ঢাকাতে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়ে সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। গেল কয়েক বছরের মধ্যে ২০১৮ সালে দশ হাজারের বেশি নারী-পুরুষ ও শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ায় তখন রেকর্ড হয়েছিল। ২০১৯ সালে সাত মাসেরও কম সময়েই ডেঙ্গু আক্রান্তে গেল বছরের রেকর্ড ভঙ্গ হতে চলছে।
এদিকে, ঢাকার হাসপাতালগুলো ডেঙ্গু রোগীর ভিড় বাড়ছে।হাসপাতালের বেডের চেয়ে রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরাও। গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকার সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ৩৭৪ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এছাড়া ঢাকার বাইরে ভর্তি হয়েছেন ১৬ জন রোগী। সবমিলিয়ে ভর্তি হয়েছেন ৩৯০ জন নতুন ডেঙ্গু রোগী।
শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের দৈনিক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বৃহস্পতিবার সকাল ৮ থেকে শুক্রবার সকাল ৮ পর্যন্ত এই ২৪ ঘণ্টার হিসাব তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, মোট ৩৯০ জন রোগীর মধ্যে ঢাকা শহরের বাইরে ঢাকা বিভাগের জেলাশহরে ১ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৩ জন ও খুলনা বিভাগে ২ জন রোগী ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন।
ঢাকা শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৩৭৪ জন। এদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) ১৩৬ জন, ঢাকা শিশু হাসপাতাল ৮ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ২২ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এছাড়াও হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ৯ জন, বারডেম হাসপাতালে ৪ জন, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ৩৭ জন, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৪১ জন, পিলখানা বিজিবি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩ জন রোগী।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, ঢাকা শহরের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে নতুনভাবে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ১১৪ জন রোগী। এদের মধ্যে ধানমন্ডি ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১১ জন, স্কয়ার হাসপাতালে ৯ জন, সেন্ট্রাল হাসপাতালে ৩০ জন, কাকরাইল ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে ২৪ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন। এছাড়াও ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৮ জন, সালাউদ্দিন হাসপাতালে ১৭ জন, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৫ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন।
রিপোর্টটিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সর্বমোট মৃত্যুর সংখ্যা দেখানো হয় ৮ জন।
রিপোর্টে দেখা যায়, চারটি সরকারি হাসপাতাল এবং ২৯টি বেসরকারি হাসপাতালে নতুন কোনো রোগী ভর্তি হননি।
এদিকে, ঢাকা থেকে শুরু করে জেলা শহরগুলোতেও ডেঙ্গু আতঙ্ক মহামারি আকার ধারণ করেছে। কেউ শরীরে সামান্য একটু জ্বর বোধ করলেই চেক আপের জন্য ছুটে যাচ্ছেন হাসপাতালে। হতে পারে এটি সাধারণ জ্বর বা অন্য কিছু। কিন্তু বর্তমানে কেউ এটাকে সাধারণভাবে নিচ্ছেন না। কারণ এবার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার কিছু সময়ের মধ্যেই সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন কেউ কেউ। তাই একটু জ্বর ওঠা মাত্রই হাসপাতালের দিকে ছুটছেন রোগীরা।
২৫ জুলাই স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসাপাতালে সরেজমিনে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। এখানকার চিকিৎসকদের অভিযোগ, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। কিন্তু সে পরিমাণে ডাক্তার বা নার্স নেই। এজন্য তাদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। অন্যদিকে ডেঙ্গুসহ অন্যান্য রোগী বেশি হওয়ায় তাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের মেঝে, বারান্দা, চিকিৎসকের চেম্বার এবং লিফটের সামনে থেকে শুরু করে বাথরুমের দরজা পর্যন্ত সর্বত্র রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
শত কষ্ট মুখ বুঝে সহ্য করে চিকিৎসা নিচ্ছেন ডেঙ্গু রোগীরা। এ বিষয়ে কথা হয় মিটফোর্ড হাসাপাতালের চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু রোগী আলতাফ মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, দুইদিন আগে মিটফোর্ড হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের ১-৩-৫-৭ ইউনিটে ভর্তি হয়েছি। ভর্তি হওয়ার সময় কোনো বেড পাইনি। এজন্য ফ্লোরে বেড পেতে চিকিৎসা নিচ্ছি। যেভাবে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বাড়ছে তাতে কারও কিছুই করার নেই। সব হাসপাতালে একই অবস্থা। হাসপাতালে বেডের চেয়ে রোগী বেশি।
একই বিভাগের সিনিয়র নার্স সাথী হালদার বলেন, এই ইউনিটে ডেঙ্গু আক্রান্তসহ ১৭২ জন রোগী রয়েছে। গত ২৪ ঘন্টায় এখানে ৪৪ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। প্রতিদিন গড়ে ১৫-২০ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছেন। আগের রোগীসহ নতুন রোগী যোগ হওয়ায় আমরা চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, গত ২৪ ঘন্টায় ৬/৭ জন নার্স চিকিৎসা দিয়ে আসছে। সকাল থেকে চিকিৎসক বেশি থাকলেও নাইট শিফটের জন্য মাত্র দু’জন নার্সকে দিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে।
মিটফোর্ড হাসাপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সেখানে এখন ১৯৯ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাছাড়াও প্রতিদিন ৬৫/৭০ জন নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছেন। আর প্রতিদিন চিকিৎসা শেষে ৩০/৪০ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল ছাড়ছেন।
মিটফোর্ড হাসাপাতালের ৩ নম্বর ভবনের সিনিয়র এক নার্স নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, রোগীর তুলনায় ডাক্তার-নার্স অনেক কম। চিকিৎসক/নার্সের সংখ্যা বাড়ানো বিষয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বারবার জানানো হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। অন্যান্য রোগীর চেয়ে ডেঙ্গু রোগীকে বেশি সময় দিতে হয়। একটুও বিশ্রাম নেওয়ার সময় পাচ্ছি না। সত্যিই ডেঙ্গু যেন আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিএ-১৬/২৬-০৭ (ন্যাশনাল ডেস্ক)