বিদ্যুৎহীন ৬ ঘণ্টা, জনদুর্ভোগ

জাতীয় গ্রিডের একটি সঞ্চালন লাইনে বিভ্রাট দেখা দেয়ায় রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহসহ দেশের বেশিরভাগ এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে।

মঙ্গলবার দুপুর ২টা ৪ মিনিটে এ বিপর্যয় দেখা দেয় বলে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) পক্ষ থেকে জানানো হয়।

বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে চরম জনদুর্ভোগ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ব্যাহত হচ্ছে জরুরি সেবা। আপাতত বিকল্প ব্যবস্থায় পরিস্থিতি সামাল দিলেও এমন অবস্থা চলতে থাকলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালসহ জরুরি সেবাখাতে মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

প্রায় ৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন থাকার পর রাত পৌনে ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত রাজধানীর সচিবালয়হ কয়েকটি এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। তবে বেশির ভাগ এলাকায় এখনও বিদ্যুৎহীন আছে।

বিদ্যুৎ না থাকায় হাসপাতালের কার্যক্রম ব্যাহত

বিদ্যুৎ না থাকায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে জরুরি সেবা খাত হাসপাতালে। ইতোমধ্যে দিনের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, বিদ্যুৎ না থাকায় তাদের সার্ভার ডাউন হয়ে গেছে। বিলের পেমেন্টসহ দাফতরিক কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটে। অনেক চিকিৎসক চেম্বারে এসে বিদ্যুৎ না থাকায় রোগী না গেলে চলে গেছেন।

কাকরাইল ইসলামি ব্যাংক হাসপাতালে দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, আমরা জরুরি ভিত্তিতে এনআইসিও, এইচডিউ, আইসিইউর কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছি। বিদ্যুৎ স্বাভাবিক না হলে বড় ধরনের ঝামেলা তৈরি হতে পারে।

ওই হাসপাতালের জেনারেটর অপারেটর জানান, একটা জেনারেটর সর্বোচ্চ ছয় ঘণ্টা একটানা চালু রাখা যায়। এর থেকে বেশি চললে জেনারেটরে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়।

বহুতল ভবনে দুর্ভোগ

বিদ্যুৎ না থাকায় সবচেয়ে দুর্ভোগে রাজধানীর বহুতল ভবনের বাসিন্দারা। কেননা পানি ও লিফট চালু না থাকায় শিশু ও বয়স্কদের অবস্থা বেশি খারাপ। রাজধানীর পশ্চিম নাখাল পাড়ার বাসিন্দা সালমা বেগম। দীর্ঘদিন ধরে কিডনি রোগে আক্রান্ত। সাপ্তাহে দুদিন ডায়ালাইসিস চলে তার। গরম সহ্য করতে পারেন না। দীর্ঘ সময়ে বিদ্যুৎ না থাকায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি।

তার ছেলে মাঈন উদ্দিন হাসান বলেন, বিদ্যুৎ না থাকায় সবারই অবস্থা খারাপ। তবে যারা ডায়ালাইসিসের রোগী তাদের অবস্থা আরও গুরুতর। কিছুসময় জেনারেটর চালু থাকায় ফ্যান চালানো গেছে। এখন জেনারেটর বন্ধ থাকায় অতিরিক্ত গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তার মা।

তিনি আরও বলেন, আমরা এখন ভেজা তোয়ালে দিয়ে কিছুক্ষণ পর পর মায়ের শরীর মুছে দিচ্ছি।

পানি সংকট

টানা ছয় ঘণ্টা পানি না থাকায় রাজধানীর অফিস, বাসাবাড়ি ও মসজিদে পানি সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক মুসল্লি ওজুর ব্যবস্থা না থাকায় নামাজ পড়তেও পারেননি। মোহাম্মদপুরে এক মুসল্লি জানান, বিদ্যুৎ না থাকায় বাসায় পানির পাম্প চালু করা যায়নি। মসজিদে পানি না থাকায় তার মতো অনেক মুসল্লি নামাজ না পড়ে বাসায় ফিরে গেছেন।

মোমবাতি সংকট

দুপুর দুইটা থেকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশে বিস্তীর্ণ এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। এতে মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। এদিকে সন্ধ্যা থেকে কলাবাগান ও জিগাতলাসহ বিভিন্ন এলাকায় মোমবাতি সংকট দেখা দিয়েছে।

কলাবাগানের বিসমিল্লাহ স্টোরের মালিক মো. মতিন মিয়া জানান, দোকানে মোমবাতি খুব একটা চলে না। আমার দোকানে ৩০-৩৫ ডজন মোমবাতি ছিল। বিকেল তিনটা থেকেই মোমবাতির জন্য ক্রেতার লাইন দিতে থাকেন। এক ঘণ্টায় সব মোমবাতি বিক্রি হয়ে গেছে।

পেট্টোল পাম্পে দীর্ঘ লাইন

বিদ্যুৎ না থাকায় রাজধানীর বিভিন্ন পেট্টোল পাম্পে জেনারেটেররে ডিজেল নেয়ার জন্য দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। মিজানুর নামে পুরান ঢাকার এক বাসিন্দা বলেন, আমাদের অ্যাপার্টমেন্টটি ১০ তলা। বিদ্যুৎ না থাকায় জেনারেটরের জন্য ডিজেল নিতে এসেছি। এসে দেখি দীর্ঘ লাইন। বাসায় পানি নেই, সেজন্য জেনারেট চালু করতে তেল নিতে এসেছি।

মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত

জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের কারণে দেশের ১ হাজার বিটিএস (মোবাইল টাওয়ার) এর সেবা বিঘ্নিত হয়েছে। আরও কয়েক হাজার বিটিএস ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কারণ বিকল্প উপায়ে বিটিএসগুলো দুই-তিন ঘণ্টা চালু রাখা যায়। এর মধ্যে বিদ্যুৎ না এলে মোবাইলে ও ইন্টারনেট সেবায় বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দেবে।

এ বিষয়ে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্র বলেন, বিটিএসগুলোর ব্যাকআপ নির্দিষ্ট সময় থাকে। বিদ্যুৎ আসতে দেরি হলে নেটওয়ার্ক সেবায় বিঘ্ন ঘটবে।

ইন্টারনেট সেবাদাতাদের সংগঠন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশনের (আইএসপিএবি) সভাপতি ইমদাদুল হক জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ না থাকায় নেটের ব্যবহার কমে গেছে।

সিএনজি পাম্প বন্ধ

বিদ্যুৎ না থাকায় ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার সিএনজি পাম্প বন্ধ হয়ে গেছে। এতে গ্যাস নিতে আসা গাড়িচালকেরা ভোগান্তিতে পড়েছেন। মো. জুয়লে নামে এক উবার চালাক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে প্রতিদিন সিএনজি স্টেশন ৪ ঘণ্টা বন্ধ রাখা হয়। আজকে এসে দেখি বিদ্যুৎ নেই সেজন্য গ্যাস দিতে পারছি না।

ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ক্রেতাশূন্য
পল্টনের কার্পেট ব্যবসায়ী আবদুল রহিম জানান, দুপুরের পর হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। ভেবেছি লোডশেডিং, পরে শুনলাম জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ বিপর্যয়। কোনো ক্রেতাও আসসেন না। অলস বসে আছি।

পল্টনের আরেক গাড়ি ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদ বলেন, বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর থেকেই শো-রুম অন্ধকার হয়ে যায়। জেনারেটর ও আইপিএস দিয়ে কতক্ষণ চালানো যায়। সেজন্য বন্ধ রাখছি। আর কিছুক্ষণ পর বাসায় চলে যাব।

এটিএম সেবা ব্যাহত
বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেছে ব্যাংকিং সেক্টরের এটিএম সেবা। মিরপুরে বাসিন্দা রাফিজা খান বলেন, এটিএম বুথে টাকা তুলতে গিয়ে দেখি বুথ বন্ধ। দায়িত্বরত সিকিউরিটি গার্ড জানান, বিদ্যুৎ না থাকার বুথ বন্ধ রাখা হয়েছে।

বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর দুঃখ প্রকাশ
জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে সবাইকে ধৈর্য্য ধারণের অনুরোধ করেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে প্রতিমন্ত্রী এ অনুরোধ জানিয়েছেন।

ফেসবুক পোস্টে প্রতিমন্ত্রী বলেন, জাতীয় গ্রিড ট্রিপ করার কারণে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ পূর্বাঞ্চলের বড় একটি এলাকায় দুপুর ২টা ৪ মিনিট থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে। আকস্মিক এ সমস্যা সমাধানে বিদ্যুৎ বিভাগের প্রকৌশলীরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল হয়েছে। আশা করি, দ্রুততম সময়ের মধ্যে সকল এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হবে।

তদন্ত কমিটি গঠন
জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের ঘটনা খতিয়ে দেখতে বিদ্যুৎ বিভাগকে দুটি তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। বিকেলে প্রতিমন্ত্রী জানান, বিদ্যুৎ বিভাগের একটি এবং তৃতীয়পক্ষের একটি কমিটি বিভ্রাটের কারণ খুঁজে বের করতে কাজ করবে।

এর আগে মঙ্গলবার বেলা ২টা ৪ মিনিটে গ্রিডে বিপর্যয় ঘটলে পূর্বাঞ্চলীয় গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর অধিকাংশ বন্ধ হয়ে যায়। এতে দেশের অর্ধেক এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। গ্রিডে বিপর্যয়ের কারণ জানা যায়নি।

এসএইচ-০৪/০৪/২২ (ন্যাশনাল ডেস্ক, সূত্র : সময়)