চিত্রশিল্পি সোমার ভাবনায় কেবলি নারীর জীবন সংগ্রাম

বাড়িতে ঢুকতেই চোখ এড়ায়নি ডাইনিং টেবিলের উপর পড়ে থাকা অসমাপ্ত নারীর জীবন সংগ্রাম বিষয়ক ছবির বর্নিল রংয়ের ছড়াছড়ি। আসন্ন কোন এক প্রদর্শনীতে দেবার জন্য চলছে রংতুলির শেষ পর্যায়ের আঁচড়। দেয়ালে আটকানো বেশ কয়েকটি ছবি। চারিদিক ঘুরে চোখ বুলালেই বোঝা যায় বাড়িটিতে বাস কোন চিত্রশিল্পির। ঘরগুলো সাজানোতেও রয়েছে নানান বৈচিত্র। মেঝেতে পাতা ফমের উপর নানা কারুকার্জে ভরপুর কুসনের সুতাগুলোর আলোয় যেন আলোকিত করছে ঘরের পরিবেশ। সাথে কোনে থাকা সবুজ রংয়ের ঝাউগাছের সাথে বিভিন্ন ধরনের পাতাবাহারের সমাহার।

এমন নিরব পরিবেশে শিল্পি তাঁর মনের মাধুরি মিশিয়ে এঁকে চলেন ছবি। পুরো বাড়িতে থরে থরে রাখা নানান শিল্পের কারুকাজ। এইগুলোর যত্ন বা সংরক্ষনের জন্য সময়ের প্রয়োজন। তবে যার মাসের অধিক সময় কাটে ছবি আঁকতে, শিক্ষকতা ও বিদেশের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চিত্রপ্রদর্শনীতে। তার অবসর সময় কাটে কিভাবে। না তিনি যান্ত্রিক মানুষের মতই নিজেকে গড়ে তুলেছেন। এই সব জানার আগ্রহে এক সন্ধ্যায় হাজির রাজশাহী মহানগরীর ছোট্টবনগ্রাম এলাকার ভাড়াবাসা শনন ভিলার নিচ তলায় বসবাসকারি আন্তর্জাতিক চিত্রশিল্পি নারগিস পারভিন সোমার কাছে।

সুবিস্তর ড্রইং রুমের ডান পাশের ঘরে লাল চাদরে মোড়ানো বক্স খাটে বসে শুরু জমজমাট আড্ডা। তবে এই আড্ডার বড় চরিত্র ছিল শিল্পির একমাত্র কন্যা ষড়ং। সন্ধ্যা মাড়িয়ে গেলেও কন্যা ষড়ং পড়ার টেবিল ছেড়ে মেঝেতে পাতা ফমের উপর আরও দুই পিচ্চির সাথে পুতুল নিয়ে করছে মাস্তি। বলা যেতে পারে থ্রি ডানপিটের গলার আওয়াজে পুরো বাড়ি প্রকম্পিত হচ্ছে। সেই সাথে আছে এ ঘর থেকে অন্য ঘরে ছোটাছুটি। মাঝে মধ্যে আমাদের আড্ডায় দিচ্ছে উঁকি ঝুঁকি। কোন প্রশ্ন করলে উত্তর দিয়েই দে ছুট। সাথে খলখলিয়ে হাসির নাচন।

শিল্পি সোমা রাজশাহীতে থাকলেই সকালটা শুরু হয় নতুন কোন ছবির গল্প নিয়ে। কাপড় কিংবা সাদা মোটা কাগজে রং মাখিয়ে শুরু হয় চরিত্রের রূপায়ন দেবার। শুধু তাই নয় রান্না ঘরে চুলায় সুস্বাদু খাবার বানানোর সময় হাতের লাকড়িটাও বলে কাল্পনিক গল্পের কথা। যেনো ছবির জগতেই নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে স্বাছন্দ বোধ করেন তিনি। তাইত একের পর এক সাফল্যও তাঁর হাতে ধরা দিচ্ছে। গেলো সপ্তাহেও ভারতের একটি চিত্র প্রদশর্নীতে অংশ নিয়ে অর্জন করেছেন বেষ্ট পেন্টিং এ্যাওয়ার্ড।

এমন সাফল্যই তাঁকে কোনভাবেই পিছিয়ে যেতে দেয় না। তাইত বাড়িতে যখন একা থাকেন তখন পেটের খাবার রান্না করার কথাও ভুলতে বসেন। দোকান থেকে সংগ্রহ করা ফাষ্ট ফুড খেয়েই কাটিয়ে দেন সকাল দুপুর কখনও রাত অবধি। তাহলে অবসর সময় কাটে কিভাবে। অবসর সময়টা যেন শিল্পি সোমার ডিক্সনারি থেকে উঠতেই বসেছে। এর পরেও কন্যার জন্য হলেও একটু অবসর সময় বের করতে হয়। তবে তা বাইরে ঘোরাঘুরির জন্য নয়। কারন হাতে সময়টা কম। প্রাইভেট পড়তে নিয়ে যাওয়া। আর তাঁর পছন্দের খাবার তৈরী করে দেয়া। আর কখনও কখনও ছবির আঁকার জগতের বাইরে গিয়ে ঘর আলোকিত করা আসবাব পত্র ঝাঁড় ফুক দিয়ে ঝকঝকে তকতকে করে রাখা। তবে কখনও কখনও বসার ঘরের কোনে থাকা গিটারটা মনের অজান্তে নিয়ে টুংটাং করে মিউজিকের সুরে ছবির গল্পও খুঁজেন। এটাই যেনো এখন তার দুনিয়া, এটাই যেনে জীবন।

কথা বলতে গিয়ে সোমা বলেন, সময়ের ধারাবাহিকতায় আর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার লড়াইয়ে অবসর সময় বলতে এখন তেমন কিছু নেই। কতদিন পদ্মা পাড়ে যাওয়া হয় না তাও বলতে পারেন না। কখনও কখনও রাজশাহী চারুকলা মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষকতার বৌদলে ক্লাস নেয়া, কন্যাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া এবং আসা আর বিকেলে আবার প্রাইভেটে নিয়ে যাওয়াটা অনেকখানি ঘোরাঘুরির মধ্যে পড়েছে। আর প্রয়োজনের তাগিদে কেনাকাটা থাকলে বের হওয়া। এসবের মধ্যে চলে সবকিছু।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ের এই চিত্রশিল্পি বলেন, নারীরা এখনও পিছিয়ে আছেন। পরিবারের পক্ষ থেকে এখনও তাদের চলার পথের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। তাই সময়ের স্রোতে যতখানি নারীদের এগিয়ে যাবার কথা তা হয়নি। যতটুকু এগিয়েছে তা ছানবিন করে দেখলে সফলতার পাল্লাই ভারি হবে।

তিনি বলেন, নিজের আঁকা নারীর জীবন সংগ্রামের ছবি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রদর্শনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে চেনাতে পারছি বিভিন্ন দেশের শিল্পিদের। এটা নিজের জন্য বেশ গর্বের। শুধু তাই নয় নিজের প্রতিষ্ঠান ষড়ং আর্ট গ্রুপের আয়োজনে দেশে এবং বিদেশে প্রদর্শনীর আয়োজন করেও লাল-সবুজের পতাকা তুলে ধরতে পারছি সবার সামনে। এমন সব ভিড়ে ঘড়ির কাঁটা থামে না।

মেয়ে ষড়ংয়ের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, অবসর সময়টা সেই খেয়ে ফেলে। ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিলে তাঁর দুষ্টুমি বাড়ে। লাফ ঝাপের সাথে থাকে টিভির ভলিওম বাড়িয়ে কার্টুন দেখা। ছবি আঁকাতে ঝোঁক বেশি। সুযোগ পেলেই ক্লাসের পড়া ফাকি দিয়ে ছবি আঁকতে বসে। প্রত্যাশা করেন এই ইচ্ছাটা থাকলে মেয়েও ভবিষ্যতে ভাল চিত্রশিল্পি হতে পারবে।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ের চিত্রশিল্পি নারগিস পারভিন সোমা, বিভিন্ন চিত্র প্রদশর্নীতে নারীর জীবন সংগ্রাম বিষয়ক ছবি প্রদর্শনের মাধ্যমে অর্জন করেছেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন এ্যাওয়ার্ড। ইতমধ্যে এমন ছবি এঁকেছেন ১৬টি। আর এ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছেন ১৩টি। যার মধ্যে ১২টি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের। সর্বশেষ এ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছেন ফেব্রুয়ারীতে।

এসএইচ-০১/২৭/১৯ (সুমন হাসান)