ঋত্বিক ঘটকের পিতৃভিটা ভেঙে সাইকেল গ্যারেজ!

বাংলা চলচ্চিত্রের প্রবাদ পুরুষ ঋত্বিক ঘটক ৪৩ বছর আগে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। এই কিংবদন্তি ১৯৭৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় মারা যান। ১৯২৫ সালে তার জন্ম। ১৯৪৭ এর পর স্থায়ী হন কলকাতায়। কৈশোরেই যুক্ত হন গণনাট্যের সঙ্গে। ঋত্বিক নির্মিত প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘অযান্ত্রিক’।

এরপর একে একে নির্মাণ করেন নাগরিক, বাড়ি থেকে পালিয়ে, মেঘে ঢাকা তারা, কোমলগান্ধার, সুবর্ণরেখা এবং যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো চলচ্চিত্র। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে নিজ জন্মভূমিতে আসেন তিনি। অদ্বৈত মল্লবর্মণের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ করেন তার অমূল্য সৃষ্টি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবিটি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে তিনি তৈরি করেছিলেন প্রামাণ্য চিত্র- দুর্বার গতি পদ্মা। ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃকবাড়ি রাজশাহীর মিঞা পাড়ায় অবস্থিত।

আসল ঘটনা হলো গুণী এই মানুষটির স্মৃতি বিজড়িত এই বাড়িটি এখন হুমকির মুখে। জীবনের শুরুর দিনগুলো তিনি কাটিয়েছেন পৈতৃকবাড়ি রাজশাহীতে। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহী কলেজে পড়েছেন তিনি।

রাজশাহী কলেজ এবং মিঞাপাড়ার সাধারণ গ্রন্থাগার মাঠে প্রখ্যাত সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে নাট্যচর্চা করেছেন। এই সময় ‘অভিধারা’ নামে সাহিত্যের কাগজ সম্পাদনা করেছেন ঋত্বিক। তাকে ঘিরেই সেসময়ের রাজশাহীতে সাহিত্য ও নাট্য আন্দোলন বেগবান হয়।

আজ সাইকেল গ্যারেজ তৈরির জন্য বাংলা চলচ্চিত্রের পুরোধা ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃকবাড়ি ভেঙে ফেলছে রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে বাড়ির একটি অংশ পুরোটা ভেঙে ইট, সিমেন্ট ও সুরকি সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলে সেখানকার স্থানীয় সংবাদ পত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছে।

আর এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন ১২ জন চলচ্চিত্র নির্মাতা। ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি ভাঙায় প্রতিবাদ জানিয়ে এক বিবৃতি দিয়েছেন এই নির্মাতারা। বিবৃতি প্রদানকারী নির্মাতারা হলেন ১) নাসির উদ্দীন ইউসুফ ২) তানভীর মোকাম্মেল ৩) মানজারে হাসীন মুরাদ ৪) মোরশেদুল ইসলাম ৫) এনায়েত করিম বাবুল ৬)জাহিদুর রহিম অঞ্জন৭) শামীম আক্তার ৮) নূরুল আলম আতিক ৯) এন রাশেদ চৌধুরী ১০) ফওজিয়া খান ১১) আকরাম খান ও ১২) রাকিবুল হাসান

এই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বিশ্ববরেণ্য বাঙালি চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃকবাড়ি রাজশাহীর মিঞা পাড়ার ভবনটি ভেঙে ফেলার ঘৃণ্য উদ্যোগকে আমরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি। পরিত্যক্ত ওই বাড়িতে একটি ‘ঋত্বিক চলচ্চিত্র কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা দেশের চলচ্চিত্র কর্মীদের দীর্ঘদিনের দাবি।

কিন্তু সামরিক শাসন এবং স্বৈর শাসনকালে সে স্থানে একটি হোমিওপ্যাথ কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। রাজশাহীর ‘ঋত্বিক চলচ্চিত্র সংসদ’ কর্মীরা সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী জনাব আসাদুজ্জামান নূরের কাছে ঐতিহ্যবাহী বাড়িতে একটি চলচ্চিত্র কেন্দ্র করার জন্য দাবিপত্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়।

কিন্তু বিগত ৩ বছরে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি। গত শনিবার ২১ ডিসেম্বর কলেজ কর্তৃপক্ষ সাইকেল স্ট্যান্ড করার অজুহাতে ভবনের একটি অংশ গুঁড়িয়ে দেয়। আমরা এ হীন কাজের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। বিষয়টি আজ সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে, এম খালেদ বাবু’র গোচরে এলে তিনি দ্রুত জেলা প্রশাসককে ভাঙার কাজ স্থগিত করতে আশু পদক্ষেপ গ্রহণে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানান। নির্দেশ মতো ভাঙার কাজ স্থগিত হয়েছে। কিন্তু আমরা মনে করি এটা সাময়িক ব্যবস্থা।

বাংলা চলচ্চিত্রের নিজস্ব ভাষা নির্মাণে ঋত্বিক ঘটক একটি অবিস্মরণীয় নাম। তিনি আমাদের এই বাংলাদেশে জন্মেছিলেন এত আমাদের শ্লাঘার বিষয়।

আমরা অনতি বিলম্বে ‘ঋত্বিক সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা এবং আমাদের চলচ্চিত্রের ঐতিহ্য রক্ষার জন্য ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক ভবনটিকে ‘হেরিটেজ’ ঘোষণা করে স্থায়ী সমাধানের আহ্বান জানাচ্ছি।

দেশ বিদেশের চলচ্চিত্র প্রদর্শন, গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও উৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে উত্তরবঙ্গে একটি ভিন্নমাত্রার চলচ্চিত্র আন্দোলন এই প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে। আর এই ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললে আমাদের চলচ্চিত্র সংস্কৃতির বিকাশ সাধিত হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

আমাদের জোর দাবি হোমিওপ্যাথ কলেজটি ভিন্ন একটি স্থানে স্থানান্তর করে ‘ঋত্বিক চলচিত্র কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করা হোক।’

বাংলা চলচ্চিত্রের নিজস্ব ঘরানা সৃষ্টি আর চলচ্চিত্রের ভাষাকে মাটি ও মানুষের অন্তরঙ্গ করে তোলার প্রচেষ্টায় আমৃত্যু রত ছিলেন এই নির্মাতা। মানুষের জীবনের নানা উত্থান-পতনের গল্প আর রাজনৈতিক চেতনার ছাপ স্পষ্ট তার প্রতিটি সৃষ্টিকর্মেই। শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণ নয়, নির্দেশনা দিয়েছেন মঞ্চনাটকেও। নির্মাণ করেছেন অসাধারণ সব তথ্যচিত্র।

ঋত্বিক ঘটক ১৯৬৫ সালে স্বল্প সময়ের জন্য পুনেতে বসবাস করেন। এসময় তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেন ও পরবর্তীকালে ভাইস-প্রিন্সিপাল হন। ১৯৭০ সালে কীর্তিমান এ নির্মাতাকে পদ্মশ্রী খেতাবে ভূষিত করেন ভারত সরকার।

বিএ-১০/২৪-১২ (নিজস্ব প্রতিবেদক)