বাংলা নববর্ষ উদযাপন ২ বছর পর

সকালে সূর্যের প্রথম রশ্মির সঙ্গে শুরু হয়েছে বাংলা নতুন বছর। করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘ ২ বছর পর বাঙালি জাতি পূর্ণোদ্যমে বৈশাখ উদযাপন করছে।

পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন এবং বাংলাদেশিদের জন্য সবচেয়ে বড় ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব।

করোনা মহামারির আগের মতোই খুব ভোরে এই আনন্দ উদযাপনে ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে বের হয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ। পুরুষরা পাজামা-পাঞ্জাবি, নারীরা শাড়ি আর উজ্জ্বল পোশাকে শিশুরা আবারও রমনা বটমূলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিবেন। ছায়ানটের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহু পুরনো চেনা গান ‘এসো হে বৈশাখ’ গেয়ে বাঙালি বরণ করে নেবে বাংলা নতুন বছর।

ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলায় দীর্ঘদিন পর মানুষ ভিড় জমাবেন, কিনবেন ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প, খেলনাসহ নানান জিনিসপত্র। ঢাকাসহ পুরো দেশে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের এ এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

বৃহস্পতিবার সকালে চারুকলা অনুষদ থেকে সকলের মঙ্গল কামনায় মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হবে। একটি নতুন ব্যবসায়িক বছর শুরু করতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো হালখাতা খুলবে।

গত ২ বছরের ঘরবন্দি জীবন এবারের উদযাপনকে আরও বিশেষ করে তুলেছে।

ছায়ানটের সভাপতি সনজীদা খাতুন বলেন, ‘মহামারির তীব্রতা সবকিছু সঙ্কুচিত করে দিয়েছে। গত ২ বছর আমাদের জন্য খুব কঠিন ছিল।’

গত ৬ দশক ধরে ছায়ানট বাংলা নববর্ষকে স্বাগত জানানোর অনুষ্ঠান আয়োজনে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। ১৯৭১ সালে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। পহেলা বৈশাখের গত ২টি উদযাপন করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে সরকারের স্বাস্থ্যবিধি মেনে ছোট পরিসরে অনলাইনে আয়োজন করা হয়েছিল।

মুঘল সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৯) রাজত্বকালে বাংলা মাস বৈশাখের প্রথম দিনটিকে নববর্ষের প্রথম দিন হিসেবে পালন করা হয়। বাংলা নববর্ষের উৎপত্তি সম্পর্কে একাধিক মতের একটি অনুসারে, এই সময়ে কৃষক সম্রাটকে কর প্রদান করতেন।

পরবর্তীতে পহেলা বৈশাখের সঙ্গে জড়িয়ে পরে রাজনৈতিক তাৎপর্যও। ১৯৬৭ সালে ছায়ানটই তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক বাঙালি সংস্কৃতিকে নির্মমভাবে দমন করার প্রতিবাদে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর উৎসবটি দেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতীক এবং জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও পরিচয়ের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখের অনন্য এক উপাদান। ইউনেস্কো স্বীকৃত এই অনুষ্ঠানটিও গত ২ বছর পর এবার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই শোভাযাত্রার সব প্রস্তুতি ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।

চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, ‘মহামারির কারণে আমাদের জীবনের ছন্দ হারিয়ে গিয়েছিল। এবারের শোভাযাত্রার থিম হচ্ছে “নির্মল”। আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার আহ্বান জানিয়ে এই থিম নির্ধারণ করা হয়েছে।’

তিনি জানান, এবারের শোভাযাত্রা টিএসসি থেকে শুরু হয়ে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে গিয়ে শেষ হবে।

করোনা শনাক্তের হার এক শতাংশেরও নিচে নেমে গেলেও আয়োজকরা সতর্কতা হিসেবে শোভাযাত্রার সময় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ঘোষণা দিয়েছেন।

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ জানান, অন্ধ বিশ্বাস থেকে উদ্ভূত ধর্মীয় গোঁড়ামির আকস্মিক উত্থান এবারের পহেলা বৈশাখকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে।

তিনি বলেন, ‘এবারের উদযাপন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এবার আমরা বাঙালি জাতীয়তা নিয়ে প্রশ্নের মুখে রয়েছি। আমরাও বাধার সম্মুখীন হয়েছি। এটা উদ্বেগজনক যে সম্প্রতি তথাকথিত ধর্মচর্চাকারীরা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। এই অশুভ শক্তিকে পরাস্ত করতে এ বছরের উদযাপন আরও প্রাণবন্ত হওয়া উচিত।’

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস বলেন, ‘পহেলা বৈশাখ ও রমজান একই সময়ে হওয়ায় আমরা এবার দ্বৈত উৎসব পালন করতে যাচ্ছি। বাঙালি এবার ধর্ম ও সংস্কৃতি একসঙ্গে পালন করবে। এটা মোটেও পরস্পরবিরোধী নয়।’

তবে একটি দল রাজনীতির স্বার্থে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে বলেও যোগ করেন তিনি।

সরকারি ছুটির দিন হওয়ায় অসংখ্য সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নববর্ষ উদযাপনের জন্য বিস্তৃত অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এ বছর পহেলা বৈশাখ রমজান মাসে হওয়ায় আয়োজনে জনসমাগম কিছুটা কম।

মহামারির পর অধীর আগ্রহে পহেলা বৈশাখের জন্য অপেক্ষা করছেন জানিয়ে দ্য ফ্ল্যাগ গার্লের প্রতিষ্ঠাতা প্রিয়তা ইফতেখার বলেন, ‘২ বছর পর পহেলা বৈশাখ উদযাপন করতে পেরে আমি খুবই উত্তেজিত ও আনন্দিত। এটা আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের অংশ। অধিকাংশ মানুষ করোনার টিকা নেওয়ায় এখন এই উদযাপনও বেশ নিরাপদ।’

এসএইচ-০৪/১৪/২২ (ন্যাশনাল ডেস্ক)