বছরজুড়ে ধর্ষণের চিত্র ছিল উদ্বেগজনক

বিদায়ী বছরজুড়ে দেশে করোনা মহামারির থেকেও নারী-শিশুদের প্রতি যৌন সহিংসতার পারদ ছিল উর্ধ্বমুখী। গণমাধ্যমগুলোর তথ্য-উপাত্ত বলছে, সারাদেশে নারী-শিশুদের প্রতি যৌন সহিংসতা-নিপীড়ন ছিল গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি। এর মধ্যে ধর্ষণের চিত্রটা আরও উদ্বেগজনক। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, পরিবহন, বাসাতে এসব ঘটনা বেশি ঘটেছে।

এরমধ্যে যৌন হয়রানি, সহিংস আক্রমণ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা অনেক ঘটেছে। আর পারিবারিক নির্যাতন বেড়েছে ৭ শতাংশ। যদিও আগের দুই একটি ঘটনার প্রতিবাদ ও বিচারপ্রক্রিয়াতে জনমতে স্বস্তি আসলেও বেশিভাগ মামলার দীর্ঘসূত্রিতা সমালোচনা জন্ম দিয়েছে।

২০২০ সালের তুলনায় এ বছর অর্থাৎ ২০২১ জানুয়ারি থেকে নভেম্বর-এই ১১ মাসে পারিবারিক নির্যাতন ১০ শতাংশ বেড়েছে। আর ৭ শতাংশ বেড়েছে পারিবারিক নির্যাতন ঘিরে হত্যা, আত্মহত্যারসহ মৃত্যু ঘটনা। দেশে যৌতুকের কারণে ১৯৭টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৪০ জন হত্যা করা হয়েছে। এমন তথ্য পাওয়া গেছে বেসরকারি সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র থেকে।

নির্যাতনকারীদের মধ্যে মাদ্রাসাশিক্ষক, সাজাপ্রাপ্ত আসামি ও পুলিশের নাম আলোচনায় রয়েছে। স্বামীর হাতে নির্যাতনের ঘটনা বরাবরের মতোই বেশি। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেড়েছে হয়রানির সংখ্যাও।

চলতি বছরের শেষে ২২ ডিসেম্বর সংঘবদ্ধ একটি চক্র কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের লাবনী পয়েন্ট থেকে ২৫ বছর বয়সী এক নারী পর্যটককে তুলে নেয়। তারা ওই নারীর স্বামী-সন্তানকে জিন্মি করে এবং হত্যার হুমকি দিয়ে কয়েক দফা ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ উঠেছে। একই সময়ে বান্দরবানের লামায় দুই সন্তানকে আটকে রেখে ৬ মাসের অন্তঃসত্ত্বা নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে। আর বছরজুড়ে গণপরিবহনে যৌন সহিংতার ঘটনাও বেশি ঘটে।

বছরজুড়ে ধর্ষণের চিত্র ছিল উদ্বেগজনক:

গত কয়েক বছরের তুলনায় চলতি বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে দেশে গণপরিবহনে ধর্ষণ, রাস্তাঘাট, বাসাবাড়িতে আটকে রেখে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও ধর্ষণের হত্যার অনেক ঘটনা ঘটেছে।

নারায়ণগঞ্জের বন্দরে উচ্চ স্বরে গান বাজিয়ে চলন্ত বাসে এক গৃহবধূকে গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। গত ১৯ ডিসেম্বর রাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে উপজেলার মদনপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে এই ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় পুলিশ অভিযুক্ত চালক, হেলপারসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

এ বছরে ২১ নভেম্বর রাজধানীর একটি বাসে অর্ধেক (হাফ) ভাড়া দেওয়ায় প্রকাশ্যে এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। অভিযোগকারী শিক্ষার্থী বদরুন্নেসা কলেজের উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ওই ছাত্রীর অভিযোগ, ঠিকানা এক্সপ্রেস লিমিটেডের বাসে হাফ ভাড়া দেওয়ায় ওই গাড়ির চালকের সহকারী বাস থেকে নামার সময় তাকে ধর্ষণের হুমকি দেয়। তবে বাসটি দ্রুত চলে যাওয়ায় হুমকিদাতার নাম জানতে বা গাড়ির নম্বর লিখে নিতে পারেনি সেই ছাত্রী। এ ঘটনার প্রতিবাদে রোববার আন্দোলনে নামে বদরুন্নেসা কলেজের শিক্ষার্থীরা। পরে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে তারা আন্দোলন স্থগিত করেন।

২০২১ সালের এপ্রিল মাস থেকে আলোচনায় ছিল হেফাজত নেতা মামুনুল হকের নারীকাণ্ড। তিনি গত ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে রয়্যাল রিসোর্টে এক নারীর সঙ্গে অবস্থান করছিলেন। ওই সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মামুনুল হককে ঘেরাও করেন। পরে পুলিশ তাদের আটক করে নিয়ে থানায় নিয়ে যায়। পরে ৩০ এপ্রিল সকালে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে দুই বছর ধরে ধর্ষণের অভিযোগে হেফাজত নেতা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও থানায় মামলা দায়ের করেন ওই নারী। যাকে মামুনুল হক তার দ্বিতীয় স্ত্রী দাবি করেছিলেন।

এ অপরাধের ক্ষেত্রে বাদ যায়নি পুলিশও। এরমধ্যে গত ৮ ডিসেম্বর রাতে বাগেরহাটের একটি হোটেলে ঢুকে শিশুর সামনে মাকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে পুলিশের এক এসআইয়ের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় পরে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সারাদেশে ২০২০ সালে ১ হাজার ৬২৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৫৩ জনকে। এ বছরের ১১ মাসে ধর্ষণের ঘটনা ১ হাজার ২৪৭, ধর্ষণের পর হত্যার শিকার ৪৬ জন। এ ছাড়া গৃহকর্মী নির্যাতন ৪১, যৌন হয়রানির ১৯৬টি ঘটনা ঘটেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির দেওয়া তথ্য-উপাত্ত বলছে, চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে দেশে ধর্ষণ সংক্রান্ত ১ হাজার ১৮২টি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ধর্ষণ ৯৫৫টি, দলবদ্ধ ধর্ষণ ২২০টি ও ধর্ষণের চেষ্টা ২৫৯টি। অর্থাৎ দিনে প্রায় চারটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। একই সময়ে রাস্তা, যানবাহন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র, এমনকি বাড়িতে দেশের প্রায় ৮৪ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।

জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে ৮১৩ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এছাড়া ১৪৭ কন্যাশিশু অপহরণ ও পাচারের শিকার হয়েছে। বাল্যবিয়ে বেড়েছে ১০ শতাংশ।

এ বছর আলোচনায় বাল্যবিবাহ:

বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে আলোচনায় আসে বাল্যবিবাহের ঘটনা। করোনা মধ্যে সাতক্ষীরায় বাল্যবিয়ে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। দীর্ঘ দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে অভিভাবকরা মেয়েদের গোপনে বিয়ে দেন। এই সময়ে জেলার দুইটি স্কুলে ১১৭ জন স্কুলছাত্রীর বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

দারিদ্র্যসহ বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে অভিভাবকরা এলাকায় বখাটেদের ইভটিজিং, অপহরণ চেষ্টা এবং অ্যাসিড নিক্ষেপের আতঙ্কে তারা মেয়েদেরকে বয়স ১৮ বছর পূর্ণ না হতেই বিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এমনটাই মনে করছেন সমাজকর্মীরা।

গণমাধ্যমের তথ্য বলছে, বাল্যবিয়ের শিকার শিক্ষার্থীদের বয়স সর্বোচ্চ ১৭ বছর। এর মধ্যে বেশিরভাগ ১৬ বছর অথবা তার নিচে। ষষ্ঠ শ্রেণি এবং সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থাতেই অনেকে বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছেন।

বেসরকারি সংস্থা এনসিটিএফের জরিপের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ২০২০ সালে এই ইউনিয়নে ৮৭টি বাল্যবিয়ে হয়। অপরদিকে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত বাল্যবিয়ে ৬৭ জনের হয়েছে। সেপ্টেম্বর শুধু থেকে কয়েকগুণ বেশি এ বাল্যবিবাহের সংখ্যা।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের এক গবেষণা বলছে, দেশে করোনার কারণে বাল্যবিয়ে শতকরা ১৩ ভাগ বেড়েছে৷ গত ২৫ বছরে যা বাংলাদেশে সর্বোচ্চ৷

এ বছর নাটোরের বাগাতিপাড়া মহিলা মাদ্রাসা থেকে এবার দাখিল পরীক্ষায় মোট ৯৮ ছাত্রীর অংশ নেওয়া কথা ছিল। কিন্তু করোনাকালে তাদের বাল্যবিয়ে হয়ে যাওয়া কেউ পরীক্ষা কেন্দ্র আসেননি। এদের মধ্যে পরীক্ষার প্রবেশপত্র ১৫ জনের পরিবারের কাছে পৌঁছে দিলেও তারা পরীক্ষা দেননি।

পেড়াবাড়িয়া দাখিল মাদ্রাসা কেন্দ্রের কেন্দ্র সচিব ইব্রাহিম হোসাইন জানান, গত ১৪ নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে এ পর্যন্ত প্রতি গ্রুপে দুটি বিষয়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। তবে পরীক্ষায় ৮৩ জন উপস্থিত হলেও বাগাতিপাড়া মহিলা মাদ্রাসার একজন ছাত্রীও অংশ নেয়নি।

২০২১ সালে পারিবারিক নির্যাতনের মাত্রা ছিল উর্ধ্বমুখী:

করোনার সময়ে নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনাকালীন সময়ে পুরুষের অতিরিক্ত ঘরে অবস্থানসহ বেশ কয়েকটি কারণে এসব সহিংসতা বেড়েছে বলে দাবি করেছে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের সহযোগিতায় জাতীয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধের ফোরাম (জেএনএনপিএফ)।

সংগঠনটির দাবি, করোনার সময়ে মানুষের আয় হ্রাস, কর্মসংস্থানের অভাব, সীমিত বিচারিক কার্যক্রম, মামলার বিষয়ে অনাগ্রহ, পুরুষের অতিরিক্ত ঘরে অবস্থান ইত্যাদি কারণে নারীর প্রতি সহিংসতা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।

এ বছরের ৩ সেপ্টেম্বর নড়াইলের কালিয়ায় যৌতুক না দেওয়ায় এক অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে স্বামীর বিরুদ্ধে। জানা গেছে, সদরের দিপালী বিয়ের পর স্বামী রকিবুলের পরিবারকে কয়েক দফায় বাবার বাড়ি থেকে এনে ২ লাখ টাকা যৌতুক দেন। কিন্তু স্বামী আরও যৌতুকের জন্য ওই গৃহবধূকে চাপ দেন। রাজি না হওয়ায় তাদের মধ্যে চলে পারিবারিক কলহ। এরই জেরে বৃহস্পতিবার রাতে তাদের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডার একপর্যায়ে রকিবুল হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে দিপালীকে হত্যা করে বলে অভিযোগ স্বজনদের।

একই মাসে ১১ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়ায় স্ত্রীকে পিটিয়ে মারাত্মক আহত করার অভিযোগ উঠেছে আবু সাঈদ নামে এক পুলিশ কনস্টেবলের বিরুদ্ধে। মারধরের শিকার গৃহবধূ কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

জানা গেছে, ২ বছরে আগে চুয়াডাঙ্গা জেলা দামুড়হুদা উপজেলার হাতি ভাঙ্গা গ্রামের আমজাদ হোসেনের ছেলে আবু সাঈদের সাথে নির্যাতিতার বিয়ে হয়। কিন্তু দাবি-দাওয়া পূরণ করে বিয়ের পরও নতুন করে যৌতুক দাবি এবং ছোটখাট বিভিন্ন কারণে নির্যাতনের শিকার হতেন গৃহবধূ। পরবর্তীতে আবারও যৌতুক দিতে রাজি না হওয়ায় গৃহবধূকে পিটিয়ে আহত করেন স্বামী।

জেএনএনপিএফ (২৬ টি মানবাধিকার সংগঠনের প্ল্যাটফর্ম) দেশের ২০টি জেলা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুয়ায়ী দাবি করে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশের ২০টি জেলায় ৬০৯ টি পারিবারিক নির্যাতন, ৪২ টি ধর্ষণ, ২৩৯ টি যৌতুকের জন্য নির্যাতন এবং ১১২ টি বাল্যবিবাহের মত ঘটনার অভিযোগ এসেছে তাদের কাছে। তাছাড়া এই সময়ে ৭২ টি বহু বিবাহ, ৭৩ টি তালাক, ১ টি হত্যা ও ৫ টি আত্মহত্যা, ১৩২ টি দাম্পত্য কলহ এবং অন্যান্য ৯৪ টি ঘটনাসহ সর্বমোট এক হাজার ৩৭৯ টি অভিযোগ নথিভুক্ত হয়। তবে এই এক হাজার ৩৭৯টি মামলার মধ্যে ৮৬৩টি নিষ্পত্তি হয়েছে এবং ৪২২টি মামলা চলমান রয়েছে।

এসএইচ-২০/৩০/২১ (অনলাইন ডেস্ক, সূত্র : সময়)