বাবা-মা সন্তানকে কম সময় দিচ্ছেন ?

গত ৫০ বছরে অনেক দেশেই পারিবার কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সিঙ্গেল প্যারেন্টিং অর্থাৎ একা সন্তানের লালন পালন করছেন এমন মা বাবার সংখ্যাও যেমন বেড়েছে নারীদের বাইরে কাজ করার হারও বেড়েছে। এসব কারণে অনেকের ধারণা, বাবা মায়েরা হয়তো এখন সন্তানকে অনেক কম সময় দিচ্ছেন, তাদের সাথে যথেষ্ট সময় কাটাচ্ছেন না এবং এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিশুদের মনোজগতে।

১৯৯৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সিঙ্গেল প্যারেন্টিং এবং নারীর বাইরের কাজ বাড়ার ফলে তাদের ঘরে কাটানো সময় সপ্তাহে গড়ে বাইশ ঘণ্টা বা ১৪ শতাংশ কমে যাচ্ছে; যে সময়টা তারা সন্তানের সাথে কাটাতো।

এই উদ্বেগের পেছনে আছে একটা সরল সমীকরণ যে, পরিবার ব্যবস্থায় পরিবর্তন এবং কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশ গ্রহণের ফলে যেহেতু বাবা-মা বিশেষত মায়েরা বাড়িতে কম সময় থাকছেন তাই তারা সন্তানকে আর আগের মতো সময় দিতে পারছেন না। কিন্তু সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণা ও জরিপে এই সমীকরণটি অসার ও অবাস্তব প্রমাণিত হয়েছে।

আগের চেয়ে সন্তানদের বেশি সময় দিচ্ছেন বাবা-মা
২০১৬ সালে প্রকাশিত সমাজবিজ্ঞানী গিউলিয়া দোতি সানী এবং জুডিথ ট্রেসের গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য উন্নত দেশগুলোতে বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানের সাথে পঞ্চাশ বছর আগের তুলনায় এখন বেশি সময় ব্যয় করেন। অথচ এই দেশগুলোতেই এই সময়টাতে স্বনির্ভর-কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বেশি বেড়েছে। তারা হিসেবটা করেছেন বাবা মায়েদের ডায়রি থেকে; যে ডায়রিতে তারা সারা দিনের কাজের রুটিন ও বিবরণ লেখেন।

তারা এ ব্যাপারে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ ও বিভিন্ন দেশের মানুষের মধ্যে পার্থক্যও দেখিয়েছেন। তাদের গবেষণা অনুযায়ী, গত ৫০ বছরে ইউরোপীয় প্রায় সব দেশেই বাবা ও মা উভয়েরই সন্তানের সাথে কাটানো সময়ের পরিমাণ বেড়েছে। তবে ফ্রান্স ও স্লোভেনিয়া ব্যতিক্রম। ফ্রান্সে মায়েরা এখন সন্তানকে খুবই কম সময় দিচ্ছেন। অন্যদিকে স্লোভেনিয়ায় তুলনামূলক অল্প শিক্ষিতদের মধ্যে সন্তানকে দেওয়া সময়ের পরিমাণ তেমন বাড়েনি, আগের মতই আছে।

ওই সমীক্ষায় আমরা দু’টি সুস্পষ্ট প্যাটার্ন দেখতে পাই। প্রথমত, সব দেশেই মায়েরা বাবাদের চেয়ে শিশুর যত্নে বেশি সময় ব্যয় করেন। এই পার্থক্যটি বেশ বড় এবং শিক্ষিত ও অশিক্ষিত পরিবারগুলোর মধ্যে একই রকম। কানাডা, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো কিছু দেশে এই ব্যবধান কিছুটা কমেছে। ডেনমার্ক ও স্পেনের মতো অন্যান্য দেশে ব্যবধানটি আরও বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, যেসব দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে, সেখানে বাবা-মায়ের সন্তানকে দেওয়া সময়ের পরিমাণও বেড়েছে। এর অর্থ হলো, শিক্ষিত পিতামাতারা তাদের সন্তানকে বেশি সময় দেন।

শিশুদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য
উপরের বিশ্লেষণটি করা হয়েছে অভিভাবকদের ডায়রির তথ্য অনুসারে। শিশুদেরও কী তাই মনে হয়? তারা কি বাবা-মায়ের কাছে যথেষ্ট সময় পাচ্ছে? ২০০১ সালে ডেমোগ্রাফি জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় জন স্যান্ডবার্গ এবং স্যান্ড্রা হফফার্ট যুক্তরাষ্ট্রের শিশুদের ডায়েরি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে একটি সমীক্ষা তৈরি করেছেন। সেখানে দেখা গেছে, ১৯৮১ সালের তুলনায় ১৯৯৭ সালে শিশুরা আগের তুলনায় মায়েদের কাছ থেকে ৪.৩ ঘণ্টা ও বাবাদের কাছ থেকে ৩ ঘণ্টা বেশি সময় পাচ্ছে।

এই গবেষণাটির নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে। কারণ শিশুদের ডায়েরি থাকা এবং সেখানে যথাযথভাবে সময়ের হিসেব থাকা খুব সাধারণ ব্যাপার নয়। কিন্তু এই সমীক্ষার ফলাফল ওপরের সমীক্ষাটির ফলাফলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

আসলেই কী ঘটছে?
বাবা-মায়েরা সন্তানদের কী পরিমাণ সময় দেবেন সেটা আসলে শুধু তাদের বাড়িতে থাকার সময় বাড়া বা কমার ওপর নির্ভর করে না। বরং বাবা মায়ের পছন্দ, মনোযোগ, আদর্শ, পরিবারের আকার ও সম্পর্কের ধরণ ইত্যাদি এ ক্ষেত্রে বেশি ভূমিকা রাখে।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করে করা বেশ কয়েকটি একাডেমিক গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকান বাবা-মায়েদের মধ্যে শিক্ষিত ও অবস্থা-সম্পন্নরা বাসায় কম সময় অবস্থান করছেন, কিন্তু বাসার অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় কাজ কমিয়ে শিশুদের দেওয়া সময়ের পরিমাণ বাড়িয়েছেন। সন্তানের প্রতি তাদের মনোযোগ ও সময় আগের তুলনায় বেড়েছে।

সন্তানকে সময় দেওয়া উচিত
বাবা-মা শিশুদের বেশি সময় দিচ্ছেন এটা অত্যন্ত ইতিবাচক সংবাদ। সন্তানের সাথে সময় কাটানো, তাদের সাথে কথা বলা, তাদের নানা প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ইত্যাদি শিশুর বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি দেখা যেতো মা বাইরে কাজ করতে যাওয়ার কারণে শিশু তার কাছে যথেষ্ট সময় পাচ্ছে না, তাহলে তা সত্যিই উদ্বেগের বিষয় হতো।

ওপরের গবেষণাগুলো থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, বাবা-মায়ের সচেতনতা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার কারণেই মূলত সন্তানকে সময় দেওয়ার পরিমাণ কমে বা বাড়ে। বাইরের কাজও অনেক ক্ষেত্রে সময় কমে যাওয়ার কারণ হতে পারে। সবকিছু নিশ্চয়ই পরিসংখ্যানে ধরা পড়ে না। তবে কিছু মানুষ যেমন অনুমান করেন যে, কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের ফলে সব ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে শিশুরা মায়ের কাছে আগের তুলনায় এখন সময় কম পাচ্ছে, বাস্তবে তার বিপরীতই ঘটছে।

এসএইচ-০৮/১৮/২১ (অনলাইন ডেস্ক)