সুলতানের শপথে চুলচেঁড়া বিশ্লেষণে নির্বাচনী এলাকার মানুষ

মৌলভীবাজার-২ আসনের সংসদ সদস্য সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদকে নিয়ে থামছে না আলোচনা। নিজ নির্বাচনী এলাকার সাধারণ মানুষ থেকে জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিবিদদের মধ্যে চলছে সুলতান মনসুরের শপথ নিয়ে চুলচেঁড়া বিশ্লেষণ। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি’র দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দ নানা ইস্যুতে সুলতান মনসুরের শপথ প্রসঙ্গে নানা যুক্তি তর্ক উপস্থাপনে সরব ভূমিকা রাখছেন। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সুলতান মনসুরের শপথ ও বহিস্কারের বিষয় নিয়ে আলোচনা এখন তুঙ্গে। এ ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে গণফোরাম তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের।

বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে বিজয়ী হয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে শপথ নেওয়ায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে তার নির্বাচনী এলাকার মানুয়ের মাঝে।। স্থানীয় আ’লীগ, বিএনপি, ছাত্রলীগ, ছাত্দল ও গনফোরামের দায়িত্বশীল নেতারা শপথের ব্যাপারে মত দিয়েছেন নানা দিক দিয়ে। বিশেষ করে সুলতান মনসুরের জন্য কুলাউড়ার ২জনের মৃত্যুর বিষয়টি স্পর্শকাতর বলেও উল্লেখ্য করে শপথের বিষয়টি ভালো চোখে দেখছে না স্থানীয় বিএনপির একাধিক নেতা। তবে আ’লীগের একাধিক নেতা শপথকে স্বাগত জানিয়েছেন। আর তৃণমূলের সাধারণ মানুষ বলছেন জনগনের সম্মান রক্ষার্থে শপথ নেয়ায় ছিল সময়ের দাপি।

সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বৃহস্পতিবার (৭মার্চ) সকাল সাড়ে ১১টায় শপথ নিয়েছেন আ’লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক ডাকসু ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ। স্পিকারের কার্যালয়ে তাকে শপথবাক্য পাঠ করান স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। স্পিকারের আসনের বাম পাশে বিরোধী দলের আসনের দ্বিতীয় সারিতে সুলতান মনসুরকে আসন দেওয়া হয়।

ভোট ডাকাতির অভিযোগে ফল প্রত্যাখ্যান করা বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সিদ্ধান্ত ছিল, তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেবে না। সেই সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করেই শেষমেশ শপথ নিয়েছেন সাবেক এ ভিপি।

সুলতান মনসুর আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। দলটির সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন ডাকসুর সাবেক এই ভিপি। তবে ওয়ান-ইলেভেনের সময় সংস্কারপন্থী তকমা লাগার পর আওয়ামী লীগে গুরুত্ব হারান সুলতান।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত গণফোরামে যোগ দিয়ে নতুন করে আলোচনায় আসেন সুলতান মনসুর। এরপর নির্বাচিত হয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে সকালে শপথ গ্রহণ করেছেন তিনি, দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করায় ছয় ঘন্টার মাথায় বিকালে গণফোরাম থেকে হয়েছেন বহিষ্কার। এমনকি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য পদ থেকেও তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। আর সংসদে গিয়ে বলেছেন-‘বঙ্গবন্ধুুর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হইনি।’

এদিকে সুলতান মনসুরের শপথ গ্রহণ, এরপর তাকে বহিষ্কার এসব বিষয় নিয়ে সিলেটের সর্ব মহলে চলে আলোচনা-সমালোচনা। এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সংসদের অধিবেশনে যোগ দেন সুলতান। ফলে আলোচনা-সমালোচনায় যোগ হয় ভিন্ন মাত্রা। সুলতান মনসুরের নির্বাচনী এলাকা মৌলভীবাজার-২ (কুলাউড়া) দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। সুলতান মনসুর ফের আওয়ামী লীগে যোগ দিচ্ছেন কিনা,, এ আলোচনা আসছে সামনে।

সুলতান মনসুরের শপথের ব্যাপারে কুলাউড়া উপজেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক এম. গিয়াস উদ্দিন মুল্লাহ বলেন- ‘আমরা ব্যক্তি দেখে কাজ করিনি। আমরা দেখেছি দলীয় প্রতীক। গেল নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বিজয়ী করতে পেরে আমার সন্তুষ্ট । কিন্তু এখনকার বিষয় (শপথ) দলীয় হাই কমান্ড দেখবে।’

সুলতান মনসুরের শপথকে স্বাগত জানিয়ে প্রবাসী কমিউনিটি নেতা জিল্লুর রহমান বলেন, ‘একজন যোগ্য রাজনীতিবিদ হিসেবে কুলাউড়ার হাল ধরা ছিল সময়ের দাবী।’

সুলতান মনসুরের শপথ প্রসঙ্গে কুলাউড়া উপজেলা গণফোরামের আiiহ্বায়য়ক মতাহির আলম চৌধুরী দুটি ব্যাখা দেন। তার মতে- ‘জনগনের প্রত্যাশা পূরনে তিনি (সুলতান মনসুর) শপথ নিয়েছেন। এতে একদিকে লাভ হলেও অন্যদিকে ক্ষতি হয়েছে। অন্য এক প্রসঙ্গ টেনে গণফোরামের আহŸায়ক বলন-‘তিনি দলের সিদ্ধান্ত মানতে পারতেন।’

শপথকে অভিনন্দন জানিয়ে কুলাউড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবু সায়হাম রুমেল বলেন- ‘তিনি (সুলতান মনসুর) নিজেকে একজন বঙ্গবন্ধুর অনুসারী দাবী করেন। আমরাও সেই অনুসারী। সে হিসেবে জাতীর জনকের স্বপ্ন বাস্তবায়নে বর্তমান এমপি মহোদয় অগ্রনী ভূমিকা রাখবেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বস। এবং কুলাউড়ার উন্নয়নে বর্তমান সরকারের হয়ে হাল ধরেবেন।’

প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বস ছেড়েছেড়ে, বাংলাদেশে রাজনীতি করবেন না বলে জানান কুলাউড়া পৌরসভার দুইবারের সবেক মেয়র ও বিএনপি নেতা কামাল উদ্দিন আহমদ জুনেদ। তিনি বলেন- ‘সুলতান মনসুরের জন্য আমাদের দু’জন মারা গেছেন। প্রায় ৮শত জন নেতা-কর্মীর উপর মামলা হয়। প্রায় ৮০ জনকে জামিনে মুক্ত করতে সক্ষম হই। আর মনসুর সাহেব কি করলেন, নিজ স্বার্থে শপথ নিলেন।’

এক প্রশ্নের উত্তরে বিএনপি নেতা জুনেদ বলেন- ‘আমাদের হাইকমান্ড ধানের শীষ প্রতীক দিয়ে আমাদের কাছে পাঠিয়েছিল। আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সুলতান মনসুরকে জয়ী করে দিয়েছি। বর্তমান প্রেক্ষাপট হাইকমান্ড দেখবে।’

সুলতান মনসুর ব্যক্তিগতভাবে জয়ী আর রাজনৈতিকভাবে পরাজয় মন্তব্য করে কুলাউড়া উপজেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম রেনু বলেন- ‘সুলতান মনসুর শপথ করে প্রামন করেছেন বর্তমান সরকারের অধীনে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। কেননা সুলতান মনসুর বিএনপি-জামায়াতের হয়ে নির্বাচন করে জয়ী হয়েছেন। আর বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সিদ্ধান্ত ছিল, তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা শপথ নেবে না।’

কুলাউড়া উপজেলা আ’লীগের সহ-সভাপতি নবাব আলী ওয়াজেদ খান বাবু শপথ প্রসঙ্গে বলেন- ‘সাধারণ জনগন ভোটের মাধ্যমে সুলতান মনসুরের পক্ষে যে রায় দিয়ে আত্মমর্যাদার পরিচয় দেখিয়েছে। জনগনের সম্মান রক্ষার্থে সুলতান মনসুর শপথ গ্রহন করেছেন বলে আমি মনে করি।’

সুলতান মনসুর সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করেছেন জানিয়ে মৌলভীবাজার জেলা আ’লীগের সদস্য ও কুলাউড়া উপজেলা আ’লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি এবং বরমচাল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল আহব্বাব চৌধুরী শাহাজান বলেন- ‘সাধারণ জনগন সুলতান মনসুরকে ভোট দিয়ে কোন অপরাধ করেনি। জনগনের কথা সংসদে তুলে ধরতেই সুলতান মনসুর শপথ নিয়েছেন। এখানে কে কি বলল সেটা বিষয় নয়।’ বহিষ্কার প্রসঙ্গে সিনিয়র এ আ’লীগ নেতা বলেন-‘সেটা সুলতান মনসুর ও গনফোরাম কিংবা ঐক্যফ্রন্টের বিষয়।’

মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবি এড. এ এন এম আবেদ রাজা বলেন-‘ সুলতান মনসুরের শপথকে কুলাউড়া বিএনপি ঘৃনাভরে প্রত্যাখান করে। অন্য এক প্রসঙ্গে বলেন-‘সুলতান সাহেব রাজনীতির সাথে বিশ^াস ঘাতকতা করেছেন।’

শপথ প্রসঙ্গে কথা বলেছেন মৌলভীবাজার-২ আসনের ২০ দলীয় জোটের মনোনয়ন প্রত্যাশী জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) প্রেসিডিয়াম সদস্য ও তিনবারের সাবেক এমপি নওয়াব আলী আব্বাস খান। তাকে বাদ দিয়ে গণফোরামের দাবিতে সুলতান মনসুরকে মনোনয়ন দিয়েছিল বিএনপি। মনোনয়ন না পেলেও নির্বাচনের সময় সুলতান মনসুরকে পূর্ন সমর্থন দেন আলী আব্বাস খান। আলী আব্বাস বলেন- ‘বিএনপি ও জোটের কর্মীরা জীবনবাজি রেখে নির্বাচনের আগের রাতে ভোট কাটা ঠেকিয়েছে। মামলা হামলার মুখেও নির্বাচনের মাঠে থেকে সুলতান মনসুরকে জিতিয়েছে। জোটের কর্মীদের এত ত্যাগকে অসম্মান করে সুলতান মনসুর যা করেছেন তা দুর্ভাগ্যজনক।’

উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি ও আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ২০০৯ সালের সম্মেলনে বাদ পড়েন দলীয় পদ থেকে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পর অনেকেই মনে করেছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনীতি এখানেই শেষ। তাই অনেক নেতাই সে সময় ভিন্ন পথ ধরেছিলেন। কিন্তু সুলতান মোহাম্মদ মননুর বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। এ কারণে জীবনের বড় একটা সময় কাটাতে হয়ছে ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ে আত্মগোপনে।

৭৫-এর পর প্রথম ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে ডাকসুর ভিপি হয়ে তিনি পাদপ্রদীপে এসেছিলেন। ১৯৬৮ সাল থেকে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে যে রাজনীতি শুরু করেছিলেন তা আজও আছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকারবিরোধী ঐক্যন্টে যোগ দিলেও লাখো সরকারবিরোধী কর্মীর সামনে আঙুল উঁচিয়ে বলেছেন-‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’। বারবার জনসভায় উচ্চারণ করেছেন – ‘আজন্ম বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে নিয়েই চলব।’

সৎ, পরিচ্ছন্ন ও সুনীতির ব্যক্তি সুলতান মনসুর মেধাবী, আদর্শবান ও পরীক্ষিত ছাত্রনেতা হিসেবে আশির দশকে সারা বাংলাদেশ কাঁপিয়েছিলেন। নেতৃত্বগুণে শেখ হাসিনার কাছের মানুষ হতেও তার সময় লাগেনি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হয়ে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক হয়েছিলেন। এর প্রমাণও দিয়েছিলেন সে সময়। দায়িত্ব গ্রহণ করে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলনে তার সক্রিয় রাজনীতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

কিন্তু নেত্রীর আস্থাভাজন হয়েও ১/১১-এর পর সংস্কারপন্থী হিসেবে তাকে আখ্যায়িত করা হয়। সে সময় সংস্কারপন্থী হিসেবে আখ্যায়িত তোফায়েল আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক, আমির হোসেন আমু, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ অনেকেই দলে ফিরে আসেন। কিন্তু ফিরে আসতে পারেননি ‘৭৫ পরবর্তী পরিস্থিতিতে অস্ত্রহাতে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধের ডাক দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া এবং আশির দশকের কঠিন সময়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রাজনীতিকে সক্রিয় ও সুসংগঠিত করার কারিগর সুলতান মনসুর।

বিএ-১০/০৯-০৩ (আঞ্চলিক ডেস্ক)