প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ইতিহাসে জ্যেষ্ঠতার যত লঙ্ঘন

দেশের ২৩তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে আপিল বিভাগের বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে নিয়োগ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, আপিল বিভাগের বিচারক হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছেন। এই নিয়োগ শপথ গ্রহণের তারিখ থেকে কার্যকর হবে।

দেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার পদত্যাগের পর ২২তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে ২০১৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি শপথ নেন বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। ৪৭ মাস প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন শেষে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর অবসরে যাচ্ছেন তিনি। সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।

প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন বর্তমানে এমন চারজন বিচারপতি রয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। তাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠতার ক্রমানুসারে শীর্ষে রয়েছেন বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী। অন্য তিনজন হলেন- বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান এবং বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিসহ আইনজ্ঞ ও সুশীলসমাজের সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগদানের পক্ষে মত প্রদান করলেও গত দুদশকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি নিয়োগে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘিত হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্ট সূত্র অনুযায়ী, আপিল বিভাগের বর্তমান বিচারপতিদের মধ্যে বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ২০২৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর, বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান ২০২৩ সালের ৩০ জুন এবং বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ২০২৬ সালের ১০ জানুয়ারি অবসরে যাবেন। জ্যেষ্ঠতা না মেনে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের জের ধরে এর আগে বিচারপতির পদত্যাগের নজিরও রয়েছে।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে প্রথম আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. রুহুল আমিনকে ডিঙিয়ে ২০০৩ সালের ২৩ জুন বিচারপতি কে এম হাসানকে নিয়োগ দেওয়ার ঘটনা ঘটে। দ্বিতীয় দফা বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিমকে ডিঙিয়ে বিচারপতি সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছের হোসেনকে ২০০৪ সালের ২৭ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ১ মার্চ বিচারপতি এম এম রুহুল আমিনকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয় জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিমকে ডিঙিয়ে।

এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এ পর্যন্ত চারবার জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ঘটনা ঘটেছে। ২০০৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিমকে ডিঙিয়ে বিচারপতি তাফাজ্জাল ইসলামকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে নিয়োগ দেওয়া হয় বিচারপতি এম এ মতিন ও বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানকে ডিঙিয়ে। পরে ওই দুই বিচারপতি মেয়াদ থাকা অবস্থায় আর বিচার কাজে অংশ নেননি।

এরপর ২০১১ সালের ১২ মে বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলে দ্বিতীয় দফা জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের শিকার হন বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান। পরে তিনি ৭ মাসের বেশি সময় ছুটিতে থাকার পর ২০১১ সালের ১২ মে পদত্যাগ করেন। ২২তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে নিয়োগ দেওয়ায় জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন হওয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে পদত্যাগ করেছিলেন বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্‌হাব মিঞা। ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা পদত্যাগ করার পর প্রায় ৩ মাস প্রধান বিচারপতির পদটি শূন্য ছিল। এ সময় জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে রুটিন দায়িত্ব পালন করছিলেন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্‌হাব মিঞা।

এবারও ২৩তম প্রধান বিচারপতি নিয়োগ হয়েছে জেষ্ঠ্যতা লঙ্ঘন করে। আপিল বিভাগের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ইমান আলীকে নিয়োগ না দিয়ে দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাৎক্ষণিক ভাবে মার্চ পর্যন্ত ছুটিতে গেছেন বিচারপতি ইমান আলী। সুপ্রিম কোর্টের একটি সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এ নিয়ে ২৩ জন প্রধান বিচারপতির মধ্যে ১৪ জনকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলো ৯ বার।

এদিকে, প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, সংবিধানে দেশের প্রধান বিচারপতি নিয়োগের এখতিয়ার মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া আছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতিদের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি একজনকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়ে থাকেন। এখানে আইন ও জ্যেষ্ঠতার কোনো বিষয় নেই।

সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিয়ে থাকেন। সংবিধানের ৯৫ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগ করিবেন।’

এসএইচ-২৯/৩০/২১ (অনলাইন ডেস্ক, সূত্র : সময়)