পা নেই, করছেন ডেলিভারির কাজ

শারীরিক অক্ষমতা দমিয়ে রাখতে পারেনি জাহিদুল ইসলাম পলাশকে। অদম্য শক্তি আর সাহস নিয়ে এগিয়ে চলছেন ২২ বছরের এই যুবক।

নেই একটি পা, অপরটিও অচল। তবুও জীবনযুদ্ধের লড়াইয়ে অপরাজিত সৈনিক জাহিদুল। করছেন ডেলিভারির কাজ। হুইলচেয়ারে করে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছেন একটি অনলাইন খাবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের খাবার।

রাজশাহী মহানগরীর কাজলার ধরমপুর পশ্চিম পাড়ায় তার বাড়ি। বাবা নাজির আলি (৫০) একজন রিকশাচালক। মা জানেহার বেগম (৪০) গৃহিনী। তিন ভাইয়ের মধ্যে পলাশ দ্বিতীয়।

পলাশের জন্ম ১৯৯৮ সালে। জন্মের পরে সুস্থ-সবল ছিলেন। বেড়ে উঠছিলেন আর ১০ জনের মতোই। কিন্তু ২০১০ সালের ১৮ ডিসেম্বর একটি দুর্ঘটনা জীবনের মোড় বদলে দেয়। নগরীর কাজলায় বৈদ্যুতিক তার খসে পড়ে গায়ের ওপর।

জ্ঞান ফেরার পরে নিজেকে আবিষ্কার করেন ঢাকার একটি হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। বাম পায়ের হাড় ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। হাঁটুর নিচে থেকে এটি অপসারণ করা হয়।

আর ডান পায়ের তিনটা আঙ্গুল ও রগ নেই। ফলে শরীরের সঙ্গে থাকলেও এটি কাজ করে না। প্লাস্টিক সার্জারি রয়েছে ঘাড়ের ওপরেও। এরপর থেকেই শুরু হয় পলাশের হুইলচেয়ারের জীবন।

পলাশ জানান, সপ্তাহ দুয়েক হলো ফুডপান্ডার রাইডার হিসেবে কাজ করছেন। ফাঁকা সময়ে তিনি খাবার সরবরাহের কাজ করেন। নির্ধারিত জোনের ২০০-৫০০ ফিটের মধ্যে প্রতিটি ডেলিভারির জন্য পান ২২ টাকা। এর বাইরে যেতে হলে প্রতি কিলোমিটারের জন্য যোগ হয় আরও দুই টাকা। এভাবে ডেলিভারি প্রতি ২২-৩২ টাকা পর্যন্ত পান পলাশ।

পলাশ জানালেন, ফুডপান্ডায় ৩ ঘণ্টা ও ৬ ঘণ্টা করে কাজের শিফট থাকে। নিজের শারীরিক অক্ষমতার কারণে সবসময় শিফট ধরতে পারেন না। তখন অন্য কারো শিফটে কাজ করেন। গত দুই সপ্তাহে তার মোট আয় এক হাজার ৪০০ টাকা।

নগরীর দেওয়ানপাড়াস্থ মেট্রোপলিটন বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছেন। ভালো একটা বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে লেখাপড়া করতে চান পলাশ। সেজন্য জমাচ্ছেন টাকা।

পলাশ বলেন, বাবার রিকশা চালানোর আয় দিয়ে কষ্টে সংসার চলে। ছোট ভাই নুরুজ্জামান প্রান্ত এবার এসএসসি পরীক্ষা দিবে। দুজনের লেখাপড়ার ব্যয় বহন করতে হিমশিম খাচ্ছেন বাবা। এর মাঝে ছোট ভাইটাও বসে থাকে না। নিজের পকেট খরচের জন্য মাঝে মাঝে কাজে লেগে পড়ে। তাই আর বসে থাকতে পারলাম না। নিজেকে আত্মনির্ভরশীল করতে এবং উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পথে আর্থিক অসঙ্গতি যেন বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারে তাই ফুডপান্ডায় কাজ শুরু করলাম।

পলাশ বলেন, অন্যের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে স্বাবলম্বী হতে চাই। যেন কারও কাছে হাত পাততে না হয়।

তিনি জানান, প্রতিবন্ধীদেরকে সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে চান। এজন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন আশার আলো প্রতিবন্ধি উন্নয়ন সংগঠন। এরইমধ্যে সংগঠনে যুক্ত হয়েছেন ৬০ জন প্রতিবন্ধী।

পলাশের রয়েছে অসাধারণ ক্রীড়া দক্ষতা। বাংলাদেশ হুইলচেয়ার স্পোর্টস ফাউন্ডেশনের নিবন্ধিত খেলোয়াড় তিনি। ফাউন্ডেশনের আয়োজনে ২০১৯ সালে জাতীয় ডার্ট প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। প্রাণশক্তিতে ভরপুর পলাশ বর্তমানে গ্রাফিক্স ডিজাইনের ওপর প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।

পলাশ বলেন, প্রতিবন্ধী হলেও আমি স্বাভাবিক জীবনযাপন করছি। একজন প্রতিবন্ধী মানুষ কৃষিকাজ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের নেতৃত্বের জায়গাতেও অবদান রাখতে পারেন বলে আমি বিশ্বাস করি। তাই নিজের সামর্থ্যের ওপর আস্থা রেখে সৃষ্টিকর্তার ভরসায় এগিয়ে যাচ্ছি।

এসএইচ-১৬/২৬/২১ (নিজস্ব প্রতিবেদক)