১৫ বছরেও বিচার পাইনি ড. হুমায়ুন আজাদের পরিবার

দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ভাষাবিজ্ঞানী ড. হুমায়ুন আজাদ হত্যার ১৫ বছর। এই ১৫ বছরেও মামলার বিচার না পেয়ে হতাশায় তার পরিবার। পরিবারের একটাই প্রশ্ন- এই হত্যাকাণ্ডের বিচার কি তারা পাবেন?

এদিকে মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী দুই ডাক্তারের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হলেও তারা আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসেনি। তাদের সাক্ষ্য না নিয়ে আদালত সাক্ষ্যগ্রহণ সমাপ্ত করেন। তাদের সাক্ষ্য না নেয়ায় ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে হতাশায় তাদের পরিবার।

২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সামনে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন হুমায়ুন আজাদ। তাকে চাপাতি ও কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয়। ঘটনার পরদিন হুমায়ুন আজাদের ভাই মঞ্জুর কবির রমনা থানায় একটি হত্যা চেষ্টা মামলা দায়ের করেন।

ওই হামলার পর হুমায়ুন আজাদ ২২ দিন সিএমএইচে এবং ৪৮ দিন ব্যাংককে চিকিৎসারত ছিলেন। পরে জার্মানির মিউনিখে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একই বছরের ১২ আগস্ট তিনি মারা যান। তার মৃত্যুর পর মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তর হয়।

হুমায়ুন আজাদের ছোট ভাই ও মামলার বাদী মঞ্জুর কবির বলেন, আমার ভাই ড. হুমায়ুন আজাদ হত্যার ১৫ বছর পার হয়ে গেল। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই হত্যাকাণ্ডের বিচার পাইনি। বিচার না পাওয়ায় হতাশায় আমাদের পরিবার। মামলার দুই গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী দুই ডাক্তার আদালতে সাক্ষ্য না দেয়ায় ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়েও হতাশায় আছি।

তিনি আরো বলেন,আমার ভাই যখন সন্ত্রাসীদের আঘাতে গুরুতর হয়ে সিএমএইচ হাসপাতালে ভর্ত্তি ছিলেন তখন তাকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন।বর্তমানে মনে হয় তিনি বিষয়টি ভুলে গেছেন।প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার আকুল আবেদন মামলাটির যেন দ্রুত ন্যায়বিচার হয়।

ঢাকা মহানগর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু বলেন, ড. হুমায়ুন আজাদ হত্যার অভিযোগে দুইটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে। আর বিস্ফোরক আইনে করা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ অবস্থায় রয়েছে। হত্যা মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে সক্ষম হয়েছি।

তিনি আরও বলেন, মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী দুই ডাক্তার আদালতে সাক্ষ্য দিতে না আসায় আদালত সাক্ষ্যগ্রহণ সমাপ্ত ঘোষণা করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেও সাক্ষ্য দিতে আদালতে উপস্থিত করা যায়নি।

এদিকে আসামি পক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, ড. হুমায়ুন আজাদ হত্যার অভিযোগে করা দুই মামলায় ১৫ বছরেও বিচার কার্য শেষ হয়নি। মামলার অধিকাংশ সময় আদালতে সাক্ষীরা উপস্থিত হয় না। মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী দুই ডাক্তারের সাক্ষ্য না নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষ্যগ্রহণ সমাপ্ত করেছেন। তারা সাক্ষ্য দিলে মামলার জন্য ভালো হতো। এ বিষয়ে আমরা উচ্চ আদালতে যাবো।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, অনেক সময় আসামিদের কারাগার থেকে আদালতে উপস্থিত করা হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষের গাফিলতিতে এভাবে দীর্ঘসূত্রতা হয়েছে। আর হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেননি। তাই তার মক্কেল খালাস পাবেন বলে আশা করছেন তিনি।

যে দুই ডাক্তার সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসেনি

ডা. শহিদুল ইসলাম ও ডা. মেজর শওকত হাসান। ড. হুমায়ুন আজাদ আহত হওয়ার সময় ডা. শহিদুল ইসলাম সহকারী রেজিস্ট্রার (সিবিএ) হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জরুরি বিভাগে কর্মরত ছিলেন। অপরদিকে ডা. শওকত সার্জিক্যাল বিশেষজ্ঞ হিসেবে সেই সময় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। তারা দুজনই ড. হুমায়ুন আজাদের শরীরের জখমের পরীক্ষা করেন।

মামলায় ডা. শহিদুল ৩৩ নং সাক্ষী এবং ডা. শওকত ৩৪ নং সাক্ষী। তাদের সাক্ষ্য দেয়ার জন্য ২০১৫ সালের ১৯ মে সমন জারি করেন আদালত। পরবর্তীতে সাক্ষ্য প্রদানের জন্য এ পর্যন্ত মোট ১৭ বার তারিখ নির্ধারণ করা হলেও হাজির না হওয়ায় ২০১৬ সালের ৫ জুন তাদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হলেও তারা আদালতে সাক্ষ্য দিতে উপস্থিত হয়নি।

বর্তমানে যে অবস্থায় আছে মামলা দুটি

মামলার নথি থেকে জানা গেছে, ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। হত্যা মামলায় ৫৮ সাক্ষীর মধ্যে এ পর্যন্ত তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ ৪১ জন সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। আর বিস্ফোরক আইনে করা মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন ১০ জন।

হত্যা মামলায় ২০১৭ সালের ১৮ অক্টোবর সর্বশেষ পুলিশের এসআই আব্দুল হাই আদালতে সাক্ষ্য দেন। এরপর দীর্ঘ এক বছর আদালতে কোনো সাক্ষী উপস্থিত না হওয়ায় ২০১৮ সালের ২ অক্টোবর সাক্ষ্যগ্রহণ সমাপ্ত করা হয়। আদালত সাক্ষ্যগ্রহণ সমাপ্ত করে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য দিন ধার্য করেন। কিন্তু আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য নির্ধারিত থাকা তিনটি তারিখেও (২০১৮ সালের ২৮ অক্টোবর, ১৫ নভেম্বর ও চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি) তা সমাপ্ত হয়নি।

উল্লেখ্য, ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সামনে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন হুমায়ুন আজাদ। তাকে চাপাতি ও কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয়। ঘটনার পরদিন হুমায়ুন আজাদের ভাই মঞ্জুর কবির রমনা থানায় একটি হত্যা চেষ্টা মামলা দায়ের করেন।

ওই হামলার পর হুমায়ুন আজাদ ২২ দিন সিএমএইচে এবং ৪৮ দিন ব্যাংককে চিকিৎসাধীন ছিলেন। পরে জার্মানির মিউনিখে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একই বছরের ১২ আগস্ট তিনি মারা যান। তার মৃত্যুর পর মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তর হয়।

এ মামলায় জেএমবির শূরা সদস্য মিজানুর রহমান ওরফে মিনহাজ ওরফে শফিক ও আনোয়ার আলম ওরফে ভাগিনা শহিদ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

মামলার আসামিরা হলেন- জেএমবির শূরা সদস্য মিজানুর রহমান ওরফে মিনহাজ ওরফে শফিক, আনোয়ার আলম ওরফে ভাগিনা শহিদ, নূর মোহাম্মদ ওরফে সাবু (পলাতক) ও সালাহউদ্দিন (পলাতক)।

বিএ-১৩/২৭-০২ (ন্যাশনাল ডেস্ক)