ৷ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে হলেও বিএনপি ওই নির্বাচনে অংশ নেয়৷ ভোট পড়ে ৮০.২ শতাংশ৷ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়৷ এই নির্বাচনে আগের রাতেই ভোট হয়ে যাওয়ার অভিযোগ আছে৷ আর সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও বর্জন করেছে বিএনপি৷ এই নির্বাচন হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে৷ কমিশন দাবি করেছে ভোট পড়েছে ৪০ ভাগ৷

এবারের নির্বাচনে ভোটারের কম উপস্থিতি নিয়ে সকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়াল সকালে ভোট দিতে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন,” ভোটারের উপস্থিতি কম কি বেশি সেগুলো আমি কিছুই জানি না৷ আমি এসে আমার ভোটটা দিয়ে গেছি, এতটুকুই জানি৷ শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করুন, দেখবেন৷’

চলমান সহিংসতার কারণে ভোটার উপস্থিতি কম এমন শঙ্কা করছেন কি না জানতে চাইলে হাবিবুল আউয়াল বলেন, “আমি ওগুলো নিয়ে কোনো চিন্তা-ভাবনা করিনি৷ আমার কাজটা ভোটটা আয়োজন করা৷ কে ভোট দিতে আসবেন, কে আসবেন না, সহিংসতা হবে কি হবে না; সহিংসতার ব্যাপারটা আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেখবে৷”

সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আইনে শতকরা কতভাগ ভোট পড়ল তার ওপর ভিত্তি করে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে প্রশ্ন তোলা যায়না৷ কারণ আইনে এরকম কিছু নাই৷ পাশের দেশ ভারতেও ভোট কম পড়ে৷ কিন্তু সমস্যা হলো পাবলিক পারসেপশন নিয়ে৷ আর আন্তর্জাতিকভাবে কমপক্ষে শতকরা ৫০ ভাগ ভোট পড়লে নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য ধরা হয়৷ এবারের নির্বাচন নিয়ে দেশে এবং বিদেশে ব্যাপক আলোচনা ছিলো৷ ফলে এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা সেইভাবেই দেখতে হবে৷”

তিনি বলেন, “বিএনপি এই নির্বাচন বর্জন করার কারণে ভোট কম পড়েছে৷ এমনিকেই মানুষের ভোট নিয়ে এখন আগ্রহ কম৷ তার ওপর এই বর্জন ভোটের ওপর প্রভাব ফেলেছে৷ কারণ বিএনপির কমপক্ষে ৩৬ শতাংশ ভোট আছে৷”

তিনি মনে করেন, “এই ভোটের মাধ্যমে সাংবিধানিক সংকট কেটেছে কিন্তু রাজনৈতিক সংকট কাটেনি৷ বিএনপি যদি তার আন্দোলনে মানুষকে আরো সম্পৃক্ত করতে পারে তাহলে সংকট আরো বাড়বে৷ আগেও রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হয়নি, এখনো হলো না৷ বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে হয়তো সংকট কাটত৷”

এদিকে সুশাসনের জন্য নাগরিকের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “আমরা যতটুকু দেখেছি এবং শুনেছি তাতে ভোটারের উপস্থিতি ছিলো খুবই কম৷ নির্বাচন কমিশন যে হারের (৪০ ভাগ)কথা বলছে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়৷ ওই হারের চেয়ে অনেক কম ভোট পড়েছে৷”

তার মতে, ‘‘এই নির্বাচনের মাধ্যমে ও রাজনৈতিক সংকট কাটবেনা আরো গভীর হবে৷ বিভাজন আরো বাড়বে৷ মানুষের ভোটাধিকার আবারো হরণ করা হলো।”

তিনি বলেন, “এই নির্বাচন তো আগেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি৷ এই কারণেই তো ইউরোপীয় ইউনিয়ন পর্যবেক্ষক দল পাঠায়নি৷ এখন যা হলো তাতে আমাদেও মাথা হেট হয়ে গেল৷ তারা এখন তাদের কোর্স অব অ্যাকশনে যেতে পারে৷ আমাদের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে পারে৷”

অন্যদিকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন,” জনগণ ধারণা করেছিলো, আমরাও বলেছিলাম এটা কোনো ভোট না৷ তাই হয়েছে৷ ভোট কেন্দ্র খালি ছিলো৷ জনগণ এই ভোট বর্জন করেছে৷ যে ভোট দেখানো হয়েছে তা কিছু লোক গিয়ে জাল ভোট দিয়েছে৷”

তিনি জানান, ‘‘সরকার পতন এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য আমাদের আন্দোল চলবে৷ হরতাল শেষ হওয়ার পর আরো কঠোর কর্মসূচি দেব আমরা৷”

আর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘‘এই নির্বাচনের মাধ্যমে সারা বিশ্বের মানুষ, বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে জনগণের বিজয়৷ জনগণ তাদের পছন্দমতো প্রার্থীদেরকে ভোট দিয়েছে৷ ভোট প্রদানে কোনো প্রকার ভয়-ভীতি বা হস্তক্ষেপ হয়নি৷ এই নির্বাচন গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা থেকে শক্তিশালী করবে৷”

বিএনপির ভোট বর্জনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণ তাদের (বিএনপি) বর্জন করেছে৷ তারা গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে৷ হরতাল-অবরোধ দিয়ে অগ্নিসন্ত্রাস করেছে৷ এই নির্বাচনের মধ্যমে জনগণ বিএনপি-জামায়াতকে প্রত্যাখ্যান করেছে৷”

এসএইচ-০৭/০৭/২৪ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)