গান্ধী বিদ্রোহী কিশোর থেকে ‘ভারতের জাতির জনক’

১৯৪০ সাল। প্রতাপশালী এক সাম্রাজ্য পরাজিত হয়েছিল সাদাসিধে পোশাকের এক ব্যক্তির কাছে। তিনি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, যিনি মহাত্মা গান্ধী হিসেবেই বেশি পরিচিত যার অর্থ হচ্ছে “মহান আত্মা”।

সেই সময়, ভারত ছিল ব্রিটিশ শাসনের অধীনে। পৃথিবীর অনেকগুলো দেশ তখন ব্রিটিশদের উপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল।

একজন প্রজ্ঞার অধিকারী রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে গান্ধী ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতের স্বাধীনতা এবং গরীব মানুষের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছেন।

তাঁর অহিংস বিক্ষোভের উদাহরণ আজকের দিনে এখনো বিশ্বজুড়ে সমাদৃত।

তাঁর ১৫০তম জন্মবার্ষিকীতে, মহাত্মা গান্ধীর জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সময়ের দিকে ফিরে তাকাবো আমরা।

১৮৬৯ সালের ২রা অক্টোবর ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজকীয় প্রাদেশিক এলাকা পোরবন্দরে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর জন্ম।

তাঁর অভিজাত পারিবারিক ঐতিহ্য রয়েছে – তাঁর বাবা ছিলেন প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী।

তাঁর মা ছিলেন একজন অত্যন্ত ধার্মিক মহিলা, যিনি পুত্রের মধ্যে দৃঢ় হিন্দু নৈতিকতার সঞ্চার করেছিলেন।

নিরামিষ ভোজন, ধর্মীয় সহনশীলতা, সহজ-সাধারণ জীবন-যাপন এবং অহিংসার উপর জোর দিয়েছিলেন তিনি।

গান্ধীর বয়স যখন ১৩ বছর, তখন তাঁর বিয়ে হয় ১৪ বছর বয়সী স্থানীয় এক কিশোরী কস্তুরবার সাথে।

টিনএজার গান্ধী তাঁর পরিবারের কঠোর ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন: তিনি মাংস খাওয়া শুরু করেন এবং এমনকি তিনি পতিতালয়েও যেতেন, যদিও গান্ধী বলেছেন যে তিনি কখনো সেখানে কোনধরনের যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেননি।

পরে তিনি লেখেন, “আমি পাপের গহ্বরে ঢুকে পড়েছিলাম, কিন্তু ঈশ্বর তাঁর অসীম করুণায় আমাকে আমার নিজেরই কাছ থেকে রক্ষা করেছেন”।

তবুও তিনি প্রতিটি ‘অনৈতিক’ কাজের পরে অনুতপ্ত হতেন।

যখন তাঁর বাবা মৃত্যুশয্যায়, সেসময় গান্ধী তাঁর স্ত্রীর সাথে বিছানায় যৌনকর্মে ব্যস্ত ছিলেন এবং বাবার মৃত্যুর মুহূর্তে কাছে থাকতে পারেননি। এই গ্লানি তাকে তাড়া করেছে সবসময়।

নিজের জীবনীতে গান্ধী লিখেছেন এই বিষয়টি তাকে কতটা অপরাধবোধে আক্রান্ত করেছে।

“আমি অত্যন্ত লজ্জিত এবং দু:খিত বোধ করছিলাম। আমি দৌড়ে বাবার ঘরে ছুটে গেলাম। দেখলাম, যদি পাশবিক প্রবৃত্তি আমাকে অন্ধ করে না রাখতো -তাহলে বাবা আমার নিজের হাতের ওপরই মারা যেতেন”।

তার স্ত্রী যখন গর্ভবতী হলেন এবং জন্মের পরপরই তাদের সন্তানের মৃত্যু হয়, গান্ধী এটাকে মনে করলেন তার ওই অনুপস্থিতির ‘ঐশ্বরিক শাস্তি’ হিসেবে।

ব্রহ্মচর্য ব্রত

লন্ডনে আইনের ছাত্র হিসেবে অবস্থানকালে গান্ধী থিওসফিক্যাল সোসাইটির সদস্যদের সাথে মেলামেশার সুযোগ হয়, তারা গান্ধীকে উৎসাহিত করেন আরও নিবিড়ভাবে হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থ এবং বিশেষ করে ভগবৎ গীতা পাঠে ।

ভারতীয় প্রাচীন গ্রন্থসমূহ তাঁর জন্য স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ বলে পরবর্তীতে তিনি বর্ণনা করেছিলেন।

হিন্দু ধর্মের প্রতি তাঁর ভক্তি বেড়ে যায়, এবং তিনি আরও গভীরভাবে অন্যান্য ধর্মও পাঠ করতে মনোযোগ দিলেন, বিশেষত জেসাস’স সারমন অন দ্য মাউন্ট দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি। তিনি লিও টলস্টয়ের দ্বারাও দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।

এইসব অভিজ্ঞতা তাকে তাঁর শৈশবের প্রথাগত হিন্দু রীতি-নীতিতে ফিরে যেতে সহায়তা করেছিল: যার মধ্যে ছিল নিরামিষভোজন, মদ্যপানে অনাসক্তি এবং যৌন সংসর্গ ত্যাগ।

চার সন্তানের পিতা (আরও একটি সন্তান জন্মের পর মারা যায়) গান্ধী পরে ব্রহ্মচর্য ব্রত গ্রহণ করেন এবং পরিধান করতে শুরু করেন ঐতিহ্যবাহী ধূতি, যাকে তিনি বলতেন তাঁর ‘শোকের পোশাক’।

নিজের ব্রহ্মচর্য যাচাইয়ের জন্য গান্ধী একটি বিতর্কিত পরীক্ষা চালাতে গিয়ে নাতনি মানু গান্ধী এবং অন্য নারীদের তাঁর সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমাতে বললেন, যেখানে তিনি নগ্ন হয়ে ঘুমাতেন।

তার উদ্দেশ্য ছিল “এটা পরীক্ষা করা যে তিনি তাঁর যৌন আকাঙ্ক্ষাকে সম্পূর্ণ জয় করতে পেরেছেন কিনা”- জীবনীকার রমাচন্দ্র গুহ এমনটাই লিখেছেন।

যদিও সেইসব নারীদের সঙ্গে তিনি কোনধরনের যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন বলে জানা যায় না এবং পরীক্ষাটি মাত্র দু’সপ্তাহ স্থায়ী হয়েছিল, তবে এটি ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল।

লন্ডন থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করার পরে গান্ধী ভারতে ফিরে আসেন একজন আইনজীবী হিসেবে কাজ করার জন্য। প্রথম মামলাতেই তিনি হেরে গেলেন এবং ব্রিটিশ একজন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে তাকে বের করে দেয়া হয়।

অপমানিত গান্ধী এসময় দক্ষিণ আফ্রিকায় একটি কাজের প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং ১৮৯৩ সালের এপ্রিল মাসে আফ্রিকার উদ্দেশ্যে ভারত ছাড়েন। পরবর্তী ২১ বছর তার সেখানেই কাটে।

দক্ষিণ আফ্রিকাতে অবস্থানের সময় ট্রেনের প্রথম শ্রেণীর কামরা থেকে তাকে বের করে দেয়া হয়, যার একমাত্র কারণ ছিল তার গায়ের রং।

ভারতীয় অভিবাসীদের প্রতি এই ধরনের আচরণে হতবাক ও ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি সেখানে নিপীড়ন বন্ধের লড়াই এবং আত্মশুদ্ধির ধারণা এবং অহিংস আন্দোলন ‘সত্যাগ্রহের’ বিকাশের জন্য ইন্ডিয়ান কংগ্রেস অব নাটাল প্রতিষ্ঠা করেন।

ভারতীয় লোকজনের ওপর কর আরোপের প্রতিবাদে ধর্মঘট এবং মিছিল করার কারণে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়, কিন্তু ব্রিটিশরা ওই ট্যাক্স প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিল এবং গান্ধীকে মুক্তি দিয়েছিল।

তাঁর এই বিজয় অর্জনের খবর ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়ে এবং গান্ধী একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত হতে শুরু করেন।

গান্ধী ভারতে ফিরে এলেন এবং শিখদের তীর্থস্থান অমৃতসরে এক গণহত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু করলেন। অমৃতসরে বিক্ষোভে ব্রিটিশদের গুলিতে প্রায় ৪০০ মানুষ প্রাণ হারায়, আর আহত হয় ১৩শ।

তাঁর অহিংস আন্দোলন-বিক্ষোভের ডাক সব শ্রেণী এবং ধর্মের মানুষের দ্বারা সাদরে সমাদৃত হয়েছিল। তিনি ব্রিটিশ শাসকদের সাথে অসহযোগিতার ডাক দেন, যার সাথে সাথে ব্রিটিশ পণ্য বর্জনেরও কর্মসূচি ছিল।

এর জবাবে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ গান্ধীকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে এবং দুইবছরের জন্য তাকে কারান্তরীণ করা হল।

বিতর্কিত রাষ্ট্রদ্রোহ আইনটি এর আগে ১৮৭০ সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রবর্তন করা হয় ঔপনিবেশিক বিরোধী আন্দোলন দমনের লক্ষ্যে।

গান্ধী বলেছিলেন, “এই আইনটির প্রণয়ন করা হয়েছে নাগরিকদের মুক্তি হরণের জন্য”।

আইনটি এখনো ভারতের পেনাল কোডের অন্তর্ভুক্ত আছে এবং বিভিন্ন সরকারের দ্বারা শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, সামাজিক মানবাধিকার কর্মী এবং সরকারের সমালোচকদের বিরুদ্ধে আইনটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

১৯৩১ সালে কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নিতে লন্ডন সফরে যান গান্ধী।

তিনি ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় পোশাক পরে তিনি দৃঢ় ব্যক্তিত্ব তুলে ধরেন। কিন্তু আলোচনাটি ৬২ বছর বয়সী গান্ধীর জন্য ব্যর্থ হয়েছিল।

ব্রিটিশ শাসকরা তখনো ভারতের স্বাধীনতার দাবি মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না ।

অনেক মুসলিম, শিখ এবং অন্যান্য প্রতিনিধিরা গান্ধীর ঐক্যবদ্ধ ভারতবর্ষের আদর্শের সমর্থন করতে পারছিলেন না এবং তারা বিশ্বাস করতেন না যে গান্ধী সমস্ত ভারতীয়র জন্য কথা বলছেন।

এই ঘটনার পর গান্ধী কংগ্রেস পার্টি এবং রাজনীতি থেকে এক পা সরে গেলেন, কিন্তু তিনি দলিত সম্প্রদায়ের (তাদেরকে সমাজে মনে করা হতো অচ্ছুত শ্রেণীর) সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন অব্যাহত রাখলেন।

এরপরও সাধারণ মানুষকে তার একত্রিত করার ক্ষমতা এবং অবিচল ও শান্তিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিতে তার ছোট ছোট বিরোধিতা ধীরে ধীরে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে আলোচনায় আসতে বাধ্য করেছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণকে দুর্বল করে দেয়ার সাথে সাথে, গান্ধীর আন্দোলনের লক্ষ্যগুলো বাস্তব হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালে তাঁর প্রিয়তম দেশে স্বাধীনতা আসে।

কিন্তু তাঁর যে আশা ছিল অর্থাৎ, হিন্দু এবং মুসলিম সম্প্রদায় একটি রাষ্ট্রে একত্রে বাস করতে পারবে – সেই আশা সহসাই মিলিয়ে গেল যখন দেশটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল: ভারত আর পাকিস্তান।

এই বিভাজন তৈরি করলো আরও বেশি সহিংসতা। যেসমস্ত মুসলমানরা ভারতে থাকতে আগ্রহী তাদের নিরাপত্তার সহায়তার জন্য গান্ধী দিল্লি ফিরে গেলেন এবং মুসলমানদের অধিকারের জন্য অনশন শুরু করলেন।

স্বাধীনতার ছয়মাসেরও কম সময় পরে একটি প্রার্থনা সভায় যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন গান্ধী, এমন সময় নাথুরাম গডসে নামে এক কট্টর হিন্দু ধর্মানুসারীর ছোঁড়া গুলিতে বিদ্ধ হন তিনি।

মুসলিম সম্প্রদায় এবং পাকিস্তানের প্রতি তাঁর বন্ধূত্বপূর্ণ মনোভাবের কারণে ওই হামলাকারী ক্ষুব্ধ ছিল।

শান্তির জন্য বিশ্বজুড়ে সুবিদিত এক ব্যক্তিত্বের প্রয়াণে সারাবিশ্ব থেকে মানুষ সমবেত হন শোক প্রকাশের জন্য।

গান্ধী ধর্ম, বর্ণ এবং শ্রেণী বিভক্তিহীন এক ভারতের স্বপ্নই দেখেছিলেন – যা তিনি কখনো বাস্তবে দেখে যেতে পারেননি।

এসএইচ-০৮/০২/১৯ ( অনলাইন ডেস্ক, সূত্র:, বিবিসি)