বিশিষ্ট এক চিকিৎসকের দৃষ্টিতে পবিত্র কোরআন

বিশিষ্ট এক চিকিৎসকের

আজাদ স্যারের কথাগুলো আমার মাদ্রাসা শিক্ষাকে নতুন করে ভাবতে শেখাল। কামিল প্রথমপর্ব পরীক্ষা শেষে যখন দ্বিতীয়পর্ব নিয়ে ভাবছি তখন জানলাম, কোরআন কখনই আমাদের মতো মোল্লা-মুনশি চায়নি।

আলেম এবং দ্বীনের দায়িত্ব সম্পর্কে আমরা যা বুঝি- কোরআনে তার ন্যূনতম ইঙ্গিতও নেই। হ্যাঁ কথাগুলো যিনি বলেছেন, তার দিকে অবাক হয়ে তাকালাম।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. রফিক আজাদ। তার একমাত্র ছেলে জাভিদ আমার কাছে কোরআন পড়ে। সেই সুবাদে টুকটাক কথা হয় দেশসেরা এ চিকিৎসকের সঙ্গে। সচরাচর যে ধরনের কথা ও চিন্তা শুনে মাদ্রাসা জীবনে বেড়ে উঠেছি, ঠিক তার উল্টো কথা শুনি আজাদ স্যারের মুখে। মাঝে মাঝে খুব বিরক্ত হয়ে যাই। ডাক্তার হয়েছেন, ডাক্তারি নিয়েই থাকুন।

ইসলাম নিয়ে কোরআন নিয়ে কথা বলার সাহস পান কোথায়? ইসলাম নিয়ে কথা বলার দায়িত্ব তো আমাদের। আমার মতো ২০ বছর মাদ্রাসায় পড়ে আসুন। তারপর না হয় ইসলাম নিয়ে কোরআন নিয়ে কথা বলুন!

যা মনে মনেই আওড়াতাম আজ মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল। নিজেকে সংযত করলাম। বললাম, স্যার! আমরা তো আপনাদের ডাক্তারি নিয়ে কথা বলি না। অসুখ হলে আপনাদের কাছে আসি। আপনাদের কথামতো চিকিৎসা নিই।

তেমনি ধর্মের ক্ষেত্রেও বিশেষজ্ঞ আছে। আপনারা হলেন শরীরের ডাক্তার। আর আলেমরা হলেন শরিয়তের বিশেষজ্ঞ। ধর্ম বিষয়ে তাদের প্রেস্ক্রিপশন মেনে নেয়াটাই কি যুক্তি ও বাস্তবতার দাবি নয়? অ্যাবসুলিউটলি রাইট। তুমি অবশ্যই ঠিক বলেছ মামুন। বলে তিনি চুপ হলেন। এক সপ্তাহ পর স্যারের সঙ্গে দেখা। আজাদ স্যার বলেন বিভিন্ন দেশের চিকিৎসকদের নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় একটি কনফারেন্স হয়। এক সপ্তাহের সফর শেষে দুপুরে ফিরছি। এ চকলেটগুলো তোমার জন্য।

গত সপ্তাহে তুমি বলছিলে, ধর্ম নিয়ে কথা বলার অধিকার শুধু মাদ্রাসা পড়–য়াদের। যেমন ডাক্তারি নিয়ে কথা বলার অধিকার শুধু আমাদের। আমি বলেছি, কোরআন কখনই এমন আলেম চায়নি, যারা মনে করবে- ধর্ম নিয়ে কথা বলার অধিকার ‘একান্তই’ তাদের। তোমার কথার পক্ষে যুক্তি দিয়েছ, ডাক্তারি বিষয়ে তোমরা নাগ গলাও না। তাই ধর্মের বিষয়েও ধর্ম বিশেষজ্ঞ ছাড়া নাক গলান উচিত নয়।

কিছুক্ষণ থেমে আবার বলতে শুরু করলেন তিনি- তুমি নিশ্চয়ই জান, চিকিৎসা শ্বাস্ত্রে দুটি পদ্ধতি এখন পরিচিত। অ্যালোপ্যাথিক আর হোমিওপ্যাথিক। আমাদের দৃষ্টিতে হোমিওপ্যাথি কোনো চিকিৎসা পদ্ধতিই নয়। কনফারেন্সেও একই কথা বলে এসেছি- হোমিওপ্যাথির কুসংস্কার থেকে মানুষকে সচেতন করা আমাদের দায়িত্ব। তোমাদের ভাষায় ‘ইমানি দায়িত্ব’।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে স্যার বললেন, হোমিওপ্যাথিকরাও কিন্তু আমাদের দেখতে পারেন না। তারাও মানুষকে সচেতন করে যেন আমাদের কাছে না আসে।

আমি নিজে অ্যালোপ্যাথিতে ব্যর্থ হয়ে হোমিওপ্যাথির চিকিৎসা নিয়েছি। চাঁদপুরের সেরা হোমিও ডাক্তার আমার ভগ্নিপতি। যখনই কোনো হোমিও ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলি, তারা প্রথমেই বলেন, কেন যে আপনারা অ্যালোপ্যাথিতে যান বুঝে আসে না। তারপর শুরু হয় অ্যালোপ্যাথির এই দোষ সেই দোষ ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কেন? জানতে চাইলাম আজাদ স্যারের কাছে। স্যার সহজ গলায় বললেন-

‘ব্যবসা!’ তারপর কিছুটা সংযত হয়ে বললেন, আমাদের এবং তাদের এমনভাবে শেখানো হয় যাতে আমরা বিশ্বাস করি- অ্যালোপ্যাথি আর হোমিওপ্যাথি একটি অপরটির শত্রু। এটা না হলে ব্যবসা টেকে না। সেবা বা যাই বল ব্যবসাটাই তো আগে। ডাক্তারি বল রাজনীতি বল সেবার নামে সবখানেই এখন ব্যবসার জাল পাতা। এটা এত বড় সত্যি কথা যে- এর জন্য কোনো প্রমাণের দরকার পড়ে না। তুমি কি বুঝতে পেরেছ, আমরা কেন ওদের আর ওরা কেন আমাদের বিরোধিতা করে? কেন একজন অন্যজনকে সহ্য করতে পারে না।

এবার তোমার কাছে আমার প্রশ্ন- তোমরা মাদ্রাসা পড়–য়ারা কেন মানুষকে ধর্মীয় বিষয়ে বলতে দাও না?

তার মানে কি আমাদেরও এমন কৌশলে ধর্মশাস্ত্র শেখানো হয় যাতে আমরা ধরেই নিই এখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার নিষেধ। মনে পড়ে অনেক আগে দেওবন্দ ফারেগ বন্ধু মাওলানা রফিক বলেছিলেন, দেওবন্দি চিন্তাচেতনা লালনকারীরাই শুধু আলেম, অন্য কেউ নন। ছারছীনা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে পাস করা বন্ধু মাওলানা নোমান বলেছিলেন, আলিয়ার চিন্তাধারা লালন না করা পর্যন্ত আলেম তো দূরের কথা মুসলমানই হওয়া সম্ভব নয়।

দেখ মামুন! কোরআন ব্যবসা-চিকিৎসা-আইন-প্রার্থনাসহ অনেক প্রসঙ্গই বলেছে। কিন্তু মোল্লা-মুন্সি হয়ে ধর্মকে জীবিকার উৎস বানিয়ে ফেলার কথা কোথাও নেই। এটা অনেকটা খিস্ট্রানদের যাজক, হিন্দুদের পুরোহিত ইহুদিদের রাব্বিতন্ত্রের মতো। সূরা তাওবার ২৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা স্পষ্ট বলেছেন, ‘তারা আল্লাহকে ছেড়ে পুরোহিত ও দরবেশদের রব বানিয়ে নিয়েছে।’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে কাসিরসহ সব মুফাসসির বলেছেন, পুরোহিত ও দরবেশদের রব বানিয়ে নেয়ার অর্থ হল- তারা যেভাবে যে নিয়মে বলত মানুষ সেভাবে সে নিয়মেই ধর্মকর্ম ‘করতে বাধ্য থাকত’।

প্রথমদিকে ওদের আলেমরা তো মুখলিস ছিল। পরবর্তী প্রজন্মের আলেমরা ধর্মের নামে ব্যবসা শুরু করে দিল। একপর্যায়ে তারা ধর্মীয় শাস্ত্রকে নিজেদের পৈতৃক সম্পত্তি ভাবতে শুরু করল। তুমি নিশ্চয় জান, হিন্দু ধর্মগ্রন্থ সাধারণ হিন্দুদের জন্য পড়া পর্যন্ত নিষেধ এবং দণ্ডনীয় অপরাধ ঘোষণা করেছে পুরোহিতরা। আর তোমরা প্রচার করেছ, সাধারণ মানুষের জন্য কোরআন বোঝা সম্ভব নয়।

গোমরাহি পেয়ে বসবে- স্যার বললেন, অথচ আল্লাহ বারবার বলেছেন, ‘আমি বোঝার জন্য কোরআনকে সহজ করে দিয়েছি। কেউ আছ কোরআন বুঝে জীবন সাজাবে।’ আরেকটি তথ্য কোরআন যেন সাধারণ মানুষ বুঝতে না পারে সে জন্য কোরআনের বাংলা অনুবাদ পর্যন্ত হতে দেয়নি মোল্লাতন্ত্রের ধারকরা। কোরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদ করেছেন একজন হিন্দু আর ইংরেজি অনুবাদ করেছেন একজন খ্রিস্টান। আর কোরআন ও বিজ্ঞান বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে তো বুক ফুলিয়েই খ্রিস্টান বিজ্ঞানীদের থিওরি কপচাতে হয়।

স্যার তো অযৌক্তিক কোনো কথা বলেননি। মাদ্রাসায় পড়ে কোরআন-হাদিসকে আমরা নিজেদের সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেছি। এবং বাকি জীবন এ সম্পত্তি ভাঙিয়েই চলতে হয় আমাদের। রাসূল (সা.)-এর সময় তো ধর্মকে জীবিকার উৎস বানানোর কথা কেউ কল্পনাও করেনি।

প্রথম জীবনে নবীজি (সা.) ব্যবসায়ী ছিলেন। তারপর রাষ্ট্রনায়ক হলে রাষ্ট্রীয় ভাতায় তিনি সংসার চালাতেন। চার খলিফা, চার ইমাম এবং সাহাবিদের কেউই ধর্ম চর্চাকে জীবিকার উৎস বানাননি। সবাই আয়-রোজগারের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শ্রমের কাজ করেছেন। তারপর আসে ইসলামের অন্ধকার যুগ।

ফোরাত নদীর তীরে কারবালায় ডুবে যাওয়া ইসলাম আর কখনই রোদ্রকরোজ্জল হয়ে আলো ছড়াতে পারেনি। তাহলে কি আজাদ স্যারের কথাই সত্য! কোরআন কখনই আমাদের মতো মোল্লা-মুনশি তৈরি করতে চায়নি। ধর্মে আমাদের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার কি তাহলে স্রেফ জীবীকার উপকরণ?

সবশেষে স্যার বললেন, মোল্লা-মুনশি হওয়া দোষের নয়। তবে সূরা তাওবায় বলা অর্থে বোঝা যায়- মোল্লার মোড়কে রব হয়ে ওঠা দোষের। ধর্মকে সম্পত্তি বানিয়ে ফেলা অন্যায়। দরবারি আলেম অনেক হয়। মোজাদ্দেদ আলফেসানী হন একজনই।

লেখক : আল ফাতাহ মামুন, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরএম-১৩/১৩/০৪ (ধর্ম ডেস্ক)