লাগামহীন মূল্যস্ফীতি, মধ্যবিত্তের সঞ্চয়ে টান

দেশের বাজারে চলছে লাগামহীন মূল্যস্ফীতি। গত জুনের মূল্যস্ফীতি ছাড়িয়ে গেছে বিগত ৯ বছরের রেকর্ড। এ অবস্থায় নিম্নবিত্ত মানুষ নিজেদের খাদ্য চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে, মধ্যবিত্তদের ভাঙতে হচ্ছে ব্যক্তিগত সঞ্চয়। তবে আশার কথা হচ্ছে জুলাইতে এসে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দেশে মূল্যস্ফীতির হার ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (সানেম, সিপিডি) বলছে, এ হার ১০ শতাংশের কাছাকাছি। মূল্যস্ফীতির সরাসরি প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের জীবনে, সৃষ্টি হয়েছে সংকট।

তবে বুধবার পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান আশার বাণী শুনিয়েছেন। তিনি বলছেন, চলতি মাসে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে, ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হবে বাজার দর।

অর্থনীতিবিদরা মূল্যস্ফীতির প্রভাব সম্পর্কে বলেন, মূল্যস্ফীতির প্রভাব মূলত সমাজের শ্রেণিবৈষম্যকে প্রকট রূপে আমাদের সামনে তুলে ধরে। এর প্রভাবে বাজার করতে না পেরে আধপেটা কিংবা উপোস থাকে নিম্নবিত্ত, খরচ সামলাতে মধ্যবিত্তকে সঞ্চয় ভেঙে খেতে হয়। উচ্চবিত্ত মহলে মূল্যস্ফীতির প্রভাব যতটা না আর্থিক তার থেকেও বেশি মনস্তাত্ত্বিক। মূল্যস্ফীতি উচ্চবিত্ত মহলে বিরক্তির সৃষ্টি করে।

বর্তমান বাজার দর নিয়ে কথা হয় ঢাকার রিকশাচালক সামাসুল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমাদের ৫ জনের পরিবার। আমি রিকশাচালাই, বড় ছেলে রাজমিস্ত্রির জোগাল (হেলপার) হিসেবে কাজ করে। কিন্তু বাজারের যে দশা তাতে ঘরভাড়া দিয়ে টিকে থাকা দায়। সংসার সামলাতে এখন আমার বউ ছুটা বুয়ার কাজ করছে। এরপরও যে হারে দাম বাড়ছে তাতে করে হিমশিম খাচ্ছি আমরা।

আগে সপ্তাহে দুদিন মুরগি মাংস খাওয়া পড়তো, হরেক রকমের মাছ খাওয়া পড়তো। এখন মাছ খাওয়া একরকমের বন্ধ। আগে যে তেলাপিয়ার কেজি ছিল ১৫০ টাকা এখন তা বেড়ে হয়েছে ২০০ টাকা। ১২০ টাকার পাঙাশ মাছ কিনতে হচ্ছে ১৭০ টাকায়। ডাল খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি, এদিকে চালের দামও বাড়তি। মাঝে সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপদে পড়েছিলাম। সকালে চা খেতাম, সে অভ্যাস আপাতত বন্ধ রেখেছি। আগে দুধ চায়ের কাপ ছিল ৬ টাকা। এখন ৮-১০ টাকার নিচে চা বিক্রি হয় না।’

বেসরকারি একটি ফার্মে মার্কেটিং বিভাগে চাকরি করেন সাফিউর রহমান। তিনি বলেন, ‘সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে বাসা ভাড়া। বেতনের অর্ধেক যায় বাসা ভাড়া আর নানা রকমের বিল দিতে। বাকি যে টাকা থাকে তা দিয়ে কোনো রকমে সংসার চালাতে হয়। আপনি যদি কেবল ডাল-ভাত খেয়েও বেঁচে থাকতে চান, তাতে করেও আপনাকে গুনতে হবে অনেক টাকা।

আগে ২০০ টাকা নিয়ে বাজারে গেলে হরেক রকম শাকসবজি কিনে বাসায় ফেরা যেত। এখন ২০০ কেন ৫০০-১ হাজার টাকাও নিমেষে শেষ হয়ে যায়। মরিচের কেজি ২৪০ টাকা, বরবটি-সিম ৮০ টাকা করে। গরুর মাংস খাওয়া বাদ দিয়েছি অনেক আগে। মাঝে ফার্মের মুরগির কেজি হয়েছিল ২০০ টাকা। ইলিশ মাছ কদিন ধরে দেখেই যাচ্ছি, কেনার সামর্থ্য নেই। মাঝে বাবা অসুস্থ হওয়ায় ব্যাংকের ডিপোজিট ভেঙে তার চিকিৎসা করতে হয়েছে।’

এদিকে পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় দেশজ সঞ্চয় কমে আসছে। অর্থাৎ জিডিপি যে হারে বাড়ছে, সঞ্চয় সেভাবে বাড়ছে না। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশজ সঞ্চয় ছিল ২৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে তা কমে হয়েছে ২১ দশমিক ৫৬ শতাংশ। (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২২)।

বাংলাদেশের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের অনেকেই সঞ্চয়পত্রে টাকা বিনিয়োগ করে থাকেন। কিন্তু মূল্যস্ফীতির প্রভাবে এদের অবস্থা হয়েছে নুন আনতে পান্তা ফুরায় এমন। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের হিসাব থেকে দেখা যায়, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি হয় ২ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকার।

জুন মাসে মূল জমা হয় ১০ হাজার ৭১২ কোটি টাকার, আর মুনাফা পরিশোধ হয় ৩ হাজার ৯৮০ কোটি টাকার। অর্থাৎ জুনে যারা সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই আর নতুন করে বিনিয়োগ করেননি। সে হিসাবে জুনে নিট বিক্রি দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। ছয় মাস আগের সময়কে ভিত্তি ধরলে জুনে কম বিক্রি ৮৩৬ কোটি টাকা।

এ ব্যাপারে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, সারা বিশ্বের মানুষই যেমন কষ্টে আছে, আমরাও আছি। আমাদের কষ্টটা সাময়িক। আশার কথা যে জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেলসহ সব খাদ্যপণ্যের দামই কমতির দিকে। শেয়ারবাজার ও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীদের জন্য যা যা করা দরকার সবকিছু করা হবে বলে আশ্বাস দেন অর্থমন্ত্রী।

এসএইচ-১১/০৩/২২ (ন্যাশনাল ডেস্ক, সূত্র : সময়)