দেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৫ লাখ ৮২ হাজার ৩৪৭টিতে দাঁড়িয়েছে। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৫ লাখ ৬৯ হাজার ৭৫০টি।
এরপর গত ৩ মাসে মামলা বেড়েছে ১২ হাজার ৫৯৭টি। যদিও মামলা নিষ্পত্তিতে সুপ্রিমকোর্টের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ হাতে নেয়া হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই মামলাজট কমানো যাচ্ছে না। প্রতিদিনই হচ্ছে নতুন নতুন মামলা। কিন্তু বিচারক সংখ্যা বাড়েনি সে হারে। দেশের অধস্তন আদালতে এখন বিচারক সংখ্যা ১ হাজার ৭০০ জন।
আদালত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। আইনি পদ্ধতিতে মামলা নিষ্পত্তিতে বছরের পর বছর লেগে যায়। রায় যখন পাওয়া যায়, তখন আর প্রাসঙ্গিকতা থাকে না। ফলে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়টি জোরদার করা দরকার। সর্বোচ্চ এক বা দু’দিন মুলতবি করে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে।
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সম্প্রতি জাতীয় সংসদে বলেছেন, বর্তমানে দেশের উচ্চ ও নিম্ন আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৫ লাখ ৬৯ হাজার ৭৫০টি। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধন করেছে। বর্তমান সরকার মামলাজট কমানোর বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত অধস্তন আদালতে ৫৭১ জন সহকারী জজ নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সারা দেশে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট/চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণ বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা পদায়ন করা হয়েছে। এছাড়া ১২তম জুডিশিয়াল সার্ভিস নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে সহকারী জজ নিয়োগের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
সদ্য প্রকাশিত সুপ্রিমকোর্টের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর দেশে বিচারাধীন মামলা ছিল ৩৫ লাখ ৬৯ হাজার ৭৫০টি। চলতি বছরের ৩১ মার্চে তা দাঁড়ায় ৩৫ লাখ ৮২ হাজার ৩৪৭টিতে। এর মধ্যে নিম্ন আদালতে ৩০ লাখ ৫৩ হাজার ৮৭০টি, হাইকোর্ট বিভাগে ৫ লাখ ৬ হাজার ৬৬৪টি এবং আপিল বিভাগে ২১ হাজার ৮১৩টি মামলা বিচারাধীন। এতে দেখা যায়, এ ৩ মাসে মামলার সংখ্যা বেড়েছে ১২ হাজার ৫৯৭টি। মামলা হয়েছে ৩ লাখ ৮২ হাজার ৬৪৯টি এবং নিষ্পত্তি হয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৫০৭টি।
২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বরে সব আদালত মিলে বিচারাধীন মামলা ছিল ৩১ লাখ ৫৬ হাজার ৮৭৮টি। পরের ২ বছরে বেড়েছে ৪ লাখ ১২ হাজার ৮৭২টি। বর্তমানে হাইকোর্টে বিচারপতি রয়েছেন ৯২ জন। ৩৫টি দ্বৈত ও ১৯টি একক বেঞ্চে চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত ৩ মাসে বিভিন্ন শ্রেণীর (ফৌজদারি, দেওয়ানি ও রিট) মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ৩৯ হাজার ৮১১টি। আর আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হয়েছে ১ হাজার ৪৪১টি।
দেশে মামলাজট দীর্ঘদিনের। মামলাজট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনও। সম্প্রতি জরুরি ফুলকোর্ট সভা করেন। সেখানে জট নিরসনে আরও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে বিচার কাজ পরিচালনার জন্য বিচারকদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। সভায় অন্য বিচারপতিরা দ্রুত বিচারক নিয়োগ দেয়ার পরামর্শ দেন। তারা বলেন, বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় আমাদের বিচারকের সংখ্যা কম। সে হিসাবে তুলনামূলক মামলা নিষ্পত্তির হার অনেক বেশি।
২৮ এপ্রিল এক মামলার শুনানিকালে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, সুপ্রিমকোর্টে বর্তমানে এত মামলা যে ফাইল রাখার মতো জায়গা নেই। অনেকটা ক্রিটিক্যাল অবস্থা, এভাবে চলতে পারে না। এর আগে সুপ্রিমকোর্টের অডিটোরিয়ামে জুডিশিয়াল রিফর্ম কমিটি ও জার্মান ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন বাংলাদেশ (জিআইজেড) আয়োজিত দেশের মামলার বিচারসংক্রান্ত এক নিরীক্ষা প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়।
প্রতিবেদনটি প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, ডিআইজেডের উপস্থাপন করা সুপ্রিমকোর্টের মামলার নিরীক্ষা প্রতিবেদন দেখে আমি প্রায় বিব্রত। এত মামলা! এভাবে চলতে পারে না। তিনি বলেন, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি- মামলাজট নিরসন বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের সব বিচারপতিকে নিয়ে বসব। সবাইকে বলব, এ অবস্থায় কী করবেন। বিষয়টি আপনারা দেখেন। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে সুপ্রিমকোর্টে প্রায় ৫ লাখ ২৫ হাজার মামলা বিচারাধীন। ১৯৮২ সালে ছিল মাত্র ২৫ হাজার। আর আগাম জামিনের আবেদনগুলো নিষ্পত্তি না করা হলে বর্তমানে সুপ্রিমকোর্টে মামলার পরিমাণ ১০ লাখ ছাড়িয়ে যেত। তিনি বলেন, প্রতিদিন মামলাজট বাড়ছে। বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখ লোককে মাত্র ১০ বিচারক বিচারিক সেবা দিচ্ছেন। এদিকে মামলাজট কমানোয় জোর দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।
এ প্রসঙ্গে সুপ্রিমকোর্টের এক প্রশাসনিক কর্মকর্তা বলেন, নতুন বছরের শুরুতেই প্রধান বিচারপতি হাইকোর্টের ১৪টি বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেন একেবারে পুরনো ফৌজদারি (বিবিধ) মামলার শুনানির জন্য। তার সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রতি বৃহস্পতিবার পুরনো মামলাগুলো হাইকোর্টের ১৪টি বেঞ্চের কার্যতালিকায় শুনানির জন্য রাখা হয়। জানুয়ারি থেকে ২৩ মে পর্যন্ত সাড়ে ৪ মাসে হাইকোর্টের এসব বেঞ্চ ১ লাখ ২ হাজার ১৭৩টি মামলার মধ্যে ৫৭ হাজার ৬০৯টি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন।
মামলাজট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, বর্তমান অবস্থায় জট কমাতে হলে মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়াতে হবে। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্টদের নিতে হবে মহাপরিকল্পনা।
তিনি বলেন, মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যা কমার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যেমন- অনেক মামলার ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিচার শেষ না হওয়ার আগেই বিচারককে অন্যত্র বদলি করা হয়। এক্ষেত্রে নতুন বিচারক এসে মামলাটি বুঝতে সময় লাগে। অনেক মামলা আছে নতুন করে শুনানি করা হয়। এছাড়া মামলায় সাক্ষী না আসার কারণে অনেক সময় মামলা এগোতে পারে না। সময়মতো সাক্ষী উপস্থাপন না করায় বিচার সম্পন্ন হতে সময় লাগছে। ফলে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চাইলে বিচারক ও তাদের সহায়ক লোকবল বাড়াতে হবে। এর আগে ব্যবস্থাপনায় একটা বড় ধরনের পরিবর্তন আনা দরকার।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শফিক আহমেদ আরও বলেন, আদালতের বাইরে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে মামলাজট কমিয়ে আনা সম্ভব। এ লক্ষ্যে আইনও সংশোধন করা হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে মামলা নিষ্পত্তিতে বছরের পর বছর লাগছে। শফিক আহমেদ বলেন, মামলার রায় যখন মেলে তখন প্রাসঙ্গিকতাই থাকে না। এ কারণে মামলাজট কমাতে হলে সর্বোচ্চ এক বা দু’দিন মুলতবি করে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে।
বিএ-০৩/১৭-০৬ (ন্যাশনাল ডেস্ক)