স্বস্তি ফিরলেও এখনো আতঙ্কে রাজশাহীর কলমার বাসিন্দারা

সদ্য সমাপ্ত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে ‘একঘরে’ করা হয়েছে রাজশাহীর তানোর উপজেলার কলমা গ্রামকে। গ্রামবাসীর ‘অপরাধ’ তারা এমপির নিজ ইউনিয়নের বাসিন্দা হওয়া স্বত্বেও অধিকাংশই বিএনপি সমর্থক।

এ ঘটনার সপ্তাহ পার হলেও কাটেনি অবরুদ্ধ অবস্থা। এ নিয়ে গত কয়েকদিন ধরেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন ছাপা হয়। এ খবরে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হলে টনক নড়ে প্রশাসনের।

গত শনিবার সকালে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মতিউর রহমান সিদ্দিকী ওই এলাকায় গিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাকর্মীদের নিয়ে প্রাথমিক বৈঠক করে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেন।

পরদিন রোববার ওই এলাকা পরিদর্শন করেন জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপার (এসপি)। পরে ইউনিয়ন কমিউনিটি পুলিশিং ফোরামের আয়োজনে তারা এলাকাবাসীদের সঙ্গে আলোচনা সভায় বসেন। ওই সভায় তানোর উপজেলা প্রশাসনের ইউএনও-ওসি সহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সর্বস্তরের মানুষ উপস্থিত ছিলেন।

সভায় জেলা প্রশাসক এস এম আবদুল কাদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁকে বলেছেন, ‘তুমি তানোর-গোদাগাড়ীর মানুষকে গিয়ে বলো, তারা যেন কেউ আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়। কেউ আইন হাতে তুলে নিলে তার বিরুদ্ধেই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

তিনি বলেন, তিনি পত্রিকায় সংবাদটি পড়েছেন, সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেছেন, এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। আজ থেকে আগের মতোই বাস এই কলমা গ্রামের ভেতর দিয়ে যাবে। এই গ্রামের টেলিভিশনে আজ থেকেই আগের মতো স্যাটেলাইট সংযোগ দিতে হবে।

জেলা প্রশাসক বলেন, গ্রামের যতগুলো গভীর নলকূপ রয়েছে সেগুলো গত ১০ বছর ধরে যাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, তেমনি থাকবে। আর এই গ্রামের বিএনপির লোক যারা ভয়ে গ্রাম ছেড়ে বাইরে রয়েছেন, তাদের আজকেই ডেকে আনতে হবে।

তিনি আওয়ামী লীগের নেতাদের উদ্দেশে বলেন, এটা তো তাদেরই দায়িত্ব। তিনি বলেন, ভোটের আগের দিন যারা আওয়ামী লীগের লোকজনের ওপর হামলা করে গাড়ি ভাঙচুর করেছেন, তাঁরা অপরাধী। তাঁরা গ্রেপ্তার হবেন।

রাজশাহীর পুলিশ সুপার মো. শহিদুল্লাহ বলেন, নির্বাচনের আগের হামলার ঘটনাও দুঃখজনক। আবার পরে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, সেটাও অনাকাক্সিক্ষত।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) চৌ. মো. গোলাম রাব্বী বলেন, কলমা গ্রামটিকে নিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। এটি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিগোচর হয়েছে। তিনি জেলা প্রশাসক স্যারের নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তানোর থানার ওসিকে সঙ্গে করে কলমা গ্রামে এসে সবার সঙ্গে কথা বলেছেন।

এদিকে, গতকাল সোমবার দুপুরে সরেজমিনে অবরুদ্ধ তানোরের আলোচিত কলমা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, প্রশাসনের হস্তক্ষেপে মানুষের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এলেও শঙ্কা কাটেনি।

নয়দিন পর সোমবার সকাল থেকে কলমা বাজারের মার্কেট ও সড়কগুলোতে মানুষের ভিড় বেড়েছে। কয়েকটি পাড়া-মহল্লায় বিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও স্যাটেলাইট ডিস লাইনের সংযোগ মেরামত কাজ করতে লক্ষ্য করা গেছে। তাছাড়া সীমিত পরিসরে কলমা বাজার দিয়ে অটোরিকশা ও বাস চলছে বলতেও দেখা যায়।

এ সময় স্থানীয় বিএনপি নেতারা অবশ্য দাবি করেন সাধারণ মানুষ ও দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে এখনও আতঙ্ক কাটেনি। বরং, রোববার বিকেলে কলমা স্কুল মাঠে এসে সকলকে নিয়ে ডিসি-এসপি মহাদয় মিটিং করেন।

আর সেদিনই দিবাগত রাতেই স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে তানোর থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। ফলে বিএনপি-জামায়াতের তৃণমূলের অনেকেই ধরপাকড়ের ভয়ে এলাকায় আসছেনা।

উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও তানোর পৌর মেয়র মিজানুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, এ ঘটনায় তিনিসহ ওই গ্রামের অবরুদ্ধ থাকা দলীয় নেতাকর্মী বিরুদ্ধেই রোববার রাতে নতুন করে তানোর থানায় মামলা দায়ের হয়েছে।

তারপর থেকে পুলিশ নেতাকর্মীদের বাসায় তল্লাশী চালাচ্ছে। ভয়ে আবারও এলাকার শত শত নেতাকর্মী পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে দাবী করেন বিএনপির এই নেতা।

এ ব্যাপারে মুঠোফোনে কথা বলার চেষ্টা করা হয় তানোর থানার ভারপ্রাপক কর্মকর্তা (ওসি) রেজাউল ইসলাম এবং উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও কলমা ইউপি চেয়ারম্যান লুৎফর হায়দার রশিদ ময়নার সঙ্গে। তাঁরা ফোন ধরেননি।

তবে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও স্থানীয় সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপনাকে হত্যা করবে আর আপনি নীরবে সয়ে যাবেন? আপনাকে একের পর এক শারীরিকভাবে আঘাত করবে হেনস্থা করবে আর আপনি কেবল শান্তির বুলি ছড়িয়ে যাবেন। সেটি কি বাস্তবসম্মত?

বঙ্গবন্ধু বেশি আবেগী ছিলেন। যার ফলে নিজের নিরাপত্তাবোধকে গুরুত্ব কম দিয়েছেন। আর তাই নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। এ দেশ পাকিস্তানপন্থী জঙ্গীদের হাতে পড়ে তখনই।

কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবেগী সঙ্গে বাস্তববাদীও। যার ফলে অসংখ্য ষড়যন্ত্রের চেষ্টা বিফলে গেছে শত্রুদের। দেশকে তিনি নিয়ে এসেছেন সমৃদ্ধির পথে। স্বাধীনতার চেতনার পথে।’

তিনি বলেন, কলমা গ্রামের ঘটনার কিছু সত্যতা আছে। কিন্তু তথ্যঘাটতি এবং বিকৃতি অনেক। আমার নিজ এলাকা হলেও এই কলমা কেন্দ্রটিতে ধানের শীষই জেতে বেশি। এবারো জিতেছে।

গ্রামটি প্রয়াত জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শীষ মোহাম্মদের। সাংসদ ফারুক মুঠোফোনে আরও বলেন, আমি স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছি যাতে কোন রকম প্রতিহিংসামূলক আচরণ না হয় প্রতিপক্ষের সঙ্গে। তারপরও আমি বিষয়টি দেখছি।

বিএ-২৫/০৭-০১ (নিজস্ব প্রতিবেদক)