ভারতীয় সেনাবাহিনী ব্যাপক নির্যাতন চালাচ্ছে কাশ্মীরে

ভারতের সংবিধান থেকে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করার পর ভারত শাসিত কাশ্মীরের নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে স্থানীয়দের মারধর এবং নির্যাতনের অভিযোগ অনেকদিন আগে থেকেই। ভূক্তভোগী সেসব মানুষের জবানিতে সাম্প্রতিক সেই নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেছে বৃটিশ সংবাদ মাধ্যম।

কাশ্মীরের একাধিক গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেছেন সংবাদ মাধ্যমটি। নির্যাতিত সেসব মানুষ অভিযোগ করেছেন যে, তাদেরকে তার ও লাঠি দিয়ে মারা হয়েছে এবং বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়েছে। অনেক গ্রামের বাসিন্দাদের শরীরে ক্ষতচিহ্ন দেখা যায়।

তবে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সেসব অভিযোগ সম্পর্কে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। ভারতের সেনাবাহিনী এসব অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন ও প্রমাণসাপেক্ষ নয়’ বলে দাবি করেছে। তবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কাশ্মীরের যে পরিস্থিতি উঠে এসেছে তাতে সেনাবাহিনীর এমন দাবির কোনো ভিত্তিও থাকে না।

গত ৫ আগস্ট কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার কাশ্মীরকে বিশেষ ক্ষমতা দানকারী দেশটির সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপের সিদ্ধান্ত জানায়। শুধু তাই নয় কাশ্মীরকে ভেঙ্গে রাজ্যের মর্যাদা থেকে নামিয়ে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে করে। তারপর থেকে কার্যত গোটাবিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছে কাশ্মীর।

কাশ্মীর অঞ্চলকে ধারণা করা হয় এমন একটি এলাকা হিসেবে যেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সামরিক সদস্যদের অবস্থান রয়েছে। অবশ্য ধারণা নয়, সেখানে প্রতি ৮ জনের জন্য একজন সেনা মোতায়েন রয়েছে। বিশেষ মর্যাদা বাতিলের আগে ও পরে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করা হয়েছে ।

কাশ্মীরের রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী, অ্যক্টিভিস্টসহ প্রায় তিন হাজারের বেশি মানুষকে আটকও করা হয়েছে। কাশ্মীরের কারাগারগুলোতে জায়গা সঙ্কুলান না হওয়ায় আটক অনেককে রাজ্যের বাইরের কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয়েছে।

কর্তৃপক্ষ বলছে, এসব পদক্ষেপ শুধুই রাজ্যটির জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার উদ্দেশ্যে নেয়া হয়েছে। কিন্তু আদতে গোটা কাশ্মীর অবরুদ্ধ। সেখানকার মানুষের মৌলিক চাহিদা এখন সঙ্কটাপন্ন।

গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে ভারতের সেনাবাহিনী কাশ্মীরের সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে জুলুম এমনটা করে যাচ্ছে। ভারতের অভিযোগ, ওই অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের (ভারত বলছে জঙ্গি) সহায়তা করে পাকিস্তান। তবে কাশ্মীরের একাংশ নিয়ন্ত্রণ করা পাকিস্তান সবসময়ই তা অস্বীকার করেছে।

ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপ করার সিদ্ধান্তকে ভারতের বিভিন্ন অংশের মানুষ স্বাগত জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এমন ‘সাহসী’ সিদ্ধান্তকে ভারতের গণমাধ্যমও সাধুবাদ জানিয়েছে। সেখানকার গণমাধ্যমগুলোতে কাশ্মীরের প্রকৃত চিত্র কার্যত নেই, মানে তুলে ধরা হচ্ছে না।

প্রতিবেদনে বলা হয় দক্ষিণ কাশ্মীরের অন্তত ৬টি গ্রামে ঘুরে দেখা গেছে, যেগুলো গত কয়েক বছরে ভারত বিরোধী সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উত্থানের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হতো। সেসব গ্রামের সবগুলোতর বাসিন্দাদের কাছ থেকেই নির্যাতনের একই ধরণের বক্তব্য জানতে পারা যায়।

সেসব এলাকার ডাক্তার এবং স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি, তবে গ্রামবাসীরা সংবাদদাতাকে তাদের শরীরের ক্ষত দেখিয়ে দাবি করেছেন যে নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের হাতেই নির্যাতনের শিকার হয়েছে তারা।

একজন ভুক্তভোগীর পায়ে নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন, ভারতীয় সেনাদের হাতে নির্যাতিত হওয়ার অভিযোগ করেছেন তিনি

একটি গ্রামের বাসিন্দারা অভিযোগ করেন যে ভারতের সংসদে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপের ঘোষণা আসার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি চালায় সেনাবাহিনী। মানুষকে যাকে যেভাবে পেয়েছে তাকে আটক করে নিয়ে গেছে। তাদের কোনো খোঁজ নেই।

এক গ্রামের দুই ভাই বলেন, ওইদিন সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের বাড়ি থেকে জোর করে বের করে নিয়ে গিয়ে আরও কয়েকজন গ্রামবাসীর সঙ্গে দাঁড় করায়। অন্যান্যদের মত ওই দুই ভাইও নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করতে চায়নি।

সেই দুই ভাইয়ের একজন বলেন, ‘তারা আমাদের ব্যাপক মারধর করে। আমরা তাদের জিজ্ঞাসা করি, আমরা কী করেছি? কিন্তু তারা আমাদের কোনো কথাই শোনেনি, কিছু বলেওনি, তারা আমাদের মারতেই থাকে।’

সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার শরীরের প্রতিটি অংশে তারা আঘাত করে। তারা আমাদের লাথি দেয়, লাঠি ও তার দিয়ে মারে, বৈদ্যুতিক শকও দেয়। নির্যাতনের একপর্যায়ে যখন আমরা অজ্ঞান হয়ে যাই তখন বৈদ্যুতিক শক দিয়ে আমাদের জ্ঞান ফিরিয়ে আনে।’

নির্মম সেই নির্যাতনের কথা কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘লাঠি দিয়ে মারার সময় আমরা যখন চিৎকার করছিলাম, তখন আমাদের মুখ বন্ধ করার জন্য মুখে কাদা ভরে দেয়। আমরা তাদের বারবার বলতে থাকি যে আমরা নির্দোষ। তাদের জিজ্ঞাসা করি কেন আমাদের নির্যাতন করছে। কিন্তু তারা এসব কোনো কথাই শোনেনি।’

দুই ভাইয়ের একজন বলেন, ‘সেনাবাহিনীর নির্যাতনের একপর্যায়ে আমরা তাদের বলি যে আমাদের এভাবে মেরো না দয়া করে। এর চেয়ে গুলি করো। একপর্যায়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে অনুনয় করি যেন আমাদের উঠিয়ে নেয়।’

গ্রামের আরেকজন তরুণ জানান, কিশোর ও তরুণদের মধ্যে কে কে পাথর ছুঁড়ে মেরেছে তাদের নাম বলতে সেনা সদস্যরা তাকে বারবার চাপ দিতে থাকে। এই তরুণ ও কিশোররা বিগত কয়েকবছর ধরে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের বিক্ষোভের প্রতিমূর্তি হিসেবে অনেকটাই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।

তরুণটি সেনা সদস্যদের বলেন যে, তিনি তাদের নাম জানেন না। তারপর সেনা সদস্যরা তার চশমা, জুতা ও কাপড় খুলতে নির্দেশ দেয়। তারপর তার ওপর শুরু হয় নির্মম নির্যাতন। অল্পবয়সী সেই তরুণকে নানাভাবে নির্যাতন করে সেনা সদস্যরা।

সেই নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে সে বলে, ‘আমার গায়ের কাপড় খোলার পর তারা আমাকে লোহার রড ও লাঠি দিয়ে নির্মমভাবে পেটায়, প্রায় দুঘন্টা যাবত। যখনই অজ্ঞান হয়ে যেতাম, তারা বৈদ্যুতিক শক দেয় আমার জ্ঞান ফেরানোর জন্য।’

তরুণটি বলে, ‘তারা যদি আবারো আমার সাথে এরকম করে, তাহলে আমি যে কোনোভাবে এর প্রতিরোধ করবো। প্রয়োজনে অস্ত্র হাতে তুলে নেবো।‘ সৈন্যরা তাকে সতর্ক করে দেয় যে গ্রামের কেউ যদি কোনো ধরনের বিক্ষোভে অংশ নেয় তাহলে তাদের পরিণতিও একই হবে।

এক বিবৃতিতে ভারতীয় সেনাবাহিনী বলেছে, তাদের বিরুদ্ধে আনা ‘অভিযোগ অনুযায়ী কোনো নাগরিকের সঙ্গে জবরদস্তি করেনি’। সেনাবাহিনীর মুখপাত্র কর্নেল আমান আনন্দ দাবি করেন ‘এ ধরনের কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আমাদের কাছে আসেনি। এই অভিযোগগুলো শত্রুভাবাপন্ন মানসিকতা থেকে উদ্ধৃত।’

এসএইচ-০৪/৩০/১৯ (অনলাইন ডেস্ক, তথ্য সূত্র : বিবিসি)