দেবর-ভাবির দ্বন্দ্ব আরও বাড়ল

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টিতে (জাপা) নেতৃত্ব নিয়ে ঝড়ের পূর্বাভাস ছিল। জিএম কাদেরকে দলের চেয়ারম্যান পদে এরশাদপত্নী রওশন এরশাদ মেনে নেবেন না- আগে থেকেই তা ধারণা করা হচ্ছিল। শনিবার দেবর-ভাবির একান্ত বৈঠকে ঝড় প্রশমিত হওয়ার আভাস ছিল। কিন্তু এ শান্ত অবস্থা দু’দিনও টিকল না।

সোমবার মধ্যরাতে বিরোধীদলীয় উপনেতার প্যাডে হাতে লেখা বিবৃতিতে রওশন এরশাদ বলেন, জিএম কাদের জাপার চেয়ারম্যান নন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মাত্র। তিনি যে প্রক্রিয়ায় চেয়ারম্যান হয়েছেন তা দলীয় গঠনতন্ত্র বিরোধী। অনেক দিন ধরে জাপা রওশন এবং জিএম কাদের বলয়ে বিভক্ত। এ বিবৃতির মধ্য দিয়ে তাদের দ্বন্দ্ব আরও বাড়ল বলে মনে করছেন দলটির নেতাকর্মীরা।

রওশনের এ বক্তব্যের জবাবে সদ্য প্রয়াত এরশাদের ছোট ভাই জিএম কাদের বলেছেন, বিবৃতিটি হাতে লেখা ও কাঁচা। এর বিশ্বাস ও গ্রহণযোগ্যতা নেই।

রওশন এরশাদ তাকে চেয়ারম্যান পদে না মানলেও জিএম কাদের দাবি করেন, জাপা কোনো বিভেদ নেই। সবাই এরশাদের আদর্শে ঐক্যবদ্ধ।

জাপার সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদের অবস্থানকে সমর্থন করেছেন বলে দলের ছয় প্রেসিডিয়াম সদস্য ও তিন নেতার নাম রয়েছে বিবৃতিতে। তবে রওশন এরশাদ ছাড়া বাকিদের স্বাক্ষর নেই। যোগাযোগ করা হলে রওশন এরশাদ নিশ্চিত করেন তিনি বিবৃতি দিয়েছেন। তবে এ বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সংবাদ মাধ্যমের মারফত জানতে পেরেছি জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। যা আদৌ কোনো যথাযথ ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি।’

জাপার গঠনতন্ত্রের ২০(২) এর খ ধারার বরাতে বলা হয়, ‘মনোনীত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রেসিডিয়ামের সংখ্যাগরিষ্ঠদের মতামতের ভিত্তিতে দায়িত্ব পালন করবেন। চেয়ারম্যানের অবর্তমানে ২০(২) এর ক ধারা উপেক্ষা করা যাবে না।’ পরবর্তী চেয়ারম্যান নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত জিএম কাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাবেন বলে আশা করা হয় বিবৃতিতে।

সমর্থনকারী হিসেবে বিবৃতিতে নাম থাকা প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, ফখরুল ইসলাম এমপি, সেলিম ওসমান এমপিসহ কয়েকজন জেষ্ঠ্য নেতার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে নাম থাকা দু’জন এমপি জানিয়েছেন, তারা বিবৃতির বিষয়ে কিছুই জানতেন না। তবে তারা এ বিষয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে চান না।

মীর আবদুস সবুর সমকালকে বলেছেন, দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কাউন্সিল ছাড়া চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ নেই। প্রয়াত চেয়ারম্যান এরশাদ গঠনতন্ত্রে প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে জিএম কাদেরকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মনোনীত করেন। কিন্তু চেয়ারম্যান পদে কাউকে মনোনীত করার সুযোগ নেই।

দেলোয়ার হোসেন বলেছেন, দলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এরশাদ নিজে জিএম কাদেরকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মনোনীত করে গেছেন। তাকে মেনে নিতে আপত্তি নেই। কিন্তু কারো সঙ্গে আলোচনা ছাড়া তাকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করা ঠিক হয়নি। সবার সঙ্গে আলোচনা করে এ সিদ্ধান্ত নিলে সবার সম্মানই থাকত।

গত ১৪ জুলাই মারা গেছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ। গত ৪ মে তিনি জিএম কাদেরকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করে তার হাতে দলের দায়িত্ব তুলে দেন। তার অবর্তমানে জিএম কাদের দলের চেয়ারম্যান হবেন বলেও সাংগঠনিক নির্দেশ জারি করে যান মৃত্যুর আগে। গত ১৮ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে জাপা মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ দলের চেয়ারম্যান হিসেবে জিএম কাদেরের নাম ঘোষণা করেন। সেই বিষয়টি সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত প্রেসিডিয়াম সদস্যরাও জানতেন না।

জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া সমকালকে বলেছেন, দলের ৫১ জন প্রেসিডিয়াম সদস্যের মাত্র সাতজন জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যান করার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বাকিরা সমর্থন করেছেন। তার দাবি, জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যান ঘোষণা গঠনতন্ত্র বহির্ভূত নয়।

রওশন এরশাদের বিবৃতির বিষয়ে মঙ্গলবার বনানী কার্যালয়ে জিএম কাদের বলেছেন, এরশাদ তার পিতৃতুল্য। রওশন এরশাদ তার কাছে মায়ের মতো। রওশন তার অভিবাবক। রওশন এরশাদ তাকে চেয়ারম্যান বা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যে নামে সম্বোবধন করুন, অসুবিধা নেই। দলে কাজ করাই আসল বিষয়।

জাপার নেতারা জানিয়েছেন, রওশন এরশাদ এবং জিএম কাদেরের দূরত্ব বহুদিনের। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনকারী জিএম কাদেরকে ২০১৬ সালে দলের কো-চেয়ারম্যান করেন এরশাদ। রওশন এরশাদ এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। নানা নাটকীয়তার পর তাকে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান করা হয়। একাদশ নির্বাচনের পর প্রথমে জিএম কাদেরকে বিরোধীদলীয় উপনেতা করা হয়। পরে তাকে সরিয়ে রওশন এরশাদকে এ পদ দেন এরশাদ। জিএম কাদের তখন কো-চেয়ারমম্যান পদ হারালেও পরে রংপুরের নেতাদের চাপে ফিরে পান।

বিএ-২১/২৩-০৭ (ন্যাশনাল ডেস্ক)